Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাঁচ বছর ধরে আলোচিত সমালোচিত রকীব কমিশন

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ আজ

| প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম তুলে ধরবে
পঞ্চায়েত হাবিব : বহুল আলোচিত-সমালোচিত কাজী রকীবউদ্দিন নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামীকাল বুধবার শেষ হচ্ছে। ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করা এ কমিশন আজ মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট মো: আব্দুল হামিদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করে তাদের মেয়াদের কার্যক্রম তুলে ধরবে। কাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের পাঁচ বছরের মেয়াদের কার্যক্রম তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবে বহু সমালোচিত এই ইসি।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদায় নেয়ার আগে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতের নিয়ম রয়েছে। এরই মধ্যে রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব শেষ হয়েছে। আজ সন্ধ্যা ৬টায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের মেয়াদের কার্যক্রম তুলে ধরবেন তারা। কাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কার্যক্রমগুলো তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবে ইসি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিজেদের সফল কার্যক্রমগুলোর একটি তালিকা এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে রকীব কমিশন দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়লেও সব নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করার দাবি করা হয়েছে। এছাড়া বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ, ইভিএম তৈরির উদ্যোগ এবং স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রমের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে এতে। ইসি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে  প্রেসিডেন্টের নিকট যেসব বিষয় তুলে ধরা হতে পারে তার একটি ধারণা দেয়া হলোÑ
দশম জাতীয় নির্বাচন
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনটি নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও সতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের সবাই ভোট দিতে পারেনি। তবে অন্য আসনগুলোতে ভোটের চিত্র ভালো ছিল। এসব আসনে ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন  ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন
দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে ১৮টি দল অংশ নিলেও মূল লড়াই হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত এ ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শেষ ধাপের ভোট গ্রহণ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয় শতাধিক ব্যক্তি। আহত হয় কয়েক হাজার, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। ইউপি নির্বাচনের ইতিহাসে ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সবচেয়ে খারাপ বলে আখ্যায়িত করা হতো। ওই নির্বাচনে মারা গিয়েছিলেন ৮০ জন ও আহত হয়েছিলেন পাঁচ হাজারের বেশি। সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই নির্বাচন নিহতের পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (২২০ জন) নির্বাচিত হওয়ারও রেকর্ড গড়েছে। এর আগে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ১০০ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশ্য এসব বিষয় তুলে না ধরে সফলভাবে নির্বাচন শেষ করার বিষয়টিই প্রেসিডেন্টকে জানাবে ইসি।   
দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি নির্বাচনের ভোট
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক সিটি নির্বাচনের যাত্রা শুরু করে ইসি। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া এই নির্বাচনের মাধ্যমেই কমিশন প্রথমবারের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা পায়। এ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের নিকট থেকে ইসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এটিকে ইসির বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে।
প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন
বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দল ছাড়াই গত ২৮ ডিসেম্বর তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করে ইসি। এ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও জেলা নির্বাচন অফিসাররা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোথাও কোথাও উপজেলা নির্বাচন অফিসারকেও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়। প্রতিটি জেলায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের (স্থানীয় সরকারের চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০ হাজারের ওপরে ভোটার) ভোটেই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচিত হয়। প্রতিটি জেলায় চেয়ারম্যান ছাড়া ১৫ জন সাধারণ ও ৫ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন।
আম ও মশাল প্রতীক নিয়ে দ্বন্দ্বের অবসান
২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বর ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি আম প্রতীকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনকালে দলটির চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ শওকত হোসেন নিলু ও মহাসচিব ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। ২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট চেয়ারম্যান নিলু বহিষ্কার করেন মহাসচিব ফরহাদকে। পরে ১৮ জুলাই চেয়ারম্যান নিলু নতুন কমিটি গঠন করে ওই বছরের ২২ অক্টোবর জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদন করে ইসিতে তালিকা পাঠান। অন্যদিকে গত বছরের ১৪ অক্টোবর তৎকালীন মহাসচিব ফরহাদ নিজেকে চেয়ারম্যান ও  মো: মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাকে মহাসচিব করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। এসময় শওকত হোসেন নিলুকে বহিষ্কার সংক্রান্ত কাগজপত্রসহ নতুন কমিটি ইসিতে তালিকা পাঠায়। সেই সঙ্গে ২০১৪ সালের ১৯ জুলাই এনপিপির এ অংশের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কার্যকরী কমিটির সভার কার্যবিবরণী যুক্ত করে দলীয় প্রতীক ‘আম’ দাবি করেন ফরহাদ। দুই দলের দাবির প্রেক্ষিতে শুনানি করে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির নির্বাচনী প্রতীক আম শেখ শওকত হোসেন নিলুর পক্ষকে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন।
এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মশাল প্রতীক দলটির দুই পক্ষ কমিশনের দারস্থ হয়। গত ১২ মার্চ সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে শিরীন আখতারকে সাধারণ সম্পাদক করা নিয়ে দুই ভাগ হয় জাসদ। হাসানুল হক ইনু ও শিরীনের কমিটির পাশাপাশি পাল্টা কমিটি গঠন করেন মইনুদ্দিন খান বাদল, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান এবং তাদের অনুসারীরা। দুই পক্ষের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে ১৩ এপ্রিল ইনু-শিরীন নেতৃত্বাধীন জাসদকে মূলধারা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২৮ এপ্রিল তাদের মশাল প্রতীক দেয় নির্বাচন কমিশন
বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ
২০১৬ সালের আরেকটি আলোচিত বিষয় হলো ছয় দশক পর বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ। ৩১ অক্টোবর ২২টি ছিটমহলবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। গত বছর বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নানা বঞ্চনার অবসান হয় ছিটবাসীদের। বাংলাদেশের ৫১টির বিনিময়ে ভূখ-ের মধ্যে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। এর আগে ১০ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়। ১৭ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের ছবি  তোলা, ১ আগস্ট ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের খসড়া ও ৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ বছর সেখানে সাড়ে ১০ হাজারের মতো ছিটমহলবাসী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
ইভিএম তৈরির উদ্যোগ
নিজস্ব উদ্যোগে নতুন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) তৈরির উদ্যোগ নেয় কাজী রকীব কমিশন। ইসির প্রস্তাবিত নতুন ইভিএমের কারিগরি ও ব্যবহারিক দিক, নির্বাচনে ব্যবহারের উপযোগিতা, সুবিধা, অসুবিধা ইত্যাদি পর্যালোচনার জন্য টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। টেকনিক্যাল কমিটিতে একজন উপদেষ্টা, একজন আহ্বায়ক, একজনকে সদস্য সচিব করে বাকিদের সদস্য করা হয়েছে। এর আগে বুয়েটের সহযোগিতায় ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আংশিক ভোটের মাধ্যমে ইভিএম চালু হয়। পাঁচ বছরের মাথায় সেগুলোর কয়েকটি বিকল হয়ে পড়ে। ইভিএমে  দেশীয় ব্যাটারি ব্যবহার নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হয় বুয়েটের সঙ্গে। বুয়েট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ওই ব্যাটারি ব্যবহারের কারণেই ইভিএমগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।
স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম
নাগরিকদের হাতে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্টকার্ড) তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে গত বছরে স্মার্টকার্ড যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বছরের শেষ দিকে (২ অক্টোবর) স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ অক্টোবর থেকে আইরিশের প্রতিচ্ছবি এবং দশ আঙুলের ছাপ নিয়ে ঢাকা এবং কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে ইসি। বর্তমানে ঢাকা সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে এটি বিতরণের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিকের হাতে এটি তুলে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইসির নিজস্ব ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করে অফিস স্থানান্তর, নাগরিকদের ভোটার আইডি সংক্রান্ত কার্যক্রম জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিস্তীর্ণ করা, অনলাইনে সব ধরনের সেবার ফরম প্রাপ্তি ও জমার সুবিধাসহ বর্তমান ইসির মেয়াদে হওয়া সাফল্যজনক আরো বিভিন্ন কার্যক্রম এতে তুলে ধরা হয়েছে। বুধবার প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব বিষয়াদিই জনগণের সামনে তুলে ধরবেন তারা।   



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ