Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাস ও ইরাক বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে

| প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম সপ্তাহে প্রশাসনের বিভিন্ন নীতির পাশাপাশি সন্ত্রাস বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যে তিনি যে সব বিশেষ গ্রুপকে পরাজিত করতে চান তারা পরাজিত হওয়ার বদলে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে কিনা সে সম্ভাবনা দীর্ঘদিনের বিশ্লেষকদের শংকিত করে তুলেছে। খবর হাফিংটন পোস্ট।  
সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সার্বিকভাবে ট্রাম্পের এ সব নীতি ও বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে টানাপড়েন ও পাল্টা আঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রের গবেষকরা ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে কয়েক বছর ধরে সভ্যতার ব্যাপক সংঘাত সৃষ্টির ব্যাপারে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। তারা উল্লেখ করেন যে নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর এ ধরনের কাঠামো সম্বলিত ঝুঁকি প্রদর্শন করেছে। নেদারল্যান্ডসের হেইগে সন্ত্রাস-দমন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের ফেলো ও ‘আইসিস : দি স্টেট অব টেরর’ গ্রন্থের লেখক জে.এম.বারজার মঙ্গলবার ইমেইলে লেখেন, মুসলিম বিশে^ তুলনামূলকভাবে তাদের স্বল্প সমর্থনের ভিত্তির নাটকীয় বিস্তৃতি সম্ভবত সম্ভব নয়। ইসলামিক স্টেটের মতো একটি গ্রুপের জন্য তারা ১ হাজার লোক সংগ্রহ করতে পারবে না। যদি তারা এক বছর সময়কালে অতিরিক্ত ১০ জন তথাকথিত ‘লোন উলফ’ হামলাকারী সংগ্রহ করতে পারে তাহলে তা হবে তাদের জন্য এক বড় ব্যাপার।
জঙ্গি ইসলামি গ্রুপগুলোর প্রতি অধিকতর কঠোর ও সংঘাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার। কিন্তু তার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম কয়েকদিনে কার্যত মার্কিন সরকার পরিচালনার চেয়ে নির্বাচনী প্রচারণার সময়কালীন বাগাড়ম্বরের প্রতি তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শুক্রবার থেকে ট্রাম্প সে অবস্থার সাথেই জড়িত হয়েছেন যা তার আগের কমান্ডার ইন চিফরা দীর্ঘদিন ধরে পরিহার করেছিলেন।
অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প মৌলবাদী ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দ্বারা তার দুই পূর্বসূরির নজির ভেঙেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ১শ’ কোটি লোকেরও বেশি মানুষের আচরিত ধর্ম ইসলামকে হীন উদ্দেশ্যে বিতর্কিত ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবহারকারী স্বার্থান্বেষী গ্রুপগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। পরদিন তিনি তার বাছাই করা সমর্থক ও সিআইএ স্টাফদের উদ্দেশ্যে বলেন, আগের প্রশাসনগুলোর ইরাক থেকে তেল চুরি করা উচিত ছিল। ট্রাম্প ইরানের বলিষ্ঠ সমর্থনপুষ্ট ইরাকি মিলিশিয়া ও আইএসকে পরাজিত করতে ইরাক সরকারকে সাহায্যের জন্য সেখানে অবস্থানকারী ৫ হাজারেরও বেশি মার্কিন সৈন্যের মধ্যে নতুন করে জোর সংঘাতের আশংকা তৈরি করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো তা করতে পারে।
বুধবার সকালে নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয় যে বুশ প্রশাসনের আমলে প্রধানত মুসলিম সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের আটক রাখা ও নির্যাতনের জন্য সিআইএ’র ব্যবহারকৃত গোপন ‘ব্ল্যাক সাইট’গুলো ট্রাম্প পুনরায় খুলে দেয়ার কথা বিবেচনা করছেন। বুধবার বিকেলে কয়েকটি মুসলিম দেশের উদ্বাস্তু, ভ্রমণকারী ও সম্ভাব্য অভিবাসীর বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
একজন আইএস যোদ্ধা গত গ্রীষ্মে ফরেন এফেয়ারস ম্যাগাজিনের লেখক গবেষকদের বলেন, ট্রাম্প যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে কিছু বলেন, তাতে প্রমাণ হয় যে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে জিহাদিদের লড়াই সঠিক, কারণ পাশ্চাত্য ইসলামের বিরুদ্ধে। এ বছরের গোড়ায় এসোসিয়েটেড প্রেস দেখতে পায় যে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট একটি যোদ্ধা সংগ্রহ ভিডিওতে ট্রাম্পের একটি ফুটেজ ধারণ করা হয়েছে যাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী মুসলিমদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলছেন।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দি স্টাডি অব র‌্যাডিকালাইজেশন-এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো চার্লি উইন্টারের মতে, ট্রাম্পের অভিষেকের আগে যে সব পশ্চিমা নেতাদের মুসলমানদের বিরোধিতা করা উচিত সে রকম ভিডিওতে আইএস দু’বার তার ছবি দেখায়।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর পর্যবেক্ষকরা আশা করেছিলেন যে পদের গাম্ভীর্য তার বাগাড়ম্বর বন্ধ করবে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলেন, প্রথম সপ্তাহটিতে অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট থিংক ট্যাংক-এ সিনিয়র ফেলো এবং সাবেক মার্কিন সেনা অফিসার, এফবিআই ও ওয়েস্ট পয়েন্টে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে দায়িত্ব পালনকারী ক্লিন্ট ওয়াটসের মতে, ইরাক ও সিরিয়ায় দু’বছরেরও বেশি সময় মার্কিন সামরিক অভিযানে দুর্বল হয়ে পড়া সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে ট্রাম্প বারবার আশা দিয়েছেন। তিনি বিশ^াস করেন যে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়ার উস্কানি সৃষ্টির আশায় পাশ্চাত্যে হামলা চালাতে উৎসাহিত বোধ করতে পারে যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এক জয়ের অযোগ্য লড়াইতে টেনে নিতে এবং মুসলিম প্রধান অঞ্চলে স্থানীয় বিরোধে অধিকতর জড়িত গ্রুপগুলোর তুলনায় নিজেদের অনেক বেশী যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারে। ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা লেঃ জেনারেল মাইকেল ফ্লিনের মত ইসলামের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তিদের তার সহযোগী মনোনীত করায় ওয়াটস একে উদ্বেগজনক লক্ষণ বলে আখ্যায়িত করেন।
সাবেক প্রশাসনগুলো সন্ত্রাসের হুমকি বিষয়ে তাদের বাগাড়ম্বরকে ভারসাম্যপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন। ৯/১১-র অব্যবহিত পর সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ অশুভ চক্রের সাথে লড়াইয়ের কথা বলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরাক হামলার প্রথমদিকের যুক্তিগুলো মুসলমানদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করেছিল যে ধর্মীয় ঘৃণা ও তেলের লোভই এর কারণ। ওয়াটস উল্লেখ করেন, সময়ের পরিসরে বুশ প্রশাসন কিছু উচ্চকন্ঠের গলাবাজি বন্ধ করে এটা বোঝার পর যে উগ্রপন্থীরা যা ধর্মের অনুমোদিত বলে প্রচার করে তা ইসলামের মূল ধারানুগ নয়।
দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে ট্রাম্প অনেক কম সঠিক। বারজার লিখেছেন, এখানেই উদ্বেগ, কারণ তা লোকদের মধ্যে শত্রু তৈরি করছে যারা আগে শত্রু ছিল না। তার অর্থ এ নয় যে মুসলমানরা ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরের কারণে আইএস বা আল-কায়েদার সাথে যোগ দিতে ভিড় করছে, কিন্তু তা উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন লাভ ও মিত্র সংগ্রহে আমাদের সক্ষমতাকে জটিল করে তুলছে।
বারজারের মতে, ট্রাম্পের আগ্রাসন মূলক দৃষ্টিভঙ্গি যে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে তার একটি হল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত হতে মুসলিম দেশগুলোকে নিরুৎসাহিত করছে। ইরাক, জর্দান, তুরস্ক, সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইন সকলেই আইএস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের দমনে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, বুশ ও ওবামা প্রশাসন সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন বন্ধ ও ভ্রমণ বন্ধ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সাফল্য লাভ করে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে যদি বন্ধু অংশীদার হিসেবে না দেখা হয় তাহলে এ অর্জন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
কম ধর্মীয় গোঁড়ামি ও গরম কথাবার্তার দিক দিয়ে নয়া প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু মূল্য রয়েছে। কিছু মুসলিম প-িত বিশ^াস করেন এটা বলা সমীচীন যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে যে লড়াই করছে তাদের ব্যাপারে কিছু একটা ইসলামি বিষয় রয়েছে। তারা বলেন, শান্তিপ্রিয় মুসলিম ও তাদের রক্ষাকর্তারা ইসলাম থেকে জঙ্গিদের পৃথক করতে অনেক দূর গিয়েছেন এবং তারা ধর্মের মৌলবাদী ব্যাখ্যার বিপদ সম্পর্কে অধিকতর সততার আবেদন জানান।
দুবাইয়ের আল-মেসবার স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের নারী ফেলো রাশা আল আকিদি বিশ^াস করেন, মৌলবাদী ইসলামি সন্ত্রাস শব্দটির ব্যবহার কার্যত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশে^ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর প্রতি জোরালো অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধকে উৎসাহিত করতে পারে।
ওয়াটস বলেন, আইএসের যোদ্ধা সংগ্রহে সাফল্যের এক প্রধান ভিত্তি খিলাফতের প্রতি আঘাত হেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুপ্রতীম সরকারগুলোকে সমর্থনের মাধ্যমে ট্রাম্প আইএসের ভূখ- নিয়ন্ত্রণ অবসানে তার অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় থেকে মূল্যবান পদক্ষেপ নিতে পারেন।
কিন্তু ক্রমবর্ধমানভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে নয়া প্রেসিডেন্ট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই বা মুসলিমদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আচরণের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় দেবেন না। মসুলের অধিবাসী রাশা আল আকিদি ইরাক বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ইরাকিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রদানে প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের গুঞ্জনের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, এটা তার মত বিশ্লেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধু মনোভাবাপন্ন ইরাকি ও সিরীয়দের তাদের দক্ষতার সেবা প্রদানে সে দেশে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে স্বাধীন করেছে, জয় করেনি। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ