Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এবিসিদ্দিক  : রাজধানী ঢাকার বাজার থেকে এককেজি চিনি ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থা টিসিবির বাজার তথ্যে দেখানো হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে (২০/১/১৬ থেকে ২০/১/১৭ পর্যন্ত) চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। চিনির দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দাম আরো বাড়তে পারে। কারণ, আন্তর্জাতিকভাবে চিনির চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কমছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) সম্প্রতি যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়, উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বাড়ায় সে দেশটি চিনির সংকটে পড়বে। সংস্থাটি বলেছে, চলতি ২০১৬-১৭ মৌসুমে বিশ^ব্যাপী ৩ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার টন চিনি মজুদ হতে পারে যা গত মৌসুমের চেয়ে ৭২ লাখ টন কম । প্রতিবেশী ভারতে চলতি মৌসুমে ২ কোটি ৩৯ লাখ টন চিনি উৎপাদন হতে পারে যা গত মৌসুমের চেয়ে ৩৬ লাখ টন কম। এখানে উল্লেখ, বাংলাদেশে বেশিরভাগ চিনিই ভারত থেকে আমদানি হয়ে থাকে। আর ভারতের ওপর বাংলাদেশি ভোগ্যপণ্যের বাজার অনেকাংশেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মোট চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ চিনিই আমদানি করতে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলো চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ মেটাতে সক্ষম। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলের সংখ্যা ১৫টি যেগুলো বর্তমানে চালু। এসব চিনিকল যদি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (আখ) পেতো তাহলে মোট চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মেটাতে সক্ষম হতো বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করে। ১৫টি চিনি কলের দৈনিক আখ মাড়াই করার ক্ষমতা ২১ হাজার টনের বেশি। কিন্তু আখ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের জমি আখ চাষের জন্য উপযোগী হলেও চাষিরা এক ফসলের চেয়ে একাধিক ফসল ফলানোর প্রতি ঝুঁকে পড়ায় আখ চাষ হচ্ছে কম। এছাড়া তুলনামূলকভাবে আখের দামও কম। ’৯০-এর দশকে গড়ে আখ চাষ হতো প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে যা গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমে আড়াই লাখ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে আরেক সমস্যা হচ্ছে, চিনি কলগুলোর এলাকায় আখ চাষিরা চিনি কল থেকে সার, বীজ ও কীটনাশক ঋণ সুবিধা নিয়েও আখ উৎপাদন করলেও তা চিনি কলে সরবরাহ না করে পাওয়ারক্রাসারের মাধ্যমে মাড়াই করে গুড় উৎপাদন করে। গুড় ব্যবসায়ীরা চাষিদের এই কাজে বেশি উদ্বুদ্ধ করছে। আরেক সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ব চিনি কলের উৎপাদিত চিনি ভোক্তারা কম ব্যবহার করে বা করতেই চায় না। তাদের বক্তব্য হলো, এই চিনি কিছুটা লাল দেখায়, তাই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মিহিদানার সাদা চকচকের চিনিই তারা বেশি পছন্দ করে। কিন্তু তারা জানে না যে, আমদানিকৃত মিহিদানার চিনি মানবস্বাস্থ্যের জন্য কত ক্ষতিকর। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা পরিষদ আমদানিকৃত মিহিদানার চিনি পরীক্ষা করে দেখেছে, এই চিনি কমপক্ষে ১০টি মারাত্মক রোগের জন্ম দেয়। ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধিও জন্ম দেয় এই চিনি। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, দেহে খনিজ লবণের ভারসাম্য নষ্ট করে, শিশুদের বদমেজাজি, অমনোযোগী ও একরোখা করে, ডায়াবেটিকস-এর ঝুঁকি বাড়ায়, টিস্যুর স্থিতিস্থাপকতা ও কার্যক্রম কমিয়ে দেয়, ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বিশেষ করে স্তন, ওভারি, প্রোস্টেট ও রেকটাম, অভুক্ত অবস্থায় গ্লুকোজ লেভেল বাড়ায়, কপারের অভাব দেখা দেয়, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম শোষণে বাধা দেয়, দৃষ্টিশক্তি কমায়, এসিডিটি তৈরি করে, কম বয়সে বার্ধক্য আনে, এলকোহলিজমের ঝুঁকি বাড়ায়, দাঁত ক্ষয় করে, স্থূল হতে সাহায্য করে, অন্ত্রনালীর প্রদাহ বাড়ায়, গ্যাস্ট্রিক সৃষ্টি করে, অ্যাজমার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে পিত্তথলির পাথর, হƒদরোগ, এপেনডিসাইটিস, অশ্ব, দন্তরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হাড়ক্ষয়, ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা হ্রাস, রক্তে ভিটামিন ই-এর পরিমাণ হ্রাস, গ্রোথ হরমোন হ্রাস, কোলেস্টেরল বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই চিনি। এমতাবস্থায় এই পরিশোধিত চিনি নিয়ে বিশ^ব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ক্যান্সারের যে ১০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার একটি চিনি। এ চিনি নিয়ে ঝক্কিও কম নয়। অনেকের কাছেই চিনি একটি ভীতিকর উপাদান; বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে। তবে এ বিস্তর ঝুঁকির মধ্যেও চিনি খাওয়া পরিশোধিত চিনির জায়গাটি ধীরে ধীরে দখলে নিচ্ছে প্রাকৃতিক স্টিভিয়া। বিশ্ববাজারে এর কদরও বাড়ছে বেশ দ্রুত। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ কোটি মানুষ চিনির বিকল্প হিসেবে স্টিভিয়ার নির্যাস কাজে লাগাচ্ছে। যেসব দেশে আখের চিনি উৎপাদনের ব্যবস্থা নেই, সেসব দেশ বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় (স্বাস্থ্যসম্মত) চিনি উৎপাদন,  ভোক্তার সাধ্যের মধ্যে বাজার দর রাখার জন্যই রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। চিনি আমদানি নির্ভর হওয়ায় মাত্র ৫/৬টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। যার ফলে লাগামহীনভাবে মূল্য বেড়েই চলছে। তাও তারা ভোক্তাদের খাওয়াচ্ছে বিষাক্ত চিনি। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি কলে (প্রধান কার্যালয়সহ) প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক এখন কাজ করছে। এই শিল্প রক্ষা না হলে তারাও পথে বসবে। একসময় ৩০ হাজারের বেশি জনবল ছিল। একাধিক শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং লোকসান বাড়ার ফলে তাদের চাকরি ছাড়তে হয়। জনস্বার্থের কারণেই আজ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প রক্ষা করতে হবে। এর প্রধান দু’টি কারণ হচ্ছে ভোক্তাদের মানসম্পন্ন চিনি খাওয়ানো আর বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই সাথে কর্মসংস্থানের বিষয়টি তো আছেই।  চিনি কলগুলো যে, শুধুমাত্র চিনি উৎপাদন করে তাই নয়, আর কিছু দিক লক্ষ্যণীয়। যেমন- জৈব জ্বালানি হিসাবে মূলত ইথানল ব্যবহার করা হয়। আখের রস বা মোলাসেস (চিটাগুড়) থেকে প্রথমে ইথানল তৈরি করা হয়। এই ইথানল গ্যাসোলিন (পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল) এর সাথে ২০-২৫% হারে মিশ্রিত করে অথবা পুরোটাই সরাসরি ইঞ্জিন চালিত যানবাহনে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ইঞ্জিনের সামান্য কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। গ্যাসোলিনের (পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল) পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে ইথানল ব্যবহার করলে ৯০% কার্বন ডাই-অক্সাইড (গ্রীন হাউজ গ্যাস) নির্সরণ কম হয়। এটি ব্যবহারে ইঞ্জিনের শব্দ কম হয় এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বায়ু দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই, আধুনিক বিশ্বে ইথানলকে টেকসই জৈব জ্বালানির অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। আখ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় যে, আখ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ব্রাজিল তার মোট উৎপাদনের ৫৬% আখ জৈব জ্বালানি (ইথানল) উৎপাদনে ব্যবহার করে এবং প্রতিটি ইঞ্জিন চালিত গাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে ২০-২৫% ইথানল মিশ্রিত গ্যাসোলিন ব্যবহৃত হচ্ছে। সে দেশে সুগার মিলেই গ্যাসোলিনের সাথে ইথানল মিশ্রিত করে তারপর পেট্রোল পাম্পগুলোতে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং জনসাধারণ সেখান থেকেই ফুয়েল (জ্বালানি) হিসেবে ব্যবহার করছে। জ্বালানি নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতের সরকার ২০০৯ সালে জৈব জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সেখানে ২০১৭ সালের মধ্যে ২০% ইথানল মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। চীনেও ২০২০ সালের মধ্যে ১৫% ইথানল মিশ্রিত গ্যাসোলিন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধুমাত্র চীন ও ভারত নয় যেসব দেশে আখ উৎপাদিত হয় যেমন পাকিস্তান, তুরস্ক, ম্যাক্সিকো, থাইল্যান্ড প্রায় সব দেশই এ পথে হাঁটছে।
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন