বেহাল দশায় সুপ্রিম কোর্ট মেডিকেল সেন্টার
প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম
মালেক মল্লিক : বেহাল দশায় চলছে সুপ্রিম কোর্ট মেডিকেল সেন্টার। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের উভয় বিভাগের ১০০ জন বিচারপতিসহ প্রায় তিন হাজার জনবলের চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছেন মাত্র দুজন চিকিৎসক, একজন নার্স এবং দুজন অফিস সহকারীসহ মোট সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের মধ্যে চিকিৎসক দুজন আবার প্রেষণে কাজ করছেন এই সেন্টারে। এদিকে মেডিকেল সেন্টারে জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য কক্ষ থাকলেও নেই চিকিৎসার সরঞ্জাম। শুধু প্রাথমিক প্রেসক্রিপশনেই চিকিৎসা শেষ করছেন কর্মরত চিকিৎসকরা। এছাড়া মেডিকেল সেন্টারে ওষুধপত্র নেই বললেই চলে। আর তাই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় দীর্ঘ ৩৬ বছর পরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ মেলেনি মেডিকেল সেন্টারের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আদালতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সেন্টারের প্রয়োজন, যাতে করে বিচার অঙ্গনের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাবিবর ফয়েজ ইনকিলাবকে বলেন, মেডিকেল সেন্টারের জনবল বৃদ্ধির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আবেদনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি প্রধান বিচারপতির একান্ত প্রচেষ্টায় অতি দ্রুত সময়ে মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সেন্টারের ব্যবস্থা করা হবে।
সরেজমিনে মেডিকেল সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, সাবেক সড়ক ভবনের নিচতলায় ৬টি রুমে চিকিৎসকসহ সাতজন স্টাফ বিচার অঙ্গনের চিকিৎসাসেবায় কর্মরত। মেডিকেল সেন্টারের নিচতলা রুম হওয়ায় স্টাফদের নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। যেসব ওষুধপত্র রয়েছে সেগুলোও আবার যথাযথ আসবাবপত্র না থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেন্টারে কোনো জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। কর্মচারী-কর্মকর্তা চিকিৎসা নিতে এলে তাদের প্রেসক্রিপশনেই চিকিৎসা শেষ করছেন চিকিৎসকরা। আবার বিচারপতিদের রুমে প্রতি মাসে অন্তত একবার চেকআপ করতে হয়। চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা এখানে প্রেষণে কাজ করছেন। সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিভাগের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাত্র দুজন চিকিৎসক হওয়ায় তাদের পক্ষে যথাযথভাবে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে সেবা প্রদান করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইকোর্ট বিভাগের একজন কর্মচারী জানান, মেডিকেল সেন্টারের এমন ওষুধ রয়েছে যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। তিনি জানান, কয়েক মাস আগে আঙ্গুল কেটে যাওয়ায় সেন্টারে গেলে আমাকে যে স্যাভলন দেয়া হয় তা ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে আমি ঢাকা মেডিকেল গিয়ে চিকিৎসা নেই। যদিও এ ঘটনা শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিদিনই ঘটছে। সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, মেডিকেল সেন্টারের জনবল নিয়োগসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা চালু হলে তাদের অন্যান্য মেডিকেলে গিয়ে সেবা নিতে হতো না। এখান থেকেই চিকিৎসাসেবা নেয়া সম্ভব হতো। তারা অচিরেই এটা পরিপূর্ণভাবে চালু করার দাবি জানান।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির প্রচেষ্টায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর একান্ত উদ্যোগে মূল ভবনে একটি কক্ষে মেডিকেল সেন্টারের যাত্রা শুরু। শুরুতে একজন চিকিৎসক ও একজন নার্স কাজ করত। দীর্ঘ ৩৬ বছর পরেও ২০১৬ সালে এসেও দুজন চিকিৎসক, দুজন মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট ও নার্স একজন, দুজন অফিসার সহকারীসহ চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। এছাড়া একটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এদিকে নামমাত্র জরুরি চিকিৎসা সেন্টারে প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০ জন রোগী প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। মেডিকেল সেন্টারটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। এছাড়াও সেন্টারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন হাইকোর্ট ডেপুটি রেজিস্ট্রার। জানা যায়, শুরু থেকেই সুপ্রিম কোর্ট কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত হয়ে আসছে মেডিকেল সেন্টারটি। এখানে ওষুধ পত্র বাবদ ট্রাস্ট প্রতি বছরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ওষুধ দিয়ে থাকেন বলে জানা যায়। কল্যান ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আজিম উদ্দিন বলেন, বিচারপতিসহ প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু মেডিকেল সেন্টারে পর্যাপ্ত জনবল নেই, যা আছে তা একেবারে অপ্রতুল। ইতোমধ্যে জনবল বৃদ্ধির জন্য আমরা প্রধান বিচারপতি কাছে দাবি জানিয়েছি। তিনি আরো বলেন, বর্তমান আগের চেয়ে চিকিৎসা বর্তমানে সেবা বাড়ছে।
এদিকে আইন মন্ত্রনালয় মেডিকেল সেন্টারের জনবল বৃদ্ধির জন্য চাহিদাপত্র পাঠালেও প্রায় ৩ বছরেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর স্মারক নং ২৩৫৬ মেডিকেল ক্লিনিকের জনবল বৃদ্ধির জন্য একটি চিঠি পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ডেপুটি রেজিস্ট্রার নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টে উভয় বিভাগে ১০০ জন বিচারপতি এবং ২০৪৪জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আদালত চলাকালে সহস্রাধিক আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণ এই কোর্টে এসে থাকেন। আদালতে অঙ্গনে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ক্লিনিক স্থাপনের জন্য ১ জন পরিচালকের অধীনে ২ জন সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ৫ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ৩ জন মেডিকেল অফিসার, ১ জন ডেন্টাল সার্জন, ৩ জন স্টাফ নার্স, ১ জন র্ফামাসিস্ট, ৪ জন মেডিকেল টেকনোজিস্টসহ মোট ৩৩টি পদের নাম উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয় আইন মন্ত্রনালয়ে। প্রায় ১ বছর পর ওই প্রস্তাবনার বিপরীতে মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বর সহকারী সচিব রাশিদা খাতুন স্বাক্ষরিত স্মারকে ১৪টি পদের বেতন স্কেল নিধারণের অর্থ বিভাগের সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-১০.০০.০০০০.১২৬.১৫.০৫৪.১৩.৩০৯৮। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে ২০১৪ সালের ১১ মে ০৫.১৫৪.০১৫.০১.০০.০০৩.৯৯৯ (অংশ-১) (খ--২) নম্বর স্মারক এবং অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগের একই বছর ৩১ আগস্টে এক স্মারকের সুপ্রিম মেডিকেল সেন্টারের জন্য অস্থায়ীভাবে ১৪ টি পদের বেতন স্কেল নিধারণ করা হয়। এতে, ওই সব পদের বেতন স্কেল ধরা হয় জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেড। নোটিশ জারীর পরে ১ বছর ৩ মাস অতিক্রম করলেও এখনো নিয়োগের জন্য জিও জারি করতে পারেনি মন্ত্রনালয়। মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা যায, ১৪টি পদের নিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ অনুমোদন দিয়েছেন। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন এখানো বাকি। মেডিকেল সেন্টারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ফারজানা ইয়াসমীন বলেন, প্রধান বিচারপতির একান্ত উদ্যোগে আদালতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মেডিকেল হেলথ ডাটাবেইজ করার প্রক্রিয়া চলছে। এতে করে বিচারপতিদের বয়স বিবেচনায় এবং বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসাসেবা দ্রুত দেয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ঢাকার সিভিল সার্জনকে দিয়ে একটি কমিটি গঠনপূর্বক উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয় করে মেডিকেল সেন্টারে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।