ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমাদের দেশের পুলিশি ব্যবস্থা কিংবা পুলিশের আচরণ নিয়ে অনেক গল্প-গুজব চালু আছে। বলা হয়ে থাকে, টাকা-পয়সা ছাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত করা যায় না। টাকা না দিলে অনেক ভুক্তভোগী মানুষ থানায় মামলা রুজু করতে পারে না। আবার টাকা-পয়সা দিলে অনেক সময় মিথ্যা মামলাও রুজু হয়ে যায়। এসব নতুন কোন ব্যাপার নয়। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, আমাদের এই উপমহাদেশে যখন থেকে পুলিশি ব্যবস্থা চালু হয়েছে তখন থেকেই পুলিশের ঘুষ গ্রহণের গল্প ও চালু হয়েছে। কেউ কেউ এসব গল্প বিশ্বাস করেন। কেউ হয়তবা বিশ্বাস করেন না। তবে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মনে করে থাকে, পুলিশের বিরুদ্ধে চালু থাকা অভিযোগগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। ঘুষ গ্রহণ সম্পর্কে চালু কথাগুলো একেবারেই গুজব বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। আমরা এমন কথাও শুনে থাকি, কোন পুলিশের লোক তিনি বা তার পরিবারের লোকজন কিংবা তার আত্মীয়স্বজন নির্যাতনের যদি শিকার হয়, তখন যদি তিনি নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে যান এবং নির্যাতনকারী যদি ক্ষমতাবান হন তাহলে নাকি ভুক্তভোগী পুলিশের দায়ের করা মামলাও রুজু করা হয় না। এসব কথা যখন আমরা শুনতে পাই, তখন আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি, আমরা কিসের মধ্যে বসবাস করছি। তার মধ্যে আবার কিছু পুলিশ সদস্যের চাঁদাবাজির সংবাদ যখন পত্রপত্রিকায় আমরা পাঠ করি, তখন আমরা যেন চোখের সামনে দেশের অসহায় গরিব এবং ক্ষমতাহীন মানুষের ভয়াবহ জীবনযাপনের চিত্র দেখতে পাই। আমরা বলি না পুলিশে যারা চাকরি করেন তারা সবাই ঘুষখোর কিংবা চাঁদাবাজ। তাদের মধ্যে সৎ এবং ভাল মানুষও আছেন। কিন্তু যারা ভাল মানুষ তারা যেখানে যে ব্যবস্থাই অর্থাৎ পুলিশ বিভাগে কিংবা রাষ্ট্রের যে বিভাগেই চাকরি করেন না কেন, সেখানেও তাদের দুর্নীতিবাজ সহকর্মী দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কোণঠাসা অবস্থায় কোন রকমে চাকরি বাঁচিয়ে কাজ করতে হয়। ঐ যে আগে বললাম, অনেক পুলিশের লোকও নির্যাতনের শিকার হলে থানায় মামলা করতে পারেন না ক্ষমতাবানদের চোখ রাঙ্গানীর ভয়ে। আসল কথা হচ্ছে, আমরা এখন এমন এক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, যখন কেবল ভাগ্যবান দুর্নীতিবাজরাই তাদের অশুভ কর্মের মাধ্যমে লাভের ফল ঘরে তুলে থাকেন। এই যে এত কথা বললাম তারও একটা কারণ আছে। কারণটি হল এই যে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেছে, যশোর থানায় এক যুবককে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের ছবি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে অভিযুক্ত দুই পুলিশকে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, যুবককে চায়ের দোকান থেকে ধরে নিয়ে যশোর কোতোয়ালি থানার মধ্যে দুটি টেবিলের মাঝখানে মোটা একটি লাঠির মাধ্যমে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের এই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয় যে, যুবকটির নাম আবু সাইদ। বাড়ি যশোর সদরের তালবাড়িয়া কলেজপাড়ায়। দুই লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের জন্য যুবকটিকে এভাবে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ। পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে একদিন পরে ঐ যুবককে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আমরা যদি ঘটনাটির ঘটনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা ব্যাখ্যা করতে যাই তাহলে এখানে একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হব যে, আবু সাইদকে ধরে নেয়ার পর তার মুক্তির ব্যাপারে কিছু না কিছু নয়ছয় ঘটেছে কিংবা অন্য রকম পন্থায় আবু সাইদকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যরকম পন্থায় আবু সাইদকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলেই ঘটনার রহস্য খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্ত দুই পুলিশকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে এবং বিষয়টা পুলিশ সুপার পর্যন্ত গিয়েছে। ফেসবুকে যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, তা দেখে যে কেউ ভয়ে শিউরে উঠবেন। মানুষ ভাববে যে, কেউ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবিটির লোকটির মতো কিছুসংখ্যক অসাধু পুলিশের দ্বারা বিনা অপরাধে নির্যাতনের শিকার হতে পারে। মানুষের মনের মধ্যে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের আচরণের জন্যই পুলিশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, পুলিশ জনগণের বন্ধু। একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ পুলিশের লোকের কারণে পুলিশকে মানুষের বন্ধু ভাবতে দেশের মানুষের মন কেমন যেন করে উঠে। তারপরও মানুষের মনের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা যে নেই তা বলা যাবে না। তবে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ পুলিশদের কর্মকা-ের জন্য দেশের মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে তা নিরসন করার দায়িত্ব হচ্ছে সৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের পুলিশ বাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কালোরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তা আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। সেই ইতিহাস পড়লে আমাদের মন আজও কেঁপে উঠে। তারাই অর্থাৎ পুলিশের লোকেরাই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কালোরাত্রিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণকে চ্যালেঞ্জ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সেই পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন ধরনের অনৈতিক কর্মকা-ের কথা উঠলে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মন অবশ্যই কেঁদে উঠে। আমাদের দেশের মানুষ সবাই সহনশীল। তারা সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তারা সৎ মনোবৃত্তি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাকেই পছন্দ করে।
এখন কথা হলো, কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তারা সন্ত্রাসীদের থানায় ধরে এনে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। আবার পুলিশের রিমান্ড বাণিজ্যের কথাও বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। অভিযোগ করা হয়ে থাকে রিমান্ডে নিয়েও নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে পুলিশ অসহায় মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকে। এসব অভিযোগ মানুষ করে থাকে এই জন্য যে, মানুষ অভিযোগ করার মতো বিষয় আশয়ের কথা লোকমুখে শুনতে পায়। মানুষ অনেক অভিযোগ করে, পুলিশও তা অস্বীকার করে থাকে। তারপরও মানুষের মন থেকে পুলিশ সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা মুছে যায় না। অনেকেই বলে থাকেন, পুলিশকে ব্যবহার করে একশ্রেণীর ক্ষমতাবান ব্যক্তি অসহায় লোকদেরকে যে কোন মামলায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে থাকেন। আবার অনেকে একথাও বলে থাকেন, বিচার বিভাগ এখন আলাদা হওয়ায় অসৎ ও অসাধু পুলিশ সদস্যের রিমান্ড বাণিজ্য আগের মত আর চলে না। প্রত্যেক মানুষের কর্মের মাধ্যমেই সেই মানুষ সম্পর্কে মানুষ একটা ধারণা পোষণ করে থাকে। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর কিছুসংখ্যক অসৎ পুলিশ সদস্যের কারণে পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে মানুষ ভয় পায়। যদিও সবাই জানে, আমাদের পুলিশ বাহিনীকে অসৎ পুলিশের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের সবার মধ্যে এখন এমন একটা ভাবের সৃষ্টি হয়েছে যে, যেন সবাই আছেন শুধু বৈষয়িক উন্নতি কিভাবে করা যায় তা নিয়ে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন কিংবা অভিযোগ করে থাকেন, সরকারি চাকরি সোনার হরিণের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য। এখন সরকারি চাকরি পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন, সরকারি চাকরি সহজে পাওয়া যায় না। তার জন্য জায়গা মতো টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়। জানি না কথাটা কতটুকু সত্য। কেউ টাকা-পয়সা খরচ করে যদি চাকরি পেয়ে থাকে তাহলে সেতো ঘুষ হিসাবে দেয়া টাকা তোলার জন্য বাঁকা পথে হাঁটবেই। বাঁকা পথে হাঁটতে গেলেই এবং চাকরি পেতে গিয়ে যে টাকা-পয়সা জায়গা মতো খরচ করা হয়ে থাকে তা তোলার জন্যই আবু সাইদের মতো লোকদের থানা হাজতে অত্যাচার করা হবেই। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আমাদেরকে বুঝতে হবে আমরা ভয়াবহ একটা সময় অতিক্রম করে যাচ্ছি। যে সময়ের যন্ত্রণার চাপে মানুষ আজ দিশাহারা। হাতে যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে ক্ষমতাবান ব্যক্তি নিজেদের আয় উন্নতি জন্য অন্যের গলায় টিপ দিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করবেই। দুর্নীতিবাজ যে, কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন, তা নয়। এমন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর সকল পর্যায়েই রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়ে থাকে, তারা ঘুষ না পেলে কাজ করেন না। পত্রিকায় দেখলাম এক উপসচিবকে ঘুষ নেওয়ার অপরাধে দুদক হাতে নাতে গ্রেফতার করেছে। এই শ্রেণীর লোকেরা মানুষকে জিম্মি করে তাদের অনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে টাকা পয়সা আদায় করছে। আমরা সাধারণ মানুষের দল মনে করি, এমন অনৈতিক অত্যাচারের অবসান হওয়ার এখনই সময়। দেশ-বিদেশে আমাদের দেশ উন্নতির মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ভূলুন্ঠিত হবে, তা কি মেনে নেয়া যায়? সকল অত্যাচার ও অন্যায়ে অবসানের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র একটা শক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির মাঝে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বসে থাকা অসৎ দুর্নীতিবাজ মানুষকে চরম শাস্তি দিয়ে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন পারে। আমরা দেশবাসী শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা সন্ত্রাসী কিংবা অসৎ দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে জীবনযাপন করতে চাই না, কোনো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা থানায় নিয়ে মানুষকে (সে যত বড় অপরাধী হোক) ঝুলিয়ে অত্যাচার করে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করে না। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করা হয়, সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। আমরা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বসবাস করতে চাই।যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠবে না।
লেখক: কবি, গল্পকার, আইনজীবী
কালিবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।