ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোঃ ইসরাফিল হোসাইন : ভাষা মানুষকে দেয়া আল্লাহর অনন্য উপহার। বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী Noah Webster যথার্থই বলেছেন- ‘Language, as well as the faculty of speech, was the immediat gift of god..’ মানুষের আদি স্পন্দন হচ্ছে ভাষা। অন্যভাবে বলা যায়, ভাষা অর্জনের মধ্য দিয়েই শিলান্যাস ঘটেছে মানব সভ্যতার। সময়ের ক্রমিক অগ্রযাতায় সভ্যতা হয়েছে বিবর্তিত। ভাষার পরিবর্তনও থেমে থাকেনি। কালিক রূপান্তর ভাষাকে স্পর্শ, কখনো পুনর্জাত ও পুনর্গঠিত করেছে। ভাষা-সম্পর্কিত ধারণা ও প্রীতিতিই বিচিত্র এবং ব্যক্তি প্রবণতা ও মানবীয় অভিনিবেশ অনুসারে নানামুখী। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ ধারায় ভাষার ভূমিকা তাই প্রত্যক্ষ এবং শক্তিশালী। প্রাচীন কাল থেকেই আধিপত্যবাদী শক্তি জনগণের মুখের ভাষাকে প্রভাবহীন করার প্রচেষ্টা করেছে। তাদের এ বৈরিতা নানা সময়ে প্রবল এবং কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। মানুষের ভাষার লড়াই তাদের ভাষার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। মানুষকে বিভিন্ন যুগে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব, কৃষ্টিক স্বাতন্ত্র্য ও আর্থ-সামাজিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। তাদের এ লড়াই সাম্প্রাতিককালের মতো অতীতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। বাইবেলের জেনেসিস অংশে বর্ণিত হয়েছে-মানুষ Tower of Babel নির্মাণ করলে দেবতা তাদের বর্ধিঞ্চু শক্তিতে ভয় পেয়ে বিভিন্ন মানুষের ভাষা আলাদা করে দিয়েছিলেন, মানুষকে তার নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্যই। বৈদিক সংস্কৃত পুরাণাদিতে দেবতা ও অসুরের লড়াইয়ের কথা আমরা জানি। এ লড়াইয়ের পিছনে ভাষা অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল। বেদের প্রাচীনতম অংশে যারা দেবতাদের সাথে বিরোধ করে তাদের অসুর বলা হয়েছে। অথর্ববেদে এদের দেবতা বিরোধী হিসেবে দেখা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণেও একই কথা আছে। অসুররা (দেবশক্র) পূজা ও যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান ধ্বংস করত। ঐতরেয় আরণ্যকে বয়াংসি বা পক্ষী জাতি, মহাভারতে ম্লেচ্ছ, ভাগবত পুরাণে পাপ; ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দস্যু; বোধায়ণ ধর্ম সূত্রে- সংকীর্ণ যোনায়ঃ বলা হয়েছে। ভবিষ্যপুরাণে আদম (আ.) ও তাঁর পতœী হত্যবতীকে (হাওয়া আ.) ম্লেচ্ছ ধর্মপরায়ণ বলা হয়েছে। আদমের (আ.) বংশধরগণ ভগবতী সরস্বতী দেবীর অভিশাপে ম্লেচ্ছভাষী হয়ে যায় এবং এজন্য এ ভাষাকে মহা অধম ভাষাও বলা হয়। দ্বাপর যুগের শেষ হলেই আর্যভূমি ম্লেচ্ছ দেশে পরিণত হবে এমন কথাও ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে। সর্বোপরি নূহ্ (আ.) থেকে বুদ্ধের আগমন পর্যন্ত আদমের (আ.) বংশধরদের দস্যু, শবর, মিল্ল ও মূর্খ মনুষ্য বলে অভিহিত করা হয়। সে সময়ে চারটি ভাষার (ব্রজভাষা, মহারাষ্ট্র ভাষা, যাবনীভাষা এবং গুর-িকা ভাষা) উৎপত্তি ও তা থেকে চার লাখ ভাষার সৃষ্টির কথাও উল্লেখ আছে।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে একটি গল্প আছে ঃ ঋষি বিশ্বমিত্র একটা ব্রাহ্মণ বালককে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করলে এবং তাকে এক যাজ্ঞস্থল থেকে উদ্ধার করলে বিশ্বমিত্রের পঞ্চাশটি পুত্র চটে যায়। বিশ্বমিত্র তাদের উপর রাগ করে অভিশাপ দেন তাদের সন্তানেরা পৃথিবীর সর্বশেষ প্রান্তে সর্বনিম্ন বর্ণপ্রাপ্ত হয়ে জীবন যাপন করবে। এরাই নাকি শবর, পুলিন্দ, অন্ধ্র, মুতিব, পু-্র-কোমের জন্মদাতা, এরাই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কথিত দস্যু। ভগত পুরাণে কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, যবন, খস, আভীর, ইত্যাদি কোমের লোকদের ‘পাপ’ বলা হয়েছে। বোধায়ণে ধর্মসূত্রে- পাঞ্জাব (আরট্ট) উত্তরবঙ্গ (পু-্র) দক্ষিণ পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ (সৌবীর) পূর্ব বাংলা (বঙ্গ) প্রভৃতি অঞ্চলের লোকদের বলা হয়েছে সংর্কীণ যোনয়ঃ। বলা হয়েছে- এরা আর্য-সংস্কৃতির বাইরের লোক। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ভারতবর্ষে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল আর্যজাতি। আর্যরা মনে করত তারা যেখানে আসেনি সে মাটি অপবিত্র। আর্য মনি বিদেঘের মুখ থেকে নির্গত আগুনে মাটি পুড়ে পবিত্র হলো। বিদেঘ বাংলার সীমানা পর্যন্ত আসলেন। বাংলায় প্রবেশ করতে না পেরে বললেন, ওরা বর্বর পিশাচ্, ভ্রষ্ঠা, অসপৃশ্যা। ভুল করে কেউ বাংলায় আসলে কঠিন প্রায়শ্চিত করতে হতো, যা দিয়ে জাতে ওঠতে হতো। এ বৈরী পরিস্থিতিতে সাহসী জনগণ দেব-ঋষিদের ধর্মের দোহাই আগ্রাহ্য করেন। ফলে জনগণের মুখের ভাষার বিরদ্ধে নিষেধের বাণী উচ্চারিত হয় ‘ন ম্লেচ্ছ ভাষা শিক্ষেত’। লৌকিক ভাষা অগ্রাহ্য, অকথ্য। ব্যঞ্জনের উচ্চারণে কিংবা স্বরের উচ্চারণেও যদি একচুল এদিক ওদিক হয়, তবে আর রক্ষা নেই। তবে আর্যদের এই উন্নাসিক মনোভাব স্থায়ী হয়নি। ব্রাহ্মণরা তাদের সংস্কৃতি আভিজাত্য ভুলে অসুরভাষী অনার্য ব্রাতজনের সাথে সখ্য গড়তে সমন্বয় করার চেষ্টা করলেন। কোনো কোন অনার্যকে জাতে তুললেন বর্ণ-সঙ্করায়ণের ফাঁদে। কারণটা যে এ অঞ্চলের ঐশ্বর্য তা ইতিহাস স্বীকৃত। বাংলা ভাষার উচ্চকিত প্রশংসা করা হলো কবি সন্ধাকর নন্দীর কাব্যে (রামচরিত)। পু-্রনগরীকে ‘বরেন্দ্রীম-ল চুঁড়ামনি এবং বরেন্দ্রীকে বসুধাশিরো’ বলে উল্লেখ করলেন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগেও প্রাচীন পু-্রনগরীর খ্যাতি ছিল। রোমের কবি ভার্জিল বাঙালি বীরদের গাঁথা রচনা করেছেন। ভূগোলবিদ টলেমি ও প্লিনি এবং অজানা গ্রিক নাগিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’-গ্রন্থে তার সাক্ষী বহন করে। সে কারণেই হয়ত আদি বাঙালিদের সম্পর্কে আর্যদের খানিকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের প্রবণতা দেখা গেছে।
ধর্মের দলাদালিতে লৌকিক ভাষায় সাহিত্যে সৃষ্টি পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন নয়। ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পালির উৎপত্তি। ইউরোপের রোমীয় খ্রিস্টান সংঘের সাথে বিবাদে দেশীয় সাহিত্যের পরিপুষ্টি। প্রাচীন ধর্মের সাথে প্রতিযোগিতায় শিখ ধর্মে পাঞ্জাবী সাহিত্যের সৃষ্টি। দেশজ ভাষা-সংস্কৃতির টানে ভাষিক জাতীয়তার পথ ধরে ব্রিটেন থেকে আ্যারল্যান্ডের স্বাধীনতার লড়াই। কানাডায় সংখ্যালঘু ফরাসি ভাষাভাসীর প্রতিবাদী রূপ। ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চেতনায় বাস্কজাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, এশিয়া মহাদেশে ভাষার অধিকার নিয়ে লড়াই একাধিক রাষ্ট্রে মুক্তি-সংগ্রামের সূচনা প্রভৃতি ঘটনাবলী ভাষা তার শক্তিতে জাতিরাষ্ট্র ও জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্নিহিত সংহতি রক্ষারই বহিপ্রকাশ মাত্র।
বাংলা ভাষার জন্মকালে ‘বাংলা ভাষা’ বলা সংগত ছিল না। বরেন্দ্রী এলকোতেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্কুর উদগত হয়। তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলা ভাষার জন্মকালে পু-্র-বরেন্দ্রীতে অসুর জাতির বাসভূমি ছিল। অসুর জাতির ভাষা ‘অসুর বুলি’ হিসেবে পরিচিত এবং ‘অসুর বুলি’ লৌকিক ভাষার অন্তর্গত। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের দ্বারা বাংলা ভাষার আদি গীতি (চর্যাপদ) রচিত হয়। উত্তরবঙ্গের কোন অনার্য জাতির উত্তরাধিকরীদের ভাষাতেই চর্যাপদ লিখিত। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অবশ্য চর্যার ভাষা অনার্যদের বলে স্বীকার করলেও এ ভাষা পশ্চিমবঙ্গের বলে মত দেন। সেন শাসনে চর্যাকারগণ পালিয়ে জীবন বাঁচালেন। সংস্কৃত ভাষা সাহিত্য চর্চার নব দুয়ার উন্মোচিত হলে চর্যা ভাষা চর্চার পথ রুদ্ধ হল।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই এখনেই শেষ হতে পারত। কিন্তু এ লড়াইয়ের স্রোতটা আরো বহুদূর গিয়ে পড়েছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনে গিয়ে ঠেকেছে। আরো একটু বাড়িয়ে বললে বলা যায় এ লড়াই বর্তমানেও অব্যাহত আছে।
হিন্দু সামন্ত পুরোহিত-ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব তান্ত্রিক শ্রেণির কবিরা তের থেকে আঠার শতক পর্যন্ত নিজেদের পরিচয় দিয়ে গেছেন ‘গৌড়িয়া’, ‘গৌড়াই’ বা ‘গৌড়জন’ বলে, বাঙালি বলে নয়। বাঙলা, বাঙালি, বাঙলা ভাষা-ভাষী, বঙ্গ প্রভৃতি তাদের কাছে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত ছিল। হাড়ি ডোমের স্পর্শ হতে ব্রাহ্মণেরা যেমন দূরে থাকেন বঙ্গ-ভাষা তেমনি সুধি সমাজে অপাঙ্ক্তেয় ছিল। ‘প্রিয়ে মুঞ্চময়ী মান মন্দিরাং’ যেখানে ঝংকারিত সেখানে বাংলার স্থান কোথায়? ৭১২ খিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিমের হিন্দু ও মুলতান বিজয় এবং ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলমান আগমন ঘটেছিল। ভাষা হিসেবে আরবি-ফারসির আগমন। ফারসির চর্চার পাশাপাশি বাংলা চর্চার পথ অনেকটা মসৃণ হয়। মুসলিম বিজয়কে বৌদ্ধ ও নি¤œবর্ণের হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্যবাদী নির্মূল অভিজান থেকে মুক্ত হল। দীনেশ চন্দ্র সেন নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন- ‘We are led to believe that when the powerful moslem sovreegns of Bengal granted this recognition to the vernacular literature in thier own courts, Hindu Rajas naturally followed the suit.’ আরবি ফারসি ধর্মশাস্ত্রের ও উপন্যাসের অনুবাদ বাংলায় হতে থাকল; হিন্দু লেখকগণ বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অনুবাদ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবকাব্য, শাক্ত সাহিত্য প্রভৃতির পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষাও চর্চা করতে লাগলেন। কিন্তু এ অন্ত্যজানের মুখের ভাষা যেন হিন্দু-মুসলিম কারোর কাছেই আপন হতে পারল না। বাংলাকে হিন্দুরা বটতলার পুথি বলে অবজ্ঞাভরে পায়ে ঠেললেন। মুসলমানরা সংস্কৃত ঘেষা হিন্দুয়ানী এবং অনভিজাত আতরাফদের ভাষা বলে দূরে ঠেলে আরবি ফারসির দিকে ঝুকলেন। অনেক মুসলমান মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাংলায় রচনাকে বহু পাপ বলে মনে করলেন। মোহাম্মদ জান আরবি কথা বাংলায় রচনা করে ‘সত্তর নবীবধে’র অপরাধের সাথে তুলনা করলেন।
পাঞ্চালির ছন্দ হাতে এগিয়ে এলেন রোসাঙ্গের কবিরা। মুসলমানদের মধ্যে বাংলা প্রেমিক ছিল না তা কিন্তু নয়, আব্দুল হাকিমকে কলম হাতে লড়তে হলো- তিনি লিখলেন ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ তিনি আরো লিখলেন- ‘কার্মদোষে বঙ্গদেশে বাঙালি উপন্ন।’ ব্রিটিশ আগমনে বাংলা ভাষার নতুন ক্রান্তিকাল শুরু হল। লর্ড বেন্টিং ১৮৩৭ সাল রাষ্ট্রভাষা ফারসি রহিত করলেন। ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করে হাজার বছরের ভাষা বিদ্বেষের নয়া চেহারা বর্ণবাদী হিন্দু পন্ডিতদের চেহারায়। জনগণের মুখের ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা বলে প্রচার করতে থাকেন। এ প্রসাদের মুন্শী-মৌলবীরা ফারসি-উর্দুর চর্চা করলেও বাংলা উপেক্ষিত থেকে যায়। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে রাজশিরিবে জন্ম নেওয়া উর্দু শরিফ মুসলমানদের সাহিত্য চর্চার একমাত্র ভাষা হয়ে উঠল। সেখানে বাংলা হয়ে উঠল ‘কুফরি’ ভাষা। ভদ্র সমাজ বলে পরিচিত হতে হলে উর্দু চর্চার বিকল্প কিছু তাদের কাছে মনে হত না। নবাব আব্দুল লাতিফের মত বাঙালিও কোনক্রমেই বাংলাকে মেনে নিতে পারলেন না। সতেরো-আঠারো শতকে শিবাজীর ‘এক ধর্ম এক রাজ্য’ এক সিংহাসন ভারতীয় হিন্দুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মণেতা ব্রহ্মনন্দ কেশবচন্দ্র উক্ত ভাব ধারায় হিন্দি ভাষাকে হিন্দুস্থানের একমাত্র ভাষা করার জন্য সূত্র প্রদান করেন। উক্ত মতের সমর্থনে শ্রীনারায়ণ বসু বৃদ্ধ বয়সে একটি পুস্তিকা লিখে ফেললেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা এম, কে, গান্ধীজী স্বরাজ ভারতে (Home rule)) ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা’ কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন। গুরু উত্তরে জানালেন- ‘ÔThe only possible language for inter provincial inter course is hindu in india.’ ‘অর্থাৎ ভারতের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হওয়ার জন্য একমাত্র সমৃদ্ধ ভাষা হলো হিন্দি।’ প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ্। তিনি ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা’ প্রশ্নে বাংলাকেই অগ্রাধিকার দিলেন। কেবল তাই নয়, বাংলার স্থান এশিয়ার মধ্যে সর্Ÿোচ্চ হবে বলে তিনি অভিমত দিলেন। এ জনপদের মানুষের মুখের ভাষার এ লড়াইকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অভিহিত করেছেন- ‘অভিজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যকার রাজনৈতিক লড়াই রূপে।’ এ লড়াইয়ে উর্দু প্রেমীরা বসে থাকলেন না। তারাও ফন্দি-ফিকির খুুঁজতে থাকলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ২৪ জুলাই মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব মুহূর্তে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণের উর্দুকে ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে আভিমত দিলেন। আবারও প্রতিবাদ করলেন ড. মুহম্মদ শহীল্লাহ্। এবার এটিকে তিনি ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বললেন।’ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙালি সমাজ জাগতে শুরু করল। বাংলা ভাষা বিরোধী নয়া ষড়যন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, বাংলাকে এবার ‘ধর্মভাষা’ উর্দুর বিপক্ষে দাঁড় করালেন। তাঁরা Inferiority complex থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। একটি জাতির সংস্কৃতির ধ্বংস করতে প্রথমে তাদের ভাষার উপর আঘাত আনতে হবে আর্যদের এমন অভিজ্ঞতার পথে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী ধীর পদে চলতে লাগলেন। প্রথম তারা মাতৃভাষা বাংলা রেখে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে জনমতের চেষ্টা চালালেন। করাচীতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব সুপারিশ আকারে গ্রহণের উদ্যোগ নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তা মানলেন না। শুরু হল আন্দোলন। ফুঁসে উঠা আন্দোলনকে স্তিমিত করতে ১৯ মার্চ ১৯৪৮ গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ‘Urdu and Urdu shall be the state language of pakistan’ ঘোষণা করলেন। তাঁর এ বক্তব্য আন্দোলনে ঘৃত ঢালার মতো হল। সর্বস্তরে বাঙালি মাতৃভাষায় কথা বলার দাবি নিয়ে রাজ পথে আসল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নতুন কৌশলের পথ ধরলেন।
শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলাকে ধ্বংসের নতুন উপায় আবিষ্কারের অন্যতম প্রবর্তক ও দার্শনিক। তিনি বাংলাকে আরবি হরফে প্রবর্তনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের এক অদ্ভুত যুক্তি দাঁড় করালেন। যুক্তিটি বাস্তবায়নে এগিয়ে এলেন চট্টগ্রামের মাওলানা জুলফিকার আলী। প্রতিষ্ঠা করলেন হরফুল কুরআন কমিটি। হাবিবুল্লাহ বাহারও এটিকে বিজ্ঞান সম্মত বলে যৌক্তিক পরামর্শ দান করলেন। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গার চেষ্টা ফলপ্রসূ হলো না। ড. মুহম্মদ শহীল্লাহ্ এটিকে জ্ঞানের ¯্রােতধারা রুদ্ধ করবে বলে জোরালো মত দিলেন। এবং এতে পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ধ্বংস হতে পারে বলে অভিমত দিলেন। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ কর্তৃক ফারসি ও উর্দু সমেত সকল ভাষা রোমান হরফের লেখার প্রচেষ্টার মত আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টাও ভেস্তে গেল। ১৯৪৯ সালের ভাষা কমিটির ৯৬ জন আরবি হরফে ১৮ জন রোমান হরফে ও অবশিষ্ট ১৮৭ জন বাংলালিপি বজায় রাখার পক্ষে মত দিলে এ প্রচেষ্টা আপতত নস্যাৎ হয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়া থেকে রক্ষা করে।
বাংলা ভাষার উপর আধিপত্যবাদী শক্তির অদৃশ্য আগ্রাসন আজও অব্যাহত আছে। যে আগ্রাসন বাঙালির কেবল ভাষার ওপর নয়, বাঙালির সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে আঘাত। বাংলা ভাষা রক্ষা মানে বাঙলার মানুষের সংস্কৃতি রক্ষা। সে জন্য প্রয়োজন সর্বত্র বাংলার ব্যবহার, প্রয়োজন সার্বজনীন ভাষানীতির। প্রকৃত পক্ষে একটি আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উপযুক্ত বিকাশের জন্য মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও আধিপত্যবাদী ভাষার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যিক শর্ত।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।