৭ টাকার ভাড়া এখন ৪৫ টাকা যাত্রীদের ক্ষোভ-হতাশা
রেলওয়ের ভাড়া বৃদ্ধি
প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম
নূরুল ইসলাম : কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। সময় লাগে ২৫ মিনিট। দূরত্ব হিসাবে ট্রেনের ভাড়া হওয়ার কথা ৭ টাকা ২ পয়সা। ২০১২ সালে বৃদ্ধির আগে এই গন্তব্যের ভাড়া ছিল ৬ টাকা ৪৮ পয়সা। ২০১২ সালে নির্ধারিত সর্বনি¤œ ভাড়া হিসেবে যাত্রীদের কাছে থেকে আদায় করা হচ্ছে ৩৫ টাকা। গত শনিবার থেকে সেই ভাড়া আরও ১০ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। স্বল্প দূরত্বে এই বাড়তি ভাড়া নিয়ে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ। গতকাল রোববার কমলাপুর রেল স্টেশনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগ যাত্রীই স্বল্প দূরত্বের ভাড়া নিয়ে রেলকর্মীদের সাথে বচসায় লিপ্ত হচ্ছেন। কম্পিউটারে ছাপানো টিকেটে নয় বাড়তি এই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে সীল মেরে। এটা নিয়েও যাত্রীদের যতো আপত্তি। কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, আগে থেকেই যদি নির্ধারণ করা হবে তবে কম্পিউটার প্রোগ্রামে তা ঢুকানো হলো না কেন? বেশ কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, গত চার বছরের মধ্যে দুইবার ভাড়া বাড়ানো হলেও রেলওয়ের সেবার মান একবিন্দুও বাড়েনি। ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’ অর্ধশত বছরের এই প্রবাদ এখনও টিকে আছে রেলে। সপ্তাহের ৫ দিনই ট্রেনের সিডিউল ভেঙ্গে পড়ে। যাত্রীদেরকে প্লাটফরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিশ্রামাগার নেই, টয়লেট নেই, মানসম্পন্ন খাবারের দোকান নেই, হকারদের উৎপাতসহ ট্রেন মানে আরও কতো যন্ত্রনা। এগুলো ছাড়াও লক্কর-ঝক্কর বগি দিয়ে চলছে ট্রেন। সুলভ শ্রেণিতো আছেই প্রথম শ্রেণির যাত্রীরাও ছারপোকার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।
লোকসান কমাতে রেলওয়েতে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বর্ধিত যাত্রী ভাড়া কার্যকর হয়েছে গত শনিবার থেকে। এর আগে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নির্ধারিত ছিল ৩৬ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে কিলোমিটারে প্রতি ৩৯ পয়সা। কাগজে কলমে এই হিসাব দেখানো হলেও বাস্তবের সাথে অনেকটাই অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছেন যাত্রীরা। কয়েকজন যাত্রী কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের ভাড়াকেই এর উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করালেন। তাদের মতে, ব্যস্ত ঢাকা শহরের ভয়াবহ যানজট এড়াতে গাজীপুর, উত্তরা ও আশপাশের এলাকার মতিঝিলগামী যাত্রীদের অনেকেরই ট্রেন হচ্ছে প্রথম পছন্দের। এই সুযোগ নিয়ে ২০১২ সালে এই দূরত্বে রেল কর্তৃপক্ষ ভাড়া বাড়িয়েছে আগের তুলনায় সাড়ে পাঁচগুণ। এবারে তা আরও বাড়ানো হয়েছে যার সঙ্গে সরকারী হিসেবের কোনও মিল নেই। যাত্রীরা মনে করছেন, স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের বেলায় বাড়তি এই ভাড়া ট্রেনের যাত্রীদেরকে সড়কপথের দিকে ঠেলে দিবে। সড়কপথে মতিঝিল থেকে বিমানবন্দর বা উত্তরার ভাড়া ২৫ টাকার বেশি নয়। এ বিষয়ে রেলওয়ের বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, ইচ্ছা করেই স্বল্প দূরত্বে ট্রেনের ভাড়া অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ স্বল্প দূরত্বের ট্রেনের যাত্রীরা টিকেট কাটতে চায় না। এ ছাড়া ট্রেনে ও স্টেশনে দায়িত্বে থাকা রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংকটে বিনা টিকেটের যাত্রীদেরকে নজরদারি করার সুযোগও হয়ে ওঠে না। বরং কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বিনা টিকেটের যাত্রীদেরকে ধরে যা পান তা নিজ পকেটে ভরেন। এতে করে তাদের কাছে থেকে খুব একটা রাজস্ব আসে না।
তাই বলে বেশি দূরত্বের যাত্রীরা যে সবাই টিকেট কেটি ভ্রমণ করেন তা কিন্তু নয়। গত সপ্তাহেও ঢাকা থেকে দিনাজপুর রুটে ট্রেন ভ্রমণ করে দেখা গেছে খোদ কমলাপুর স্টেশন থেকেই বিনা টিকেটের যাত্রীদেরকে প্রথম শ্রেণিতে তোলা হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রংপুর এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণির কেবিনের ২৪,২৫,২৬,২৭ নম্বর সিটের উপরের অংশে বাড়তি একজন যাত্রীকে তোলা হয়। বিনা টিকেটের ওই যাত্রীকে নিয়ে আপত্তি তোলেন একজন যাত্রী। এক পর্যায়ে পরিচালক (গার্ড) জানান, ওই যাত্রী শুয়ে গেলে কারো অসুবিধা হবে না। তাতেও যাত্রীরা না মানলে পরে তাকে অন্য কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু ওই যাত্রী নয়, ওই দিন প্রথম শ্রেণির সবকটি কেবিন বিনা টিকেটের যাত্রী ছিল। তাদের একজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য টিকেট কাটলে তার ৬৭০ টাকা লাগতো। সেখানে তিনি ৪শ’ টাকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ট্রেনের এটেনডেন্টকে ম্যানেজ করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেসে ফেরার সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে। সেদিন দ্রুতযান ছিল ৯ ঘণ্টা লেট। এতে করে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। প্রথম শ্রেণির কেবিনগুলো ছিল ফাঁকা। এই সুযোগে গার্ড ও এটেনডেন্ট মিলে শোভন শ্রেণির যাত্রীদেরকে প্রথম শ্রেণির কেবিনে তুলতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে কর্তব্যরত গার্ড বলেন, আরে ভাই সবারইতো যেতে হবে। ট্রেনতো ফাঁকাই যাচ্ছে, ওনারা গেলে অসুবিধা কি। বেশি দূরত্বের ভাড়া কমিয়ে যাত্রীদের সেবার মান ঠিক রাখা নিয়ে তাই সংশয় থেকেই যায়।
এদিকে, নতুন করে বর্ধিত ভাড়ায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের শোভন শ্রেণির ভাড়া ২৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৮৫ টাকা, শোভন চেয়ার ৩২০ থেকে ৩৪৫, এসি চেয়ার ৬১০ থেকে ৬৫৬ টাকা হয়েছে। ঢাকা-খুলনা শোভন শ্রেণির ভাড়া ৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২০ টাকা, শোভন চেয়ার ৪৬৫ টাকা থেকে ৫০৫ টাকা, এসি চেয়ার ৮৯১ টাকা থেকে ৯৬১ টাকা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা-বিমানবন্দরসহ কাছের স্টেশনগুলোর ভাড়া কম হলে কর্মজীবী মানুষ ঢাকার বাইরে থাকতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু আমলারা সেটা না করে যাত্রী ভাড়া কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে কর্মজীবী মানুষ ঢাকার ভেতরই থাকতে চাইবেন। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময় ছাড়া ট্রেনে যাতায়াত করা যায় না। আর বাসে চড়া যায় যে কোনও সময়। বাস ও ট্রেনের ভাড়া সমান হলে মানুষ বাসের দিকে বেশি ঝুঁকবে এটাই স্বাভাবিক। কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যাত্রীপ্রতি ভাড়া ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে প্রতিদিন ১৩০টি ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা ট্রেন সময় মতো ছাড়া সম্ভব হয় না।