Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

২০১৬ সাল ছিল বিশে^র ইতিহাসে উষ্ণতম বছর

| প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি নিউইয়র্ক টাইমস : পরিবর্তনশীল পৃথিবীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করে বিজ্ঞানীরা খবর দিয়েছেন যে, ২০১৬ সাল ছিল বিশে^র ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উষ্ণ বছর। তার মানে ২০১৬ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রার সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর ২০১৫ সালের তাপমাত্রা তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের রেকর্ডকে ছাড়ায়। আবার ২০১৪ সালের তাপমাত্রা তার আগের বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে। আধুনিককালে বৈশি^ক উষ্ণতার তথ্যে এই প্রথম বারের মতো পর পর তিন বছরের উষ্ণতা আগের বছরের রেকর্ড অতিক্রম করল।  
আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের দু’দিন আগে এ তথ্য জানা গেল যিনি বৈশি^ক উষ্ণতাকে চীনা ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু তাই নয়, তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট তাপ-ফাঁদে আটকানো গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাসের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাও তিনি বাতিল করার শপথ ব্যক্ত করেছেন।  
বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। তা এমন পর্যায়ে যা গুরুতর বৈজ্ঞানিক বিতর্কের অনেক বাইরে, তবে এমন যা তাপমাত্রা কমতে থাকলে অধিকতর পরিলক্ষিত হয়। তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে বহু বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে তা প্রাকৃতিক জগত এবং মানব সভ্যতার প্রতি গুরুতর হুমকি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এল নিনো নামে আবহাওয়ার ধরনের কারণে গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই এল নিনোতে প্রশান্ত মহাসগর বায়ুম-লে শক্তি ও জলীয় বাষ্পের ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে। তবে  তাপমাত্রার রেকর্ড স্থাপনের বড় কারণ হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির দীর্ঘকালীন প্রবণতা যা ক্রমবর্ধমান কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাসের দ্বারা চালিত হচ্ছে।
ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনস্ট্রেশনের (এন ও এ এ) বৈশি^ক জলবায়ু মনিটরিং প্রধান ডিকি আরনডট বলেন, একটি একক উষ্ণ বছর আগ্রহ উদ্দীপক। এটা হচ্ছে আসলে প্রবণতা এবং আসলে আমরা এখন প্রতি বছর সর্বোচ্চ সীমায় আঘাত করছি। এটাই হচ্ছে প্রকৃত প্রদর্শক যে আমরা বিরাট পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।   
আর্কটিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটেছে ব্যাপক মাত্রায়। আর্কটিক মহাসাগরের বিশাল এলাকা জুড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ছিল ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি উপরে। এ অঞ্চলে সামুদ্রিক বরফ ব্যাপকভাবে গলেছে। আর্কটিকের জনসম্প্রদায় ইতোমধ্যে বিপুল সমস্যার সাথে লড়াই করছে যার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত উপকূলীয় ভাঙন।
বৈশি^ক তাপমাত্রা মনিটরকারী নাসা’র একটি ইউনিট ম্যানহাটানের গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের প্রধান গ্যাভিন এ, স্মিট বলেন, আর্কটিকে যা ঘটছে তা আসলেই দৃষ্টি আকর্ষক।
তবে আর্কটিকে উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধু সেখানকার লোকরাই অনুভব করছে তা নয়। খরা ও অনাহার আফ্রিকাকে দুর্দশাগ্রস্ত করেছে। এ বছর ১৯ মে ভারতের ফালোদি শহরের লোকেরা ইতিহাসের সবচেয়ে গরম দিনটি পার করে। এদিন তাপমাত্রা ছিল ১২৩.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এল নিনোর এখন অবসান ঘটেছে। বিশ^ব্যাপী জলবায়ু বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে, ২০১৭ সাল আগের বছরের চেয়ে শীতল হবে। কিন্তু তাপপ্রবাহের মাত্রা বিশেষজ্ঞদের অনেককেই বিস্ময়গ্রস্ত করেছে। তাদের কারো কারো আশংকা যে আগামী কয়েক বছর বিশ^ তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।  
বর্তমান তাপমাত্রায় বিলিয়ন বিলিয়ন টন স্থল বরফ গলে বা স্থানচ্যুত হয়ে মহাসাগরে পড়ছে। সাগরও মানুষের নিঃসরণ দ্বারা তাপ-ফাঁদের অধিকাংশ শোষণ করছে।  এসব ঘটনা সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ যার গতি বাড়ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় জনসম্প্রদায় ক্রমবর্ধমান সামুুদ্রিক বন্যা রোধের লড়াইয়ে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে।  কংগ্রেসের কাছে সাহায্যের জন্য তাদের আবেদন উপেক্ষিত হয়েছে।
উপর্যুপরি তিন বছর তাপমাত্রার উচ্চ রেকর্ডের বিষয়টি তিনটি সরকারি সংস্থা কর্তৃক ১৮ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। এ গুলোর মধ্যে দু’টি মার্কিন, একটি ব্রিটিশ সংস্থা রয়েছে। তারা জাহাজ, বয়া ও স্থলভিত্তিক আবহাওয়া কেন্দ্রগুলোর সাহায্যে তাপমাত্রার পরিমাপ করা হয়। তারা জ্ঞাত সমস্যা সংশোধনের জন্য প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন, ভূপৃষ্ঠের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা তৈরি করেছেন। জাপানের জাতীয় আবহাওয়া সংস্থা প্রাথমিক ভিত্তিতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নাসা’র হিসাবে বলা হয়েছে যে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মেেধ্য এ গ্রহ আধ ডিগ্রিরও বেশি উষ্ণ হয়েছে।  গোটা বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের জন্য তিন বছরে এ এক বিরাট পরিবর্তন। নাসা ১৮৮০ সাল থেকে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখছে। নাসার রেকর্ডে তিন বছর মেয়াদে এটাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
রেকর্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধির বছরের তথ্য সরকার নিরপেক্ষ তাপমাত্রা বিশ্লেষণ প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বার্কেলে ভূপৃষ্ঠ তাপমাত্রা প্রকল্প কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। তবে এ্র গ্রুপের তথ্যে পরপর তিন বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেখতে পায়নি। তাদের বিশ্লেষণে ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১০ সালের তাপমাত্রা সামান্য বেশি ছিল।
ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা পরিমাপ ছাড়াও ভূপৃষ্ঠের কয়েক মাইলের মধ্যে বায়ুম-লে তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য উপগ্রহ ব্যবহৃত হয়েছে। যে দু’টি গ্রুপ এ তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখিয়েছে যে ২০১৬ সালে উষ্ণ তাপমাত্রার রেকর্ড ১৯৭৮ সালেও দেখা যায় যদিও একটি তথ্যে দেখা যায় যে খুব সামান্য ব্যবধানে সে রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে।
বৈশি^ক উষ্ণতার আধুনিককাল শুরু হয় ১৯৭০-এর দিকে। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে এ উষ্ণতার রেকর্ড স্থাপিত হয়। এর আগের তিন বছরে প্রথমবারের মত উচ্চ তাপমাত্রার তিনটি রেকর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭টি উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডের মধ্যে ১৬টি হয়েছে ২০০০ সালের পর।
মার্কিন যে দু’টি সংস্থা বুধবারের তথ্য দিয়েছে তারা হচ্ছে এন ও এ এ ও নাসা। সংস্থাদ্বয় শিগগিরই নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের নিযুক্ত মন্ত্রীসভার সদস্যদের কাছে  রিপোর্ট করবেন। উল্লেখ্য, ট্রাম্প জলবায়ু বিজ্ঞানের তথ্যের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ২০১২ সালে ট্রাম্প টুইটারে লেখেনঃ বৈশি^ক উষ্ণতার বিষয়টি মার্কিন উৎপাদকদের প্রতিযোগিতাহীন করতে চীনের দ্বারা ও চীনের স্বার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তাদের তথ্য এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় কিনা সে বিষয়ে সংস্থাগুলোর মধ্যে শংকার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প ও তার মন্ত্রিসভার মনোনীতরা তাদের ব্যাপক জলবায়ু নীতি কী হতে পারে সে বিষয়ে বিশদ কিছু বলেননি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প স্বীকার করেন যে, মানুষের কর্মকা- ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কিছু যোগসূত্র থাকতে পারে এবং তিনি অঙ্গীকার এ ব্যাপারে মন খোলা রাখার অঙ্গীকার করেছেন।
সিনেট পরিবেশ ও গণপূর্ত কমিটির প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগে বুধবার পরিবেশ রক্ষা সংস্থার ট্রাম্প মনোনীত প্রতিনিধি স্কট প্রুইট বলেন, আমি মনে করি না যে জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধাপ্পা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে ট্রাম্পকে ভুল মনে করেন কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।    
সাগরে সৃষ্ট উত্তাপের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় বৈশি^ক তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে বিশ^ব্যাপী মানুষের নিঃসরণের কারণে যে তাপ পুঞ্জীভূত হচ্ছে তার শক্তি হবে প্রতিদিন বিশে^ হিরোশিমায় বিস্ফোরিত ৪ লাখ আণবিক বোমার নিঃসরণের প্রায় সমান।      
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন থেকে হুশিয়ারি দিয়ে আসছেন যে জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃসরণে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে মানব সমাজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে সমুদ্র পৃষ্ঠের ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি ইতোমধ্যে অনিবার্য হয়ে পড়েছে যদিও তারা বলতে পারছেন না যে কত তাড়াতাড়ি তা ঘটবে। এর ফলে বিশে^র অধিকাংশ উপকূলীয় শহর নিমজ্জিত হবে যদি না সেগুলো রক্ষার জন্য বীরোচিত প্রচেষ্টা নেয়া হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ