Inqilab Logo

রোববার, ০৯ জুন ২০২৪, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চাল গরিবদেরই দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমাদের চারপাশের একশ্রেণির নির্লজ্জ মানুষের কা-জ্ঞানহীন ও বিবেকবর্জিত কা-কারখানা দেখলে, কাঁদব না হাসব তা চিন্তা করে পাই না। মনে হয় আমরা যেন এমন এক বোকার স¦র্গে বাস করছি, যেখানে আমাদের বাইরের চাকচিক্যটা এতটাই প্রকট, যা দেখে আমরা ভাবতে পারছি না ভিতরে ভিতরে সব ক্ষেত্রে আমাদের কর্মের মাঝে কতটা আবর্জনা রয়ে গেছে। আমাদের সমাজের একশ্রেণির ভাগ্যবান ভদ্রলোকের ধারণা হচ্ছে, তাদের মত লোকজন ছাড়া অন্যরা সবাই জ্ঞানবুদ্ধিহীন প্রাণী। তাদের বোধের জায়গাটা একেবারেই ভোঁতা। তাদের অর্থাৎ জ্ঞানবুদ্ধিহীন সাধারণ মানুষকে হীনস্বার্থ উদ্ধারকারী ভ্যাগবান ব্যক্তিরা যেভাবে চালাবেন, তারা তেমনি ভাবেই চলবে। কিন্তু তারা জানেন না বাস্তবটা আর আগের অবস্থানে নেই। সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। মানুষ আর আগের মত অসচেতন নয়। সাধারণ মানুষ ঠেলাধাক্কা খেয়ে আগের তুলনায় অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে। মানুষের চৈতন্য এবং বোঝার জায়গাটা এখন আগের মতো ভোঁতা নয়। মানুষ এখন অনেক কিছুর ভালমন্দের বিচার-বিশ্লেষণ করতে শিখেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে বলেই, তার প্রাপ্য অধিকারটুকু নিয়ে চিন্তাভাবনা করে থাকে। খোঁজ-খবর রাখে কখন কে কোথায় সাধারণ মানুষের প্রাপ্তিটাকে নিয়ে যায়। আর যারা ভাগ্যবান অর্থাৎ যারা পরিশ্রম না করেও রাষ্ট্রের সকল সুবিধা নিজেদের করতলগত করে রাখেন, তারা ভাবেন রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার কেবল তাদেরই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কিছুই পাওয়ার অধিকার নেই। ভাগ্যবান ব্যক্তিরা ভাবেন রাষ্ট্র তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যা কিছু দিয়ে থাকে সেই সব সামগ্রীতেও তাদের ভাগ বসাবার অধিকার আছে। তাতে ভদ্রলোক নামধারী ব্যক্তিরা লজ্জাও পান না। আমরা জানি, সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে দুবেলা দুমুঠো মোটা ভাত মুখে দিতে পারে, তার জন্য দশ টাকা কেজিতে চাল দিচ্ছে। যে কার্ড দিয়ে দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল উত্তোলন করতে হয়, সেই কার্ড কেবল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝেই বিলি-বণ্টন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি দশ টাকা কেজি দরের চাল উত্তোলনের কার্ড অনেক গরিব মানুষ পাচ্ছে না। তা পেয়ে গেছে বিত্তবান কিংবা যারা অনেক টাকার মালিক তারাই। এই কার্ড পেয়েছে কোটিপতিরা। কার্ড যারা বিলি-বণ্টন করে থাকেন এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেন না। অনেক সময় আবার দলীয় মনোভাবের কথা ওঠে। বলা হয়ে থাকে, দলের নিবেদিত কর্মী তারা। তাদের কী কার্ড না দিয়ে পারা যায়? হোক না সে বিত্তবান কিংবা ধনী ব্যক্তি। এ ব্যাপারে আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে বহু সংবাদ ছাপানো হয়েছে। অভিযোগ করে বলা হয়েছে, দশ টাকার চাল বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় তা নাকি জনতার হাতে কিংবা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, দশ টাকা কেজি দরের চালের কার্ড এক কোটিপতি ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাটির যশোর অফিস থেকে দেয়া রিপোর্টে মনিরামপুর উপজেলার জলকর রোহিতা গ্রামের বড় ব্যবসায়ী, পাশের উপজেলার কেশবপুরে যার একটি ইটের ভাটা রয়েছে, রোহিতা ইউনিয়নে বড় সার ডিলারদের মধ্যে তিনি একজন, তাছাড়া তার তিন চারটি মাছের ঘের রয়েছে, তিনিও কার্ড পেয়েছেন। তিনি দুইবারে ৬০ কেজি চাল উত্তোলনও করেছেন। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্য মতে, রোহিতা গ্রামের ঐ কোটিপতির নাম রয়েছে দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল পাওয়ার তালিকার ৭৫ নম্বরে।
যদি আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাই তা হলে একটা জিনিস বুঝতে পারি, সরকার যতই চায় না কেন দেশের গরিব মানুষের আয়-উন্নতি বাড়াবে, কার্যক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় নিজ দলেরই কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষের কারণে গরিব মানুষের জন্য করা সরকারের সকল পরিকল্পনা ভ-ুল হয়ে যায়। কথায় বলে, বেড়ায় যদি ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে, তাহলে কৃষক কি দিয়ে খেতের সোনালি ফসল রক্ষা করবে? তাই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচিত হবে, বেড়ায় যাতে খেতের পাকা ফসল ক্ষেতে না পারে সেই ব্যাপারে তৎপর হওয়া। এখানে আর একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, নিজ দলীয় প্রভাবে যখন সরকারের সাধারণ মানুষের জন্য করা সকল পরিকল্পনা ভ-ুল হয়ে যায় তখন নিজ দলের মধ্যেই অব্যবস্থা দেখা দেয়। যে অব্যবস্থা সরকারি দলকে বিরোধী দলের চেয়ারে বসাতে বাধ্য করে। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের তা-ই বলে। যে দল সরকারে থাকে সেই দলে যদি চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তার ফল যেমন সংশ্লিষ্ট দলকে ভোগ করতে হয় তেমনি তা দেশের মানুষকেও চরম অব্যবস্থার মাঝে নিক্ষেপ করে থাকে। আর তখনই দলের ভিতর এবং দলের বাইরের নষ্ট চরিত্রের সুযোগ সন্ধানী লোকেরা তৎপর হয়ে উঠে। তাদের অপতৎপরতার মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি হয়ে থাকে।
মূল কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে একশ্রেনির মানুষ আছেন, তারা এতটাই ক্ষমতাবান যে, তারা চান রাষ্ট্রের যা কিছু সুন্দর তার সবটুকু কেবলই তারাই ভোগ করবেন। কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিয়েও দায়িত্বটুকু পালন করতে চান না। দশ টাকা কেজি মূলের চাল সরকার দিয়েছে যাতে দেশের দরিদ্র মানুষ পেট ভরে খেয়ে দেয়ে তাদের জীবনযাপন করতে পারে। দরিদ্র মানুষের দরিদ্রতার মাঝে এক টুকরো সুখের আলোক রেখা পৌঁছে দেয়ার জন্যই সরকার দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণ করছে। অথচ চাল বিতরণে দুর্নীতি হচ্ছে।
শোনা গেছে, অনেক ডিলারের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে গরিবদের সরকারের দেয়া দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল নিয়ে নয়-ছয় অর্থাৎ লুটপাট করার অপরাধে। দেশবাসী মনে করে, সরকার প্রধানের অবশ্যই সদিচ্ছা রয়েছে দেশের মানুষের ভাল থাকার ব্যাপারে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কিংবা দলীয় লোকেরা যদি নিজেদের লাভের আশায় সরকারের শুভ প্রয়াসকে তছনছ করে দেয়, তাহলে আর মানুষ যাবে কোথায়! এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দেশের দরিদ্র মানুষের দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল বিতরণে যারা লুটপাটে মত্ত আছে (সে সরকারি দলের লোক হলেও) তাদের ছাড় না দেয়া। কেননা আজকে যারা গরিবের চাল নিয়ে লুটপাটে মত্ত তারা বসন্তের কোকিল। সরকার যায় সরকার আসে। তারা কিন্তু সকল সময় সরকারি দলেই থাকে। এই সব বসন্তের কোকিলেরা যে সময় যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলে কোন না কোনভাবে নিজেদের জায়গা করে নেয়। বদনাম হলে সরকারের হবে কিংবা সরকারি দলের হবে। বসন্তের কোকিলদের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা জানে, পরবর্তীতে যে দল ক্ষমতায় আসবে সেই দলেও তারা কোন না কোন ভাবে নিজেদের স্থান করে নেবে। এখন মাঠে ঘাটে অফিস পাড়ায় গেলে দেখা যায়, সবাই যেন সরকারি দলের সদস্য। তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তাদের চেয়ে বড় সরকারি দলের বন্ধু আর কেউ নেই। অথচ এই শ্রেণির লোকেরাই সরকারের বিভিন্ন শুভ কর্মকা-ে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। তারা ক্ষমতার মদমত্ততা দেখিয়ে এমন সব কাজ করে, যার রেশ পরবর্তীতে দলকে টানতে হয়। অনেকেই বলে থাকেন, এই সব বসন্তের কোকিলের সুযোগ দিয়ে থাকেন সরকারি দলেরই সুযোগ সন্ধানী নষ্ট চরিত্রের মানুষেরা। লোভী, সুযোগ সন্ধানী নেতাকর্মীদের দলের ঘানি টানতে হয় না। তারাতো নতুন সরকারি দলে চলে যায়। তাই বলছিলাম, গরিব মানুষকে সরকারের দেয়া দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল কোথায় যায়, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তার খোঁজখবর নিতে হবে। আমরা দেশবাসী কিছুতেই মেনে নেব না সরকারি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ গরিবদের জন্য দেয়া দশ টাকা কেজি মূল্যের চাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলুক। চাল গরিবদেরই দিতে হবে।
লেখক : কবি, গল্পকার, আইনজীবী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন