পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টাফ রিপোর্টার : পুলিশ হেফাজতে আসামীর মৃত্যু এবং রিমান্ডের নামে নির্যাতন থেমে নেই। নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ও রিমান্ডের নামে নির্যাতন করে শুধু পঙ্গুই করা হচ্ছে না, নির্যাতন করে হত্যাও করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় ভিকটিমরা সুবিচারও পাচ্ছে না তদন্তকারীদের স্বজনপ্রীতির কারণে। গত তিন বছরে পুলিশি হেফাজতে ২০৫ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি মানবাধিকার ও আইন সহায়তাদানকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ২০৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে। এ সময়ে অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এসব ঘটনায় মাত্র ৪টি হত্যাকা-ের বিষয়ে মামলার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ ‘অগ্রগতি’ হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। অন্যদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন এবং নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা থেকে দায় মুক্তির দাবী করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ নিয়ে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতা-নেত্রী ও আইনজীবীরা।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন হলেও প্রতিকার মেলে না। পুলিশের বিরুদ্ধে করা মামলাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। কারণ, পুলিশের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তভারও পুলিশকেই দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা হয় না। কেবল অতি চাঞ্চল্যকর ঘটনার বেলায় কিছু ক্ষেত্রে পুলিশকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। যেমন রুবেল ও সুজন হত্যা মামলায় এবং ইয়াসমিন ও সীমা ধর্ষণ-হত্যা মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কথিত নির্যাতনে কতজন আহত বা কতজনের অঙ্গহানি ঘটেছে, তারও কোনো তথ্য সংরক্ষণ করছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের দাবি, রিমান্ডে নেওয়া আসামিদের যে ধরনের নির্যাতন করা হয় তার মধ্যে গিটা নির্যাতন, বাদুড় ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, সারা দিন না খাইয়ে রাখা, টানা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন, বোতল ও ডিম থেরাপি, ডিসকো ড্যান্স নির্যাতন, সেলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন উল্লেখযোগ্য। আসামিদের হাত-পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে লাঠিপেটা করার নাম গিটা নির্যাতন। এ নির্যাতনের ফলে হাড়-মাংস থেতলে যায়। তবে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। চিৎ করে মেঝেতে ফেলে হাত-পা বেঁধে মুখে গামছা বা কাপড় ঢুকিয়ে পানি ঢেলে মারধর করাকে বলা হয় ওয়াটার থেরাপি। নাকে-মুখে পানি দিতে থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরে আসামি তথ্য দিতে থাকে। দুটি উঁচু টেবিলের মাঝখানে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানোকে বলা হয় বাদুড় ধোলাই। এ রকমের নির্যাতন করলে আসামি জ্ঞান হারায়। গরম বা প্রচন্ড ঠান্ডা ডিম মলদ্বারে ঢুকিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় ডিম থেরাপি। হাত-পায়ে অবিরাম ইলেকট্রিক শক দেওয়াকে বলা হয় ডিসকো ড্যান্স থেরাপি। হাত-পায়ের নখে মোটা সুই ঢুকানোকে বলা হয় সেলাই নির্যাতন। চোখ-মুখ ও নাকে শুকনো মরিচ লাগানোকে বলা হয় ঝালমুড়ি নির্যাতন। সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় বাতাস নির্যাতন।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ মূলত এসব নির্যাতন করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য এভাবে নির্যাতন করা হয়। টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নির্যাতনের ধরন। আবার প্রভাবশালীদের ইঙ্গিতে বা গ্রেপ্তারকৃত আসামির শত্রুপক্ষের ইশারা ও টাকার প্রভাবেও নির্যাতন করা হয়। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলকে নির্যাতন করা হয়েছিল প্রতিবেশী এক মহিলার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। নিম্ন আদালতের রায়ে তাই-ই প্রমাণিত হয়েছিল। ওই নির্যাতনেই রুবেলের মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন পাস হওয়ার পরে ২০৫ ব্যক্তির পুলিশি হেফাজতে নিহত হওয়া নির্দেশ করে যে আইনের শাসন থমকে আছে। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনায় মামলা দায়ের হওয়া, কিন্তু কোনো বিভাগীয় তদন্ত না হওয়া নিশ্চিত করে, পুলিশ বিভাগ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাকে গুরুত্বহীন মনে করছে। বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ্যে পুলিশি নির্যাতন বিরল দৃশ্য বা কষ্ট-কল্পনা নয়, অথচ তার অধিকাংশই প্রতিকারহীন থাকছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কার্যত দায়মুক্তি ভোগ করে চলেছে। এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
বিশিষ্ট আইনজীবী এবং মানবাধিকার নেত্রী বলেন, আইনী দুর্বলতার কারণে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করেও পুলিশ রেহাই পাচ্ছে। আইনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে যেন তাদের কঠোর জবাবদিহিতা থাকে। জবাবদিহিতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলেই রিমান্ডে নির্যাতনের পর পঙ্গু বা নিহত হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুসরণে শিথিল মনোভাব দেখানো আইনের শাসনের পরিপন্থী। সরকার যদি কোনো কারণে নিজেদের তৈরি করা আইন নিজেরাই সংশোধন বা বাতিলের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা হবে একটি জাতির জন্য লজ্জার বিষয়। মনে রাখা প্রয়োজন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আইন। তাই উভয় আইন অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা বা প্রয়োগ না করা অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিক। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে (রিমান্ড) নিয়ে আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নির্যাতন করা যাবে না।
২০০৩ সালে হাইকোর্ট হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে এ রায় দিয়েছিলেন। গত বছর মে মাসে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আরো কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে উচ্চ আদালতের সে রায় মানছে না পুলিশ। সারা দেশে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেফাজতে নিয়ে হরহামেশা আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এমনকি নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আইনজীবীরা বলছেন, হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতিসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা সংশোধন হলেই নির্যাতন বন্ধ হবে। তবে আইন সংশোধন হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানা বাধ্যতামূলক। না মানলে সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননা হবে।
হেফাজতে নির্যাতন ও আসামির মৃত্যুর ঘটনার যেসব অভিযোগ রয়েছে এর মধ্যে মিরপুর থানায় সুজন ও বরিশালে কালাম হাওলাদারের মৃত্যু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলের নেতারাও দাবি করেছেন, গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের সামনে তারা এসব দাবি করেছেন।
জানা যায়, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও গত বছর অক্টোবরে একটি মোটরসাইকেল চুরির মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে ইমরুল হাসান ইমরান নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় নেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, ইমরানকে রিমান্ডে নিয়ে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। তার জননাঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া হয়। গত বছর ২৯ অক্টোবর বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সংশ্লিষ্ট থানার ওসি আসাদুজ্জামান ও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমীর হামজাকে তলব করে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
২০১৬ সালে ১৫ নভেম্বর প্রতারণার একটি মামলায় মো. রাসেল নামের এক যুবককে আটক করে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, তাকে গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে বেশি নির্যাতন করা হবে না এ কথা বলে রাসেলের স্বজনদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা আদায় করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিরুল। স্বজনরা দাবি করেন, রাসেলের ছোট ভাই সোহেলের মোবাইল ফোনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কথোপকথন রেকর্ড করা আছে।
বরিশালের কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা একটি মামলায় গত বছর ২৪ জুলাই শৈশব নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হেফাজতে শৈশবকে নির্যাতন করে মোবাইল ফোনে তার কণ্ঠ শোনানো হয় স্বজনদের। টাকাও দাবি করা হয়। এ ঘটনায় শৈশবের স্বজনরা অভিযোগ দিলে এসআই মান্নানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে নির্যাতন না করার যে নির্দেশনা আপিল বিভাগের রায়ে এসেছে তা পালন না করলে অবশ্যই আদালত অবমাননা হবে। সুপ্রিম কোর্টে রায় মানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধ্য। এটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। তিনি আরো বলেন, সংবিধানেই বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতের রায় মানতে হবে। আর সুপ্রিম কোর্ট গত বছর যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আইন করা জরুরি। ওই নির্দেশনা মেনে পুলিশ কাজ করলে সাধারণ ও নিরীহ মানুষ নির্যাতনের শিকার হবে না। তবে এ বিষয়ে মনিটরিং থাকতে হবে।
ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী ঢাকার আদালতের আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের পর অনেকেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আবার আদালতে এসে বলেন, তাকে নির্যাতনের মাধ্যমে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এ কারণে ওই জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বর্তমান জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি পরিবর্তন হলে ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে না। নির্যাতনের অভিযোগও উঠবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।