Inqilab Logo

শনিবার, ০১ জুন ২০২৪, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে কর্মকর্তাদের কাজ করার আহ্বান গভর্নরের

রূপালী ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলন

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ব্যবসা করা। তাই ঋণ দিতে আপনাদের কোনো জড়তা ও ভীতি থাকলে চলবে না। সঠিক ও যথাযথ নিয়ম মেনেই ঋণ দেবেন। সকল পলিসি মেনে ঋণ দিলে বিপদে পড়ার শঙ্কা ও চিন্তা থাকবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকেও ভয় পেতে হবে না। গতকাল রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে রূপালী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর অলস টাকা পড়ে থাকলেও গ্রামের মানুষ চাহিদানুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না। সম্মেলনের স্বাগত বক্তব্যে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান ২০১৭ সালকে রূপালী ব্যাংকের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবে উল্লেখ করেন। এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন, পরিচালক ড. মো. হাসিবুর রশীদ, অরিজিৎ চৌধুরী ও আবদুুল বাসেত খান প্রমুখ।
গভর্নর বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ২৬ শতাংশ আমানত ও ১৭ শতাংশ ঋণ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের শাখা রয়েছে তিন হাজার ৬০৩টি শাখা। এই বিশাল নেটওয়ার্ক সরকারের অগ্রাধিকার খাতে লেন্ডিং সুবিধা নিশ্চিত করাসহ সকল সেফটিনেট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণসহ সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এই ব্যাংকগুলোর মন্দ দিকও রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই এই চার ব্যাংকের। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৮৭ কোটি বা ৩৩ দশমিক ৯০ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের। এ সময়ে সোনালী ব্যাংকের ২৭, রূপালীর ১৮ দশমিক ৭০, অগ্রণীর ২৫ দশমিক ৬২ ও জনতার রয়েছে ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের ঋণের ৩০ শতাংশ শীর্ষ খেলাপী গ্রহীতার অনুকূলে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, এ বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে দেখতে হবে। আইনের মধ্যে থেকে যা যা করা দরকার সেটা করতে হবে। মূলধন বাড়াতে রূপালী ব্যাংকের বন্ড চাওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।
ঋণ বিতরণে এসএমই খাতকে প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান জানিয়ে গভর্নর বলেন, এসএমই ঋণের প্রতি ফোকাস থাকতে হবে। বিশেষ করে ম্যানুফেকচারিং খাতে। কারণ এখানেই কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি হয়। তবে কর্মসংস্থান মানেই পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি পাওয়া তা নয়। বরং কাউকে স্বনির্ভরশীল করে তোলা। এসইএমই ঋণ দিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের স্ব-নির্ভরশীল করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বড় সমস্যা কর্মসংস্থান। প্রতিবছর ১৮ থেকে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসে। সরকার ও অটোনমাস বডি মিলে ১৫ লাখের মতো চাকরি দিতে পারে। তাই অধিক কর্মসংস্থান ও মানুষকে স্বনির্ভর করার স্বার্থে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া যায় কিনা সেটি ব্যাংকগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার আহ্বান জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ভোক্তা ঋণে কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চাকরির সার্টিফিকেটই জামানত বলে গণ্য হয়। তাই এসএমই ঋণেও ব্যক্তির প্রশিক্ষণ দক্ষতাকে জামানত হিসেবে নেয়ার পরামর্শ দেন গভর্নর। কৃষির মতো এসএমই ঋণ বিতরণেও ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান ফজলে কবির।
সুশাসন নিয়ে গভর্নর বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর করপোরেট সুশাসনের বিষয়টি ব্যাংকিং খাতের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এটা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোতে ইন্টারন্যাল কন্টোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স পরিপালন জরুরি। সব ব্যাংকেই এই পলিসি রয়েছে। এটা পরিপালন করতে হবে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, ডিপোজিট, অ্যাডভান্স, এডি রেশিও সবকয়টি জায়গায় বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা দুর্বল। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এডি রেশিও মাত্র ৫০ শতাংশ। এদের আমানত সংগ্রহের খরচ পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। কস্ট অব ফান্ড রযেছে পাঁচ শতাংশ। তাহলে তারা আট থেকে ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করলে উল্টো ক্ষতি হয় এক টাকা। তার ওপর ১০০ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা বিনিয়োগে আসছে। বাকি ৫০ টাকা অলস পড়ে থাকছে। এদের শ্রেণিকৃত ঋণের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। বেসরকারি ব্যাংকের যেখানে পাঁচ থেকে সাত শতাংশের মধ্যে সেখানে এগুলোর ২০ শতাংশের ওপরে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কিভাবে বেঁচে থাকবে এ বিষয়গুলো গভীরভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, অনেকেই বলেন মানুষের মৌলিক শিক্ষা পাওয়া যেমন অধিকার, তেমনি ঋণ পাওয়াটাও অধিকার। অথচ আমরা গ্রামের অসহায় কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় রেখেছি। যাদের ঋণ পেতে ক্ষুদ্রঋণদানকারি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ শতাংশ সুদ গুণতে হয়। তাছাড়া সেখানে ১০০ টাকা চাহিদার বিপরীতে ৪০ টাকার ঋণের জোগান মিলছে। ৬০ টাকা দিতে পারছে না তারা। ফলে গ্রামের মানুষ ঋণ চেয়েও পাচ্ছে না। তাহলে কি ওই মানুষগুলোর ঋণ পাওয়ার অধিকার নেই। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে অলস অর্থ পড়ে থাকার পরও ঋণ দিচ্ছে না। এটা এক ধরনের বৈষম্য। তাই সময় এসেছে নতুন নতুন পথ বের করার। জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার। এনজিওরা জামানত ছাড়া ঋণ দিয়ে ৯৮ শতাংশ আদায় করতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কেন পারবে না এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে কর্মকর্তাদের কালচারাল গ্যাপকে দায়ী করেন ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা চাকরি বাচাতেই কাস্টমারদের ওয়েলকাম করে। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীরা মনে করেন, কাজ করি বা না করি, ঋণ দেই বা না দেই, লাভ করি বা না করি মাস শেষে বেতন পাব। আমি অতটা না করলেও চাকরিও যাবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আপনিও বাণিজ্যিক অর্গানাইজেশন চালান। এখানে আপনার কমপিটিটর আছে। তাই এ ধরনের মানসিকতা থাকলে তার পরিবর্তন আনা জরুরি।
২০১৭ সালকে রূপালী ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর উল্লেখ করে আতাউর রহমান প্রধান বলেন, রূপালী ব্যাংকে আগে খেলাপী ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে ও খেলাপী ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং না করে মুনাফা দেখানো হয়েছে। গত ২০১৫ সালে মুনাফা হয়েছে বলে মিথ্যা রিপোর্ট সরকারকে দিয়ে তার বিপরীত কর পরিশোধ করে ব্যাংকটির ক্ষতি করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে সবার আগে সঠিক হিসাব করেছি। এর ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রকৃত লোকসান ২৪৪ কোটিতে দাঁড়ায়। তবে ডিসেম্বরে তা ৫২ কোটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এ সময়ে লোকসানি শাখা নেমে এসেছে ৮০টিতে। আতাউর রহমান প্রধান বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি যতবেশি শক্তিশালী হবে, দেশের অর্থনীতির ভীত ততবেশি মজবুত হবে। তাই ব্যাংকের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে হলে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শহরের সাথে গ্রামকেও প্রধান্য দিতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মের মধ্যে থেকেই গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন বলেন, নিজেদের একগুয়েমির কারণে হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যাংকের কর্মীরা ভুল করেছেন। নিজেদেরকেই তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা চাইলে সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তিনি বলেন, বড় ঋণ খেলাপী যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যা করণীয় করতে হবে। আগে রূপালী ব্যাংকের অফিসে অন্য অফিসের লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ইউনিয়নের নামে ঋণ বিতরণ, কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি বদলি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলত। এগুলো অনেকাংশে বন্ধ করা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ