Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংলিশ ‘বাংলিশ’ এবং আমাদের ভাষা চর্চা

প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : আ-ম-রি বাংলা ভাষা। ’৫২ ভাষা আন্দোলনের রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছি। ১৯৯৯ সালে বাংলাভাষা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার’ মর্যাদা পেয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মতো করে ২১ ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস পালন করে। এটা বাংলা ভাষাভাষিদের গর্ব এবং অহংকারের। কিন্তু আমরা মাতৃভাষাকে কতটুকু রপ্ত করতে পেরেছি বা করার চেষ্টা করেছি? শব্দ শৈলীর নামে দেশের স্যাটেলাইট টিভি ও রেডিওগুলোতে যে বিকৃত করে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে; নাটক সিনেমায় যেভাবে বাংলা শব্দের ব্যবহার হচ্ছে তাতে বাংলাভাষার মর্যাদা কোন পর্যায়ে গেছে? বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত চিন্তক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলা ভাষার বিকৃতিকে ‘বাংলিশ’ হিসেবে অবিহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, এটা বিকৃত রুচির খুবই গর্হিত কাজ। আরেক চিন্তাবিদ ইউনিভারসিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, দেশের সম্পদশালী উচ্চবৃত্তের মানুষগুলো বাংলা ভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। দুই অধ্যাপকের বক্তব্যের বাস্তবতা বোঝা যায় যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষার বিকৃতি নিয়ে দুঃখবোধ করেন।
গতকাল বাংলা ভাষাকে বিকৃত না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এমন প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে তাদের শিশুদের-সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে না পড়ালে যেন ইজ্জতই থাকে না! গণমানুষের এই নেত্রীর মুখে বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে। ’৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়ে গেছেন তাদের আমরা স্মরণ করছি; অথচ বাংলা ভাষার বিকৃতি কোন পর্যায়ে গেলে যে দেশের চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে এমন মন্তব্য করতে হয়! তাহলে গর্বের বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে আমাদের চর্চা কোন পর্যায়ে? যে জাতি নিজের ভাষা শুদ্ধ করে শেখার প্রয়োজনবোধ করে না সে জাতির ভবিষ্যৎ কি? শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা এবং কাজ করার কথা সেগুলো কি করছে? আঞ্চলিক ভাষা চর্চার নামে নাটক-সিনেমাগুলোতে যেভাবে বাংলা বিকৃতির প্রতিযোগিতা চলছে তাকে এক সময় বাংলিশ-এ বাংলাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
২১ ফেব্রুয়ারী ইস্যুতে বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়া বিবিসিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে বিশেষ কোন দিবস এলেই সেটিকে ঘিরে ইদানিং অনেক বাণিজ্যিক কার্যক্রম দেখা যায়। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে নানান ফ্যাশন হাউজ ভরে গেছে সাদা কালো রঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবী দিয়ে। অ আ ক খ লেখা পোশাক চালু হয়েছে বেশ ক’বছর হলো। আর মানুষ এখন ঘটা করে সেগুলো পড়ে ফ্যাশন করছে। ওই রিপোর্টে বলা হয় শোক দিবসের বদলে একুশে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে ইদানিং একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন তোলা হয়। একটি শোক দিবসকে ঘিরে বাণিজ্যের গ্রহণযোগ্যতা কতটা? মিডিয়াটি প্রশ্ন তুলেছে শোক দিবসে উৎসব দিবস পালন করা কতটা যৌক্তিক?
এটা ঠিক একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। দেশের ফুল চাষীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। পোশাক ব্যবসায়ীরা ব্যবস্য পাচ্ছেন। কিছু শ্রমিক কাজ পাচ্ছেন। ২১ ফেব্রুয়ারীর শোক দিবস নিয়ে কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লুটছেন; কেউ অন্তর দিয়ে শোক প্রকাশ করছেন। দিবসটি পালনের নামে চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতারা শোক দিবস পালন করতে গিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। কিন্তু বাংলা ভাষা বিকৃতির প্রতিযোগিতার নেপথ্যের রহস্য কি? সেই আশির দশক থেকে যারাই ক্ষমতায় গেছেন তারাই বেশ কয়েকবার সর্বত্র বাংলা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন সাইন বোর্ড বাংলায় লেখার নির্দেশনা দেয়া হয়। এমনকি ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে মহামান্য আদালত বাংলাভাষাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে কমিটি পর্যন্ত গঠন করে দিয়েছেন। এরপর আর জানা যায়নি কমিটি কী কী সুপারিশ তৈরি করল কিংবা ভাষাদূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিল। এর আগে ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুদ্ধ বাংলার প্রয়োগ সম্প্রসারিত করতে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসায় কমিটি গঠন ও বৈঠক করেছেন। অতঃপরের ইতিহাস জানা যায়নি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে প্রচলন কতটা অগ্রসর হয়েছে সে হিসাব পাওয়া যায়নি। কে শোনো কার কথা? মনের ভাব প্রকাশ করতে আমরা যেন সবাই রাজা। যে যেমনভাবে পারি বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করছি। কেউ কেউ যেন পশ্চাত্যের আধুনিক জীবন গড়তে ইংরেজির দিকে ছুটে চলেছি। এতে করে না করতে পারছি শুদ্ধ ইংলিশ চর্চা না শিখতে পারছি মাতৃভাষা বাংলার শুদ্ধতা। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সংবিধানে এভাবেই বাংলা লিপিবদ্ধ হয়েছে। ’৭২ এ রচিত সংবিধানে প্রথম থেকেই অনুচ্ছেদটি অপরিবর্তিত আছে। সংবিধানের আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়। এটি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্কের পরিচায়ক। সংবিধান বলছে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হচ্ছে বাংলা। কাজেই রাষ্ট্রের সব কার্যাবলী বাংলায় পরিচালিত হওয়া স্বাভাবিক। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কৃষক শ্রমিকের আধিক্যের দেশে প্রশাসন যন্ত্রের যাবতীয় বিষয় বাংলায় পরিচালিত হওয়ার কথা। সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমও বাংলায় হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। ব্যাংকে যে কৃষক ঋণ নেন ইংরেজি ফরম ব্যবহারের কারণে তিনি বুঝতে পারেন না কি শর্তে তিনি ঋণ নিচ্ছেন। আদালতে বিচারের রায় ইংরেজিতে লেখায় যারা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত হন তারা শুধু ইংরেজি না বোঝার কারণে কেন তার ফাঁসি হচ্ছে সেটুকুও জানতে পারছেন না। নিজের অপরাধ না বুঝেই তাকে ফাঁসির রশিতে ঝুলতে হয়। অথচ বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি প্রধান অঙ্গ। সংবিধানের অভিভাবক। রাষ্ট্রের কোনো আইন যদি সংবিধান বিরোধী বা পরিপন্থী হয় তা দেখার ও শোধরানোর দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ নাগরিকের শেষ আশ্রয়স্থল। অপ্রিয় হলেও সত্য যে সেই বিচার বিভাগেই বাংলা সবচেয়ে অবহেলিত। শতভাগ বাংলা ভাষাভাষির দেশের বিচার বিভাগের প্রধান ভাষা যেন ইংরেজি। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘে বাংলাকে কিভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার আসনে বসানো হয় তার কাহিনী গতকাল একটি দৈনিকে লিখেছেন মন্ত্রী পরিষদের সাবেক সচিব ড. সাদ’ত হুসেইন। তিনি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এ এইচ কে সাদেকের প্রচেষ্টা এবং ক্যানাডার দুই প্রবাসী বাংলাদেশীর উদ্যোগের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এখন আমরা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর দাবি তুলেছি। কিন্তু নিজেরা কতটুকু ‘বাংলা’য় আছি? রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সাইন বোর্ডের কয়টি বাংলায় লেখা আর কয়টি ইংরেজিতে লেখা? সর্বত্র বাংলা চালু নিয়ে কম ঢোল পেটানো হয়নি। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ সবখানে বাংলা চর্চার কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতেও চলছে ইংরেজির রাজত্ব। বিচারক বাংলাকে ভালোবেসে রায় দিতে আগ্রহী নন। ব্যবসায়ীক স্বার্থে আইনজীবীরাও ইংরেজি চর্চার পেছনেই ছুটছেন। গতকাল প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘অনেক বিচারক বাংলায় বেশ কিছু রায় দিয়েছেন। কিন্তু একজন বিচারককে অনেক সময় দিনে একশ’ মামলার রায় ও আদেশ দিতে হয়। সবগুলো যদি আমরা বাংলাতে দিতে বলি, তাহলে সেটা কষ্টকর হয়ে যাবে’। কিন্তু এ দেশের উচ্চ আদালতে কিছুসংখ্যক বিচারকই ছিলেন যারা বাংলায় রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সে রায় প্রসংশিতও হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ বাংলায় রায় লিখেছেন; যার জন্য এখনো সবার গর্ব করেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের রায় থেকে আমরা পাই সাহিত্যের অসাধারণ উপকরণ। কাজেই বাংলাচর্চা নির্ভর করে ইচ্ছা শক্তির ওপর। ফেব্রুয়ারী এলেই আমাদের মধ্যে ভাষা-আবেগে নতুন করে জোয়ার জাগে। এখন প্রতিদিন গণমাধ্যমগুলো মাতৃভাষা নিয়ে অনেক আলোচনা, নানামত, নানা বিশ্লেষণ, প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। ভাষা বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ বা চর্চা যাই হোক না কেন, সর্বক্ষেত্রে প্রমিত বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বাংলা ভাষা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের এই শঙ্কা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। বাংলাভাষা নিয়ে এতো গর্ব অথচ সেই ভাষা নিয়ে আমাদের অবস্থান কোথায়? ইংলিশ বাংলিশ নয় শুদ্ধ বাংলা ভাষ চর্চাই হোক আমাদের পণ।



 

Show all comments
  • হুমায়ন কবির ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:৪৮ পিএম says : 0
    অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার একদম ঠিক কথা বলেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • আরমান ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:৫৫ পিএম says : 0
    বাংলাকে বাংলিশ মুক্ত করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Biplob ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:৫৬ পিএম says : 0
    ইংলিশ বাংলিশ নয় শুদ্ধ বাংলা ভাষ চর্চাই হোক আমাদের পণ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইংলিশ ‘বাংলিশ’ এবং আমাদের ভাষা চর্চা
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ