Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৃত্যুমুখে গঙ্গানির্ভর নদ-নদী

প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১১ এএম, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মিজানুর রহমান তোতা : চোখের সামনে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে আমাদের নদ-নদী। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ভারতের আগ্রাসনে দিনে দিনে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে গঙ্গানির্ভর সব নদ-নদী। কথাগুলো দক্ষিণ-পশ্চিমের নদীপাড়ের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের। যশোরের ভৈরব নদপাড়ের বাসিন্দা ডাকাতিয়া গ্রামের ইজাহার আলী বললেন, নদের বেহাল অবস্থা দেখে খুবই কষ্ট হয়।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একসময়ের প্রমত্তা কুমার নদীর সংকটাপন্ন অবস্থা দেখিয়ে স্কুলশিক্ষক আব্দুল আজিজ বললেন, মাটি ও মানুষের স্বার্থে আমাদের নদীগুলো বাঁচানো দরকার। কিন্তু কোন উদ্যোগ নেই। বরং কোনরকমে জীবিত থাকা নদীগুলো গলাটিপে হত্যা করছে প্রভাবশালীরা। তারা নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তির মতো দখল করে যে যার মতো নদীর বুকে পাটা দিয়ে মাছ চাষ করছে, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরী করছে। করছে চাষাবাদও। শুধু শৈলকুপার কুমার নদ নয়, সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গঙ্গানির্ভর প্রায় সব নদ-নদীর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। নদ-নদীর পানির খেলা নেই, নদী একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা, সে কথা এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে আর শোনা যায় না।
কেউ কোনদিন ঘর বেঁধ না মেঘনা নদীর ধারে-আমীরকে সে এক পলকে পথের ফকির করে, সেটিও মিথ্যা হয়ে গেছে। এখন নদীর ধারে এক শতক জমি কিনলে ১০/২০ শতক ফ্রি পাওয়া যায় নদীর জমি। শুধু ফারাক্কা নয়, মিনি ফারাক্কার ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না ইছামতি, কোদলা ও বেতনাসহ অভিন্ন নদীগুলো। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমের কৃষি, শিল্প, বনজ, মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা ও গড়াইয়ের শাখা নদ-নদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, নবগঙ্গা ও অভিন্ন  ইছামতি ও কোদলাসহ সব নদী কার্যত খালে পরিণত হয়েছে। গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যাচ্ছে না তা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচের চেহারা দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। নদীদেহের অন্যতম হৃদপি- পদ্মা এখন স্পন্দনহীন। পদ্মার বুকে শুরু হয়েছে হাহাকার। পদ্মার শাখা-প্রশাখার উৎসমুখ গড়াইয়ে পানি গড়িয়ে আসছে না পদ্মা থেকে। অনেক প্রমত্তা ও স্রোতস্বিনী নদীর পানি কমে গেছে, কোন ঢেউ নেই, পানি নড়াচড়া নেই, একরকম নিথর হয়ে আছে। এ অঞ্চলের নদ-নদীর পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ার স্বাভাবিক ধারা হয়েছে অস্বাভাবিক। মারমুখী ও বিপজ্জনক হচ্ছে পরিবেশ। ঘটছে ষড়ঋতুর পরিবর্তন। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন হুমকির মুখে। বিপন্ন দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে প্রজেক্ট) অস্তিত্ব। দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা ও নওয়াপাড়া নদী বন্দর মারাত্মক সংকটে। যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়াসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, উদ্ভিদ, প্রাণীকুল, জলজ, বনজ ও মৎস্য সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। লবণাক্ততা গ্রাস করায় ক্রমেই উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা হচ্ছে বিরাণভূমি। নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন এর জন্য মূলত দায়ী ফারাক্কা। তাদের মতে, মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকা-, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে বলিষ্ঠ ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে নদ-নদীর। রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বাংলাদেশের নদী ধাবমান। নদীই জীবন। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার পানি প্রাপ্তি। সেটি সম্ভব হচ্ছে না ফারাক্কা ও মিনি ফারাক্কার কারণে।
ভাটি অঞ্চলের নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত একথাটি সবাই স্বীকার করলেও ফারাক্কার মরণ বাঁধের কারণে যে এটি ঘটছে তা ভারতের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার মতো ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বরাবরই অনুপস্থিত থাকছে। ফারাক্কা বাঁধের পাশাপাশি অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধ, পাকা সড়ক নির্মাণ, গ্রোয়েন ও পাথর ফেলে পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ভারত। চলতি শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই গঙ্গানির্ভর নদ-নদীর কাহিল অবস্থা দেখে নদপাড়ের লোকজন বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। গতবারের চেয়ে এবার ভরা শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ অবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, এবার ইতোমধ্যেই মরণ ফাঁদ ফারাক্কার কারণে প্রতিমুহূর্তে খেসারত দিতে হচ্ছে নানাভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে।
সূত্রমতে, নদী ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণেও দিনে দিনে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে নদ-নদী। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নদী শুকিয়ে খাল ও পুকুরে পরিণত হওয়ায় সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীর দুইপাড় হয়ে যাচ্ছে দখল। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পানি প্রত্যাহার ছাড়াও বহুকাল যাবত সিংহভাগ নদ-নদী সংস্কার করা হয়নি। এতে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমের পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে নদীগুলো। তাছাড়া নদ-নদীর কোন কোন অংশে যতটুকু প্রবাহ আছে তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ, বাঁধ ও পাটাতন দিয়ে মাছ চাষ, অবৈধ দখল, সøুইস গেট ও পোল্ডার এবং ভেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে। নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় পরিবেশের উপর নেমে এসেছে মারাত্মক বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞদের কথা, আসলে নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। উন্নয়ন ঘটবে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, জীব-বৈচিত্র্য, বনজ ও মৎস্যসম্পদ এবং পরিবেশের। সেজন্য নদী বাঁচানোর বিকল্প নেই।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী ও খাল-বিলের প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, অধিকাংশ নদ-নদী একবারেই শুকিয়ে গেছে। খাল-বিলের পানিশূন্য অবস্থা। এতে সৃষ্টি হচ্ছে জীবন-জীবিকায় মারাত্মক সংকট। ঝিনাইদহের নবগঙ্গা, কালীগঞ্জের চিত্রা, নড়াইলের মধুমতি, যশোরের ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, ইছামতি ও মাগুরার নবগঙ্গাসহ সব নদ-নদী প্রায় পানিশূন্য অবস্থা। মানচিত্র থেকে অনেক নদীর নাম মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য জানতে চাইলে বলা হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নদীগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে দ্রুত। নদ-নদী খনন কিংবা ড্রেজিং করা হলে গোটা এলাকার সমস্যাদির সমাধান এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- আরো জোরদার হতো বলে সংশ্লি­ষ্ট বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নদ-নদীর বর্তমান চেহারায় দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার আরো করুণ। নদ-নদীর চেহারা জানান দিচ্ছে ভরা শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট হবে তীব্র। সমানে সেচনির্ভর বোরো আবাদ নিয়ে কৃষকরা মহাদুশ্চিন্তায়। বছর বছর সেচ খরচ বেড়েছে, কমেছে এমন রেকর্ড নেই। গতবার বাড়তি দাম দিয়েও অনেক এলাকায় সেচের পাননি কৃষকরা। এ অবস্থা মোকাবিলা করে চাষাবাদ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার বলে জানালেন এ অঞ্চলের কয়েকজন কৃষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ