Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দিদের পরিত্যাগ করবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জেরুজালেম পোস্ট : ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় রকম সাফল্য অর্জন করেছে সিরিয়ার কুর্দিরা। এখন তারা উদ্বেগের সাথে তুরস্ক ও রাশিয়ার অবস্থান পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা বলা মুশকিল। সিরিয়া বিষয়ে কোনো চুক্তি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরিত্যাগ করবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সিরিয়ার ৬ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানে নতুন চুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় সিরিয়া সরকার ও বাশার বিরোধী বিদ্রোহীদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের উদ্যোগে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, এ তিন দেশের মধ্যে এক রূপরেখা চুক্তির আওতায় আঞ্চলিক ক্ষমতা প্রভাব ভিত্তিতে সিরিয়া কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক অঞ্চলে বিভক্ত হবে। তবে  এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের ভূমিকা থাকবে না।
তুরস্ক ওয়াইপিজিকে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাইরে রাখার দাবি জানানোর কারণে সিরিয়ার কুর্দিরা উদ্বিগ্ন। তুরস্কের নতুন কৌশলে কুর্দি এলাকাগুলো তার লক্ষ্যবস্তু হবে।
আস্তানায় অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক আলোচনায় সিরিয়ার কুর্দিদের ব্যাপারে রাশিয়া কিছু ঘোষণা করেনি। কিন্তু তুরস্ক সিরিয়ার ভবিষ্যৎবিষয়ক কোনো পরিকল্পনায় কুর্দিদের বাইরে রাখতে দৃঢ়সংকল্প।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আইএসের সর্বশেষ শক্তঘাঁটি ও কার্যত রাজধানী রাক্কা মুক্ত করার অভিযানে কুর্দি যোদ্ধাদের কোনো ভূমিকা না রাখার জন্য তুরস্ক বারবার অনুরোধ করেছে।
আলেপ্পোর ঘটনায় দেখা যায়, তুরস্ক সিরিয়ায় শাসক পরিবর্তনের দাবি ত্যাগ করেছে। তুরস্ক আলেপ্পো থেকে ৪০ কি মি উত্তর পূর্বে আইএস অধিকৃত আল বাব দখলের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। কুর্দি যোদ্ধারা যাতে আফরিন ও কোবানি অঞ্চলের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা প্রতিষ্ঠা না করতে পারে সে জন্য তুরস্ক আল বাবের নিয়ন্ত্রণ চায়।
তুরস্ক যদি আল বাব ছাড়িয়ে আরো অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কি করবে তা বলা মুশকিল।
তুরস্ক আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইকে মানবিজ শহরের নিকটে কুর্দি বাহিনীর ঘাঁটিগুলোর উপর আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করছে বলে কুর্দিরা অভিযোগ জানিয়ে আসছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে কুর্দিরা যাতে সিরিয়ায় আরো ভূ-খ- দখল করতে না পারে সে জন্যই তুরস্ক সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের পরিচালক যোশুয়া ল্যান্ডিস বলেন, মনে হয় কুর্দিরা বাশার ও এরদোগানের মাঝে চাপা পড়বে। তাদের কেউই চান না যে কুর্দিরা স্বাধীন হোক বা তাদের কোনো  সেনাবাহিনী থাকুক।  যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে চায় বলে মনে হয় না, তবে তাদের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখতে ও এ অঞ্চলে পা রাখার জায়গা চায় যা কুর্দিদের সাথে সু সম্পর্ক রাখলে সম্ভব।
তুরস্ক ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কুর্দিদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র কতদূর যাবে? এ এমন এক প্রশ্ন যার জবাব এখন কেউই দিতে পারবে না। দেখতে হবে যে বাশার, তুরস্ক ও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি আলোচনা কীভাবে অগ্রসর হয়।
সিরিয়াতে যতদিন গোলযোগ থাকবে ও সরকার দুর্বল থাকবে কুর্দিরা ততদিন তাদের সরকার ও বৈধতাকে সংহত করবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে বিরোধের অন্যতম প্রধান বিষয় ফেতুল্লাহ গুলেনকে তুরস্কের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করা হলেও আরেকটি বিরোধের বিষয় হল আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কুর্দিদের প্রতি মার্কিন সমর্থন।
যুক্তরাষ্ট্র-কুর্দি রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কুর্দিদের স্মৃতি তিক্ত। যুক্তরাষ্ট্র এক জটিল সময়ে কুর্দিদের পরিত্যাগ করেছিল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ওবামার প্রত্যাহার কুর্দিদেরকে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তায় ফেলে।
সিরিয়ার কুর্দিরা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরােেষ্ট্রর সমর্থন চায় এবং সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক।
কুর্দিরা ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করলে যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি অংশীদারদের সমর্থন দিতে পারে যে ফ্রন্টে পিওয়াইডি ও কেএনসি সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে একসাথে কাজ করবে।
লিয়ন-২ বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষণা পরিচালক এবং ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো ফ্যাবরিস ব্যালানশ মনে করেন, শুরু থেকেই ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সিরিয়ার কুর্দি ও আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ সুস্পষ্ট। তুর্কি সেনাবাহিনী কুর্দিদের উপর হামলা করলে যুক্তরাষট্র তাদের উপর বোমাবর্ষণ করবে না।
ব্যালানশের বিশ^াস যে রাক্কা দখলের লড়াই সিরিয়ার কুর্দিদের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের জন্য আরেকটি সমাধান হচ্ছে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া। যদি তারা রাক্কা দখলে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে তাদেরকে পরিত্যাগ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সিরিয়াকে রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে কুর্দিরা পরিত্যক্ত হবে, কারণ তাদের তখন আর প্রয়োজন পড়বে না।
তুরস্কের হুমকি থেকে তাদের বাঁচার একমাত্র পথ হবে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা। আফরিন অঞ্চলে রাশিয়া ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে এসডিএফের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে পিওয়াইডি নেতৃত্ব এ পথ খোলা রেখেছে।
একজন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও গ্লোবাল রিসার্চ ইন ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স-এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জোনাথান স্পায়ার মনে করেন যে নিরাপদ কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো ধ্বংস হতে পারে না কারণ সেখানে আমেরিকানদের উপস্থিতি রয়েছে।  তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এসডিএফ এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে কার্যকর মিত্র। তাদের পিছনে বিপুল বিনিয়োগ করেছে তারা। সুতরাং যতদিন মার্কিন বিমান শক্তি ও বিশেষ বাহিনী উপস্থিত থাকবে এবং সিরীয় কুর্দিদের সাথে মৈত্রী থাকবে ততদিন কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকা ধ্বংস হবে না। সিরিয়ার কুর্দিদের পরিত্যাগ করা যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদার প্রতি এক মারাত্মক আঘাত হবে।
ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে স্থিতিশীলতার উপাদান হিসেবে সিরীয় কুর্দিরা নয়া মার্কিন প্রশাসনের সাথে কাজ করতে পারে। তুরস্ক বিশ^াসযোগ্য মিত্র নয়। সিরিয়ার যে সব বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে তুরস্ক কাজ করছে তাদের মধ্যে ইসলামপন্থী ও সালাফিরাও রয়েছে, তাদের একটি হলো আল কায়েদার সাথে সংশ্লিষ্ট আহরাফ আল শাম। এটা বলা কোনোমতেই সম্ভব নয় যে যুক্তরাষ্ট্র কি করবে, তবে সিরিয়ার কুর্দি ও তাদের মিত্ররা নয়া মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিষয়টি তুলে ধরবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পো সেইন্ট জারমেইন অ্যান্ড প্যারিস-২ বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের প্রভাষক জুলিয়েন থেরন বলেন, রাশিয়া-তুরস্ক চুক্তিতে কুর্দিদের জন্য সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নেই। আংকারা পরিষ্কারভাবে বলেছে যে তারা ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখে।
আস্তানা বৈঠকে ফল পেতে কুর্দিদের শান্ত রাখা একটি কৌশল হতে পারে। এটা বলা কঠিন যে ট্রাম্প প্রশাসন কুর্দিদের প্রতি কোন নীতি বাস্তবায়ন করবে। হতে পারে যে তিনি মস্কোর হাতে সব কিছু ছেড়ে দেবেন।
সিরিয়ার কুর্দি রাজনীতিকদের জন্য সবচেয়ে ভালো যা হতে পারে তা হচ্ছে তাদের মধ্যকার মতভেদ সাময়িক ভাবে হলেও দূরে সরিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিকভাবে একসাথে কাজ করা ও আলোচনায় অংশ নেয়া। এটাই হচ্ছে আঞ্চলিক চুক্তিতে নিজেদের স্থান নির্ধারণ এবং কুর্দিদের কৌশলগত লক্ষ্য ও জাতীয় দাবি অর্জনের একমাত্র পন্থা আর এটাই মার্কিন প্রশাসনের কাছে প্রমাণ করবে যে সিরিয়ায় মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় কুর্দিরা এক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ