Inqilab Logo

রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভ্রমণ ছাড়াই বিমান ভাড়া নেন এমপিরা

বর্তমান সংসদের ২১৫ অষ্টম সংসদের ১৭০ ও নবম সংসদের ২১৬ জন ভাতা নিয়েছেন

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পঞ্চায়েত হাবিব : এমপিরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়িতে চলাচল করেন। নিজ এলাকা থেকে ঢাকায় যাতায়াত করেন। অথচ অনেকেই জাতীয় সংসদ থেকে বিমানে ভ্রমণের বিল নিচ্ছেন। চলমান দশম জাতীয় সংসদের সরকারি ও বিরোধীদলীয় ২১৫ জন এমপি এরকম বিমান ভাড়া নিয়েছেন। এদও অধিকাংশ বিমানে না গিয়ে ভাড়া তোলেন। তবে ব্যতিক্রম ৭৭ জন এমপি, যারা ভ্রমণ ভাতা নিচ্ছেন না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর ভ্রমণ ছাড়া বিমান ভাড়া না নেয়ার নির্দেশনা আছে। বর্তমান সংসদ ছাড়াও অষ্টম জাতীয় সংসদের ১৭০ জন, নবম জাতীয় সংসদের ২১৬ জন এমপি গাড়িতে যাতায়াত করলেও বিমান ভাড়া নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু বিমান ভাড়াই নয় এমপিদের সব কাজেরই জবাবদিহীতা থাকা দরকার।
অষ্টম জাতীয় সংসদে এমপিদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ী আমদানি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় (বর্তমানে সরকারি দল) এমপিরা। সে সময় তারা এমপিদের নামে বরাদ্দকৃত বিমান ভাড়া কমানোরও দাবি করেছিলেন। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, ৮ বছর আগে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় এমপিদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি ও বিমান ভাড়া বরাদ্দ দেয়া হয়।
জাতীয় সংসদের এমপিদের ভ্রমণ ভাতা বিলের নিয়মে বলা হয়েছে, ‘সড়ক পথে প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা হারে দেয়া হবে। বিভিন্ন ধরনের ভ্রমণ এবং ভ্রমণ বিরতি একই রেখায় লিখিত হবে না। যে কোন একটি ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতকৃত বিলে এক কিলোমিটারর ভগ্নাংশের জন্য ভাড়ার দাবি করা যাবে না। ইচ্ছা করলে ভ্রমণ ভাড়া বিল কোন ব্যাঙ্কার বা এজেন্টের মাধ্যমে জমা দিয়ে উক্ত ব্যাঙ্কার বা এজেন্টের কাছ থেকে উসুল প্রাপ্তির জন্য পেশ করা যেতে পারে। এর ফলে সশরীরে সদস্যকে বা তার বাহককে বা তার বাহকের উপস্থিত হতে হবে না।’
বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু আছে দেশের কয়েকটি স্থানে। এ কারণে এমপিরা ইচ্ছা করলেও বিমানে ভ্রমণ করতে পানে না। ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আমদানির সুযোগ থাকায় এমপিরা সাধারণত বিলাসবহুল গাড়িতেই যাতায়াত করেন। বিমানে ভ্রমণ না করেও অনেকেই বিমান বাড়া নিচ্ছেন জাতীয় সংসদ থেকে।
সাবেক স্পিকার ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থানীয় কমিটি এবং বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক দফায় দফায় আপত্তি দেয়ার পরও বিমান ভাড়ার টাকা তুলে নিচ্ছেন এমপিরা। এ কাজে এমপিদের সহায়তা করছে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা। তবে ভ্রমণ না করে বিমান ভাড়া নেয়ার তালিকায় নেই স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারসহ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, বর্তমান সংসদের প্রায় সকল এমপি বিমান বাড়ার সুবিধা নিচ্ছেন। এরা আগের সংসদগুলোতে সাবেক এমপিরাও এভাবে বিমান ভাড়ার টাকা নিয়েছেন। অষ্টম সংসদে সাবেক বিরোধীদলীয় উপনেতা বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এ বিষয়ে অডিটে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পরে নবম সংসদে বাতিল না করে একই নিয়ম চালু রাখা হয়। ওই নিয়মে এক লাখ টাকা নেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। জাতীয় সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান জাতীয় সংসদে ৩৫০ জন এমপির মধ্যে ২১৪ জন ব্যবসায়ী ও ৪৮ জন আইনজীবী। আর রাজনীতিবীদ রয়েছেন ২২ জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলে ৬ জন এমপি আছেন। এসব এমপি জাতীয় সংসদের অধিবেশন, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে যোগ দিতে নির্বাচনী এলাকা থেকে আসা ও যাওয়ার জন্য এ বিমানের টিকিট ভাড়া জাতীয় সংসদ থেকে নিয়ে থাকেন।
সংসদের নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষণ অডিট ইউনিট ও বিমান হিসাব শাখা সূত্র জানায়, বিমান ও এয়ারের ভাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম নরমাল ক্লাস টিকেদের দাম ৩ হাজার ৪শ’ টাকা। বিজনেস ক্লাস ৭ হাজার ৬৭৫ টাকা। একজন এমপি যাতায়াত বাবদ এই ভাড়ার বিপরীতে বিল নিচ্ছেন ২৩ হাজার ৬৭৫ টাকা। এমনিভাবে সিলেট টু ঢাকা ১৩ হাজার, কক্সবাজার-ঢাকা ১৯ হাজার টাকা,  সৈয়দপুর টু ঢাকা ১৩ হাজার, রাজশাহী টু ঢাকা ১৩ হাজার, যশোর টু ঢাকা ১৩ হাজার, বরিশাল টু ঢাকা সাড়ে ১১ হাজার টাকা বিল নিচ্ছেন এমপিরা।    
বিমান হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, অষ্টম জাতীয় সংসদে বিমানের টিকিটের ঢাকা নিয়েছেন ১৭০ জন, নবম জাতীয় সংসদে ২১৬ জন এবং দশম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশন পর্যন্ত ২১৫ জন এমপি বিমানের ভ্রমণ ভাড়া নিয়েছেন।
সংসদের অডিট ইউনিট শাখা সূত্রে জানায়, একজন এমপি নির্ধারিত ১০টি অর্থনৈতিক কোডের বিপরীতে মাসিক পারিতোষিক ও ভাতা পান ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মাসের পারিতোষিক ৫৫ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকার ভাতা ১২ হাজার ৫০০ টাকা, নির্বাচনী এলাকার অফিস পরিচালনার ভাতা ১৫ হাজার টাকা, আপ্যায়ন ভাতা ৫ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭০০ টাকা, টেলিফোন ভাতা ৭৮০০ টাকা, ধোলাই ভাতা ১৫০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ভাতা ৭০ হাজার টাকা এবং যানবাহন ভাতা (ঢাকায় চলাচলের জন্য) ৬ হাজার টাকা। এর মধ্য থেকে যারা এমপি হোস্টেলে থাকেন তাদের ফ্ল্যাট ভাড়া বাবদ কাটা হয় ৪০০০ টাকা। এ ছাড়া সংসদীয় কমিটির সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য এমপিরা সম্মানী ভাতা পান ৫ হাজার টাকা। সভার আগের দুই দিন ও পরের দুই দিনের জন্য কমিটি ভাতা পান ৮২৫ টাকা হারে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। কমিটি সভায় যোগদানের জন্য পান বিমানের টিকিটের দেড়গুণ ভ্রমণ ভাতা। এর বাইরেও ভ্রমণ ভাতা পান এমপিরা। অধিবেশনে হাজিরা দেয়ার ক্ষেত্রে এমপিদের উদাসীনতা নতুন কিছু নয়। স্থায়ী কমিটির সভাগুলোতে এমপিদের গড় হাজিরার বিষয়টি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে। কমিটির সদস্য হিসেবে প্রতি সভায় হাজিরার জন্য সম্মানী, কমিটি ভাতার পাশাপাশি বিমানের টিকিট দিয়েও সংসদীয় কমিটির সভায় পাওয়া যায় না এমপিদের। এ নিয়ে একাধিক কমিটির সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে সংসদ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জাতীয় সংসদের হুইপ গাইবান্ধা আসনের সংসদ সদস্য মোছা: মাহাবুব আরা বেগম গিনি ইনকিলাবকে বলেন, যখন সংসদে জরুরী কিছু বৈঠক থাকে তখন আমি বিমানে আসি। তার আগে নয়। তিনি বলেন, যতক্ষণে আমি গাইবান্ধা থেকে সৈয়দপুর বিমানবন্দর পর্যন্ত যাবো ততোক্ষণে আমি গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছে যাবো। একারণে সব সময় বিমানে যাওয়া হয় না।
বরিশাল-৩ আসনের এমপি টিপু সুলতান বলেন, আমার এলাকায় সপ্তাহে দুইদিন বিমান চলাচল করে। অনেক সময় সময়মতো বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। সে কারণে বিমানে ঢাকা যাওয়া হয় না। আমি শুধু দুইবার বিমানে চলাচল করেছি। একবার গেছি চট্টগ্রামে আর একবার রাজশাহী। ভোলা-২ আসনের এমপি আলী আজম বলেন, আমি বেশিরভাগেই বিমানে চলাচল করি। ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে আসি। বরিশাল থেকে আবার স্টীমারেও আসি। ভ্রমণ বিলে যা আসে তার সবই পাই। বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান (রিমন) বলেন, আমি বেশিরভাই সময় লঞ্চে চলাচল করি। এ কারণে বিমানে কম চড়ি। মাঝে মাঝে বেসরকারি এয়ারে চলাচল করি। তিনি বলেন, বিমানের ভ্রমণ বিল সংসদ থেকে নেই। সাতক্ষীরা-২ আসনের এমপি মোস্তাক আহমেদ (রবি) বলেন, যশোর হয়ে আমি সব সময় বিমানে চলাচল করি। তবে টিকেট না পেলে তা আর সম্ভব হয় না।
এমপিদের বিমানে চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ ইনকিলাবকে বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। বিষয়টি আমি বলতে পারবো না। আপনাকে আমাদের বিমান বন্দরের হিসাব শাখায় যেতে হবে। এ বিষয়ে সংসদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর একান্ত সচিব এম এ কামাল বিল্লাহ বলেন, কোনো মন্তব্য করবেন না স্পিকার স্যার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় সরকারের ও সংসদের কর্মকা- নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করছে না। এমপিদের বিমান ভাতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব নিয়মের মধ্যে আনা প্রয়োজন, যাতে করে কেউ সরকারি অর্থ বেশি নিতে না পারে। এমপিদের ভ্রমণ ব্যয় কমানো উচিত মন্তব্য করে ড. ইফতেখার বলেন, এমপিদের প্রতিটি কাজে জবাবদিহীতা থাকার দরকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ