Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পদোন্নতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ সংসদীয় কমিটির

মন্ত্রণালয়ে মাসের পর মাস ফাইল নড়ে না

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পঞ্চায়েত হাবিব : প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপ-সচিব পদে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দেয়ায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি সংক্রান্ত ফাইলসহ বিভিন্ন ফাইল মাসের পর মাস নড়ে না এর কারণও জানতে চেয়েছে কমিটি।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২০তম বৈঠকে কার্যপত্রে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, ১৯তম বৈঠকের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ২য় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ এবং সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। কমিটির বৈঠকে উল্লেখ করা হয় যে, ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য প্রার্থী সংখ্যা ৫ হাজার ৫শ’ ৩৩ জন। তন্মধ্যে বিসিএস-এর বিভিন্ন ক্যাডার পদে কমিশন কর্তৃক ২ হাজার ১শ’ ৭৪ জন প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়েছে। ক্যাডার পদে স্বল্পতার কারণে ৩ হাজার ৩শ’ ৫৯ জন প্রার্থীকে সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি। কমিশন কর্তৃক জারিকৃত বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৩শ’ ৫৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৬শ’ ২৬ জন প্রার্থী অনলাইনে নন-ক্যাডার ১ম ও ২য় শ্রেণির পদের জন্য আবেদন করেছেন। ২ হাজার ৬শ’ ২৬ জন প্রার্থীকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নন-ক্যাডার ১ম ও ২য় শ্রেণির পদে সুপারিশ প্রদানের জন্য সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক সরকারের সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের আধা সরকারি পত্রের মাধ্যমে শূন্য পদের তালিকা প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হতে এ যাবৎ ২ হাজার ৫শ’ ৫৫টি ২য় শ্রেণির শূন্য পদে রিকুইজিশন পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত শূন্য পদের ভিত্তিতে ২য় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ প্রদানের কার্যক্রম কমিশন কর্তৃক দ্রুত শুরু করা হবে।
কমিটির বৈঠকে, সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর হতে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী/উপমন্ত্রী/সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ (সচিব/ অতিরিক্ত সচিব/ যুগ্ম সচিব), বিভাগীয় কমিশনার/ জেলা প্রশাসক/ উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সার্বক্ষণিক সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় আরো ৩ শত গাড়ি ক্রয় বাবদ এ অর্থ-বছরে আরো ১৯৮ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এছাড়া একটি আধুনিক ওয়ার্কশপ ও একটি কেন্দ্রীয় নৌযান ওয়ার্কশপ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বৈঠকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ব্যবহৃত সরকারি গাড়িগুলো সংস্কারের ও উন্নত গাড়ি সরবরাহের সুপারিশ করা হয়।  
কমিটির বৈঠকে সদস্য ও আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী  কমিটিতে লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, পদোন্নতি পাওয়ার আবেদন করে একজন কর্মকর্তা মারা গেছেন। গত ২০১৪ সালে আবেদনকারীর পক্ষে আদালত রায় দেয়। দেয় সময় অতিবাহিত হলেও রায় বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রশাসনে এখনো মাসের পর মাস ফাইল নড়ে না। কি কারণে ফাইল আটকে থাকে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনে সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি সূক্ষ্মভাবে কাজ করছে। আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য কর্তব্য। আইন বলেছে, বিষয়টি এখন আর উপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মোকতাদির চৌধুরী প্রতিবেদনে আরো বলেন, আইনের দৃষ্টিতে আদালতের রায় দিয়েছে। উপরন্তু আইনগতভাবে সঠিক বলেই এ কমিটিও আদালতের রায় বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিল। বিষয়টি বাস্তবায়নে পথে পথে বাধা আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এ নিয়ে কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবে বলে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে অতীতে প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে জানিয়েছে জনপ্রশাসন সচিব কিন্তু তার তালিকা দিতে পারেনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার একান্ত সচিরের নাম পদোন্নতির তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। এমন রহস্যজনক ঘটনা কীভাবে ঘটে তা তদন্ত করলে জানা যাবে। তিনি বলেন, প্রশাসনে অনেক অযোগ্য ব্যক্তিদের  পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আর অনেক যোগ্য ব্যক্তিদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। কি কারণে অনেক যোগ্য কর্মকতা পদোন্নতি-বঞ্চিত হয়েছে বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কমিটির সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী কমিটিকে বলেন, প্রশাসনে ফ্ল্যাডগেট খুলবে কিনা, তবে বিষয়টি অনেক দিন হয়ে গেছে। সরকার আপিল করেনি। উপরন্তু এরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। সম্প্রতি প্রদত্ত কিছু পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও পদোন্নতি-বঞ্চিত হয় আর জামায়াতপন্থীরা পদোন্নতি পায় এটি দুঃখজনক।
কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিফুর রহমান প্রতিবেদনে বলেছেন, প্রশাসনে পদোন্নতির বিষয়টি মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক আছে কিনা, মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক না থাকলে, কীভাবে মূল্যায়ন পদ্ধতিকে সঠিক করা যায় সে ব্যাপারে নজর দেয়ার প্রয়োজন। প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে চাকরিতে নিয়োগের সংখ্যা কম রাখা যায় কিনা সে বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে চিন্তা করতে হবে। সভাপতি বলেন, বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকতারা মেধাভিত্তিতে যাতে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৈঠকে জানান, প্রয়োজন হলে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। এ কমিটির বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম ইসমাত আরা সাদেক প্রতিবেদনে বলেন, এসএসবি’র সুপারিশ তাকে অবহিত করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে কিন্তু সিনিয়র সচিব (কামালা আব্দুল নাসের চৌধুরী) এতদিন কোনো উদ্যোগ নিলে না। অথচ বদলি হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে ফাইলটি উপস্থাপন করে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, প্রশাসনে নিয়োগ পদোন্নতি প্রশিক্ষণ প্রদান মন্ত্রণালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। আর ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফরম মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি বলেন, প্রশাসনে বিভিন্ন ক্যাডারে কর্মকর্তারা মেধাভিত্তিতে যাতে সমান সুযোগ পায় সে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদোন্নতি দেয়াই হচ্ছে কাজ।
দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকার পরও পদোন্নতি না পাওয়ায় প্রশাসনে ক্ষোভ বাড়ছে। প্রশাসনে বড় পদোন্নতির পরও বঞ্চনার কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক কর্মকর্তা। যোগ্যদের তালিকায় থাকার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক পদোন্নতি স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে। এর ফলে প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকা- ব্যাহত হবে।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার কমিটিতে অভিযোগে বলেছেন, দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকার পরও পদোন্নতি না পাওয়ায় প্রশাসনে ক্ষোভ বাড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র সহকারী সচিব প্রশাসন ক্যাডারের ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তার পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালে। ওই ব্যাচের অনেকেই ২০১২ সালে নিয়মিত পদোন্নতিতে উপসচিব হয়েছেন। গত চার বছরে অনেক পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য খোলেনি এই কর্মকর্তার। এবার প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পদে পদোন্নতির মূল ব্যাচ ছিল ২১ ব্যাচ। সে হিসাবে এই কর্মকর্তা তিন ব্যাচ সিনিয়র হলেও পদোন্নতি পাননি। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাই নন, এসএসবি বোর্ডে পদোন্নতির যোগ্য তালিকায় সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে ৭২৯ জন কর্মকর্তার নাম পাঠানো হয়। এর মধ্য ২১তম রেগুলার ব্যাচের ১৬৫ জন কর্মকর্তা, লেফট আউট ৩১০ ও অন্য ক্যাডারে ছিলেন ২৫৪ জন। এর মধ্যে উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২৮ কর্মকর্তা, বঞ্চিত হয়েছেন ৫০১ কর্মকর্তা।
যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির যোগ্য তালিকায় ৫৭০ কর্মকর্তা ছিলেন। রেগুলার ১১তম ব্যাচের ১৬৪ জন ও  লেফট আউট ৪০৬ জন। এদের মধ্যে যুগ্ম সচিব হয়েছেন ১৯৩ জন। ফলে যুগ্ম সচিব পদে ৩৭৭ জন কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য তালিকায় ছিলেন ৫৮৭ কর্মকর্তা। এর মধ্যে রেগুলার ’৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা ১৩০ জন। বাকি ৪৫৭ জন ছিলেন লেফট আউট। তাদের মধ্যে ১৪৮ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ পদে বঞ্চনার মধ্য পড়েছেন ৪৩৯ কর্মকর্তা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব বলেন, আমি যোগ্যদের তালিকায় ছিলাম। কেন যে হলো না বুঝলাম না। আমার ব্যাচমেটদের অনেকেই যুগ্ম সচিব হয়েছেন। ১১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বলেন, আমার ব্যাচের ১৬৪ জন এবারের ফিট লিস্টে ছিলেন। কিন্তু আমার হলো না। গত নভেম্বর মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তিন স্তরে ৫৬৯ কর্মকর্তার পদোন্নতির পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওইদিন সকালে উপসচিব ২২৮ জন, যুগ্ম সচিব ১৯৩ ও অতিরিক্ত সচিব পদে ১৪৮ কর্মকর্তা পদোন্নতি পান। লিয়েনসহ বিদেশে থাকার কারণে ৩৪ জনের আদেশ জারি করা হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ