Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাহুবল ট্রাজেডি : টক অব দ্য কান্ট্রি আব্দুল আলী বাগাল পরিবার

প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ ফজলুর রহমান, হবিগঞ্জ থেকে : আব্দুল আলী বাগাল। তাকে ঘিরে এলাকার মানুষের রয়েছে এন্তার অভিযোগ। সুন্দ্রাটিকি ও তার আশপাশের এলাকার একাধিক খুন, ডাকাতি, যৌন হয়রানী, বাগান দখলের ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে তার ও পুত্রদের নাম। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ এমন কোন কর্ম নেই যা তারা করেনি, করতে পারে না। সেই বহুঘটনার নেপথ্য নায়ক আব্দুল আলী বাগাল ও তার পুত্র জুয়েল বর্তমানে ৪ শিশু হত্যার অভিযোগে ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে আছে। অপর পুত্র রুবেল তাকে হুকুমদাতা আখ্যা দিয়ে হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।
কে এই আব্দুল আলী বাগাল?
বাহুবল উপজেলার রশিদপুর ও ফয়জাবাদ চা বাগান ঘেঁষা নিভৃত পল্লী গ্রামটির নাম সুন্দ্রাটিকি। বাহুবল সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। এ গ্রামের বেশকিছু সংখ্যক লোক চা, লেবু, আনারস বাগান ইত্যাদিতে শ্রমিক ও মালিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ওই গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের পুত্র আব্দুল আলী জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বহু বছর আগে ফয়জাবাদ চা বাগানে পাহাড়াদার (আঞ্চলিক ভাষায় বাগাল) এর কাজ নেন। দীর্ঘদিন তিনি ওই পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বাগাল’। বর্তমানে তার বড়ছেলে বিলাল মিয়াও একই পেশায় যুক্ত। এ পেশায় যুক্ত থাকার সুবাদে ইতোমধ্যে সে চা বাগানের বেশকিছু ভূমি দখল করে ফল বাগান প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া তার দখলে বাগানের আরো কিছু ধান্য জমিও আছে বলে জানা গেছে। প্রায় ২৫ বছর পূর্বে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে জলিল নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ওই ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল উঠে আব্দুল আলী বাগালের দিকে। প্রায় ২০ বছর আগে রশিদপুর চা বাগানের নাচঘরের পাশ থেকে ভাদেশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতাচ্ছির মিয়ার ভাই মোশাহিদ মিয়ার লাশ উদ্ধার হয়। এ খুনের ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথা প্রচার হয়। পরবর্তীতে উল্লেখিত দুটি খুনের ঘটনায় আপোষ রফার মাধ্যমে বেঁচে যান আব্দুল আলী বাগাল। প্রায় ২২ বছর পূর্বে ফয়জাবাদ হিলসে শ্রীমঙ্গলের শিফার মিয়ার একটি ফল বাগান দখলকে ঘিরে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায়ও তিনি ছিলেন নেতৃত্বে। এ ঘটনায় তাকে কিছুদিন হাজতবাসও করতে হয়েছে। এছাড়াও চা বাগানের গাছ পাচারে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল আলী বাগালের ২য় স্ত্রী হাজেরা বেগম বলেন, বাগান দখলের ঘটনায় তিনি (তার স্বামী) কিছুদিন হাজতবাস করেছেন। কিন্তু অন্য দু’টি মার্ডারে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার স্বামী আব্দুল আলীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, তার স্বামী আপাদামস্তক ভাল মানুষ। ন্যায্য কথা বলে থাকেন তাই তাকে অনেকে পছন্দ করে না।
আব্দুল আলীর পরিবার
আব্দুল আলীর দুই স্ত্রী। ১ম স্ত্রী আমেনা বেগম নিঃসন্তান। ২য় স্ত্রী হাজেরা বেগমের গর্ভজাত ৫ পুত্র ও ২ কন্যা রয়েছে। পুত্ররা যথাক্রমে-বিলাল মিয়া, জয়নাল মিয়া, ফেরদৌস মিয়া, জুয়েল মিয়া ও রুবেল মিয়া। কন্যা খেলা বানু ও নাসিমা বেগম। আব্দুল আলী বাগালের পুত্রদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ইদ্রিছ আলী জানান, বছরখানেক আগে তার বাড়িতে ডাকাতি সংগঠিত হয়েছিল। আব্দুল আলী বাগালের পুত্র বিলাল মিয়া ও তার ভাতিজারা এ ডাকাতি ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। এ ব্যাপারে তিনি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। এছাড়া, গত বছর ৩১ অক্টোবর ছাত্রীদের যৌন হয়রানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের পার্শ্বে অবস্থিত ফয়জাবাদ হাইস্কুলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিল আব্দুল আলী বাগালের পুত্র ওই বিদ্যালয়ের তৎকালীন ১০ শ্রেণীর ছাত্র আলোচিত (৪ শিশু হত্যাকা-ের দায় স্বীকারকারী) রুবেল মিয়া। সে ও তার কয়েক সহযোগি ছাত্রীদের যৌন হয়রানী করতো। এ ব্যাপারে একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাশায়। এ প্রেক্ষিতে তারা স্কুলে হামলা-ভাঙচুর করে এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও শিক্ষকদের কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।
গত ২০১৪ সালে দুর্গাপূজার নবমীর দিন আব্দুল আলী বাগালের এক পুত্রসহ কিছু বখাটে রশিদপুর চা বাগানে পূজানুষ্ঠানে এক চা শ্রমিক নারীকে যৌন হয়রানী করে। এ নিয়ে দশমীর পরদিন চা শ্রমিক ও সুন্দ্রাটিকি গ্রামবাসীর মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় চা শ্রমিকদের বেশ কিছু বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায়ও আব্দুল আলী বাগাল তার পুত্ররা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েত পরিচিতি
প্রায় ৪ হাজার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সুন্দ্রাটিকি গ্রাম। এ গ্রামে প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু আছে। সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে ৯ জন মুরুব্বী রয়েছেন। গোষ্ঠীভিত্তিক এদের নেতৃত্বের পরিধি। গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরুব্বীরা হলেন, (১) মাস্টার আব্দুল খালিক তালুকদার, (২) মধু মিয়া, (৩) নূর আলী ওরপে নূরাই মিয়া, (৪) আব্দুল আলী বাগাল ও আব্দুল মঈন সুমন, (৫) ফরিদ মিয়া ও সেলিম আহমেদ, (৬) টেনু মিয়া, (৭) আব্দুল হাই, (৮) উস্তার মিয়া ও (৯) আকল মিয়া। এদের অনেকেরই পিতা ছিলেন গোষ্ঠীর মুরুব্বী। উল্লেখিত মুরুব্বীদের সর্দার ছিলেন ফরিদ মিয়ার পিতা মৃত আব্দুল লতিফ। তার অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করতেন আব্দুল মঈন সুমনের পিতা মৃত আব্দুর রউফ। বর্তমানেও তাদের উত্তরসুরীরা এ দায়িত্ব পালন করছেন।
গ্রাম্য মাতব্বর আব্দুল আলী বাগাল
সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে আব্দুল আলী বাগাল মূলত একজন মাতব্বর (কৌশলী)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সনদধারী মুরুব্বী নন। তিনি এক সময় ছিলেন মৃত আব্দুর রউফ মুরুব্বীর পাইক (পঞ্চায়েতের লোক)। চতুর, বাকপটু এবং কৌশলী টাইফের মানুষ হিসেবে গ্রাম পঞ্চায়েতে মাতব্বর হিসেবে তার কদর ছিল। আব্দুর রউফ মুরুব্বী মারা যাওয়ার পর রীতি অনুযায়ী ওই গোষ্ঠীর মুরুব্বী হন তারই পুত্র আব্দুল মঈন সুমন। কিন্তু প্রায় জোর করেই এ দায়িত্ব দখল করেন আব্দুল আলী বাগাল। এ নিয়ে তাদের গোষ্ঠীর ভেতরে দ্বন্দ্ব চলমান আছে।
নিজগৃহে পরবাসী আব্দুল আলী বাগাল
সুন্দ্রটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে আব্দুল আলী বাগাল ও তার অনুসারী মূলত নিজগৃহে পরবাসী। নানা বিষয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরুব্বীরা ঐক্যমতে পৌঁছলেও আব্দুল আলী বাগাল একাই থেকে যান ভিন্ন মত ও পথে। ফলে গ্রামের নানা বিরোধ পঞ্চায়েতে শেষ হয়েও হয় না। অনেক বিষয়ই ফের জিইয়ে উঠে।
সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতের হেফাজতে কয়েক একর সরকারি পতিতভূমি রয়েছে। যা গোচারণ ভূমি, খেলার মাঠ ও কবরস্থান হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি উক্ত ভূমি তারা সরকারের নিয়ম মেনে লীজ নিয়েছেন। সম্প্রতি উক্ত ভূমি থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি প্রায় ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। উক্ত টাকা দিয়ে গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় খেলার মাঠে শিরনী করা হয়। ৯ গরু ও ১০ খাসি জবাই করে করা উক্ত শিরনীতে সুন্দ্রাটিকি গ্রামবাসী ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েক গ্রামের লোকজন ভুড়িভোজ করেন। এতে প্রায় ৪ হাজার লোককে আপ্যায়ন করা হয়েছিল বলে গ্রামবাসীর দাবি। এতে ১০ লাখের কাছাকাছি অর্থ খরচ হয়। এ টাকার হিসাব-নিকাশ নিয়ে অন্য মুরুব্বীদের মাথাব্যথা না থাকলেও আব্দুল আলী বাগালের সন্দেহও অবিশ্বাস ছিল। এ নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে তিনি দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সব বিষয় নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্যান্য মুরুব্বীদের সাথে দূরত্ব বাড়ে আব্দুল আলী বাগালের।
বড়ইগাছ নিয়ে বিরোধ
সর্বশেষ, মাস্টার আব্দুল খালিক তালুকদারের পঞ্চায়েতের মৃত মারফত উল্লার পুত্র কদ্দুছ, ফজল ও কাজল গংদের সাথে রইছ উল্লার পুত্র ছায়েদ মিয়া গংদের বাড়ির সীমানার একটি বড়ই গাছকে কেন্দ্র করে বিরোধ বাঁধে। বিরোধটি আপোষ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে দেখা যায় রইছ উল্লা ও তার পুত্ররা নিজ গোষ্ঠীর মুরুব্বী মাস্টার আব্দুল খালিককে মানছে না। তারা পার্শ্ববর্তী গোষ্ঠীর মুরুব্বী আব্দুল আলী বাগালকে তাদের মুরুব্বী দাবি করছে। এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে দুই গোষ্ঠী বা দুই মুরুব্বীর পাইকদের মাঝে। ছোট এ বিরোধটি বড় হয়ে উঠার পেছনে আব্দুল আলী বাগালের হাত আছে বলে অভিযোগ উঠে। এ বিষয়টি সহ অতিত কর্মকা- নিয়ে গ্রামজুড়ে আব্দুল আলী বাগালের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে। এ নিয়ে চরম বিভ্রতকর অবস্থায় পড়েন আব্দুল আলী বাগাল ও তার অনুসারীরা। এ কারণেই উল্লেখিত ৪ শিশু হত্যামিশন সংগঠিত হয়েছে বলেই আলোচিত হচ্ছে এলাকায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাহুবল ট্রাজেডি : টক অব দ্য কান্ট্রি আব্দুল আলী বাগাল পরিবার
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ