Inqilab Logo

রোববার, ২৩ জুন ২০২৪, ০৯ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

হারায়নি আড়াই’শ বছরের ঐতিহ্য গুমগুটি খেলা

| প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. শামসুল আলম খান : মাঠ বলতে পতিত ধানক্ষেত। সেখানে অনেকটাই ফুটবলের মতো গোলাকার ৪০ কেজি ওজনের একটি পিতলের গুটি মাথায় নিয়ে আছেন একজন। বাঁশিতে ফু দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে অবস্থানরত হাজার হাজার খেলোয়াড়ের মাঝখানে ছেড়ে দেয়া হলো ভারী এ গুটি।
এরপর ধাক্কাধাক্কি আর কাড়াকাড়িতে নিজেদের শক্তিমত্তার পরীক্ষা দিয়ে যারাই গুটিটি নিজেদের দখলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলতে পারবে, জয় তাদেরই। গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করা এ খেলার নাম গুমগুটি খেলা। এ খেলাটি হুমগুটি হিসেবেও পরিচিত।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ জীবনে বিনোদনের উপলক্ষ তৈরি করা অনেক খেলা হারিয়ে গেলেও হারায়নি এ গুমগুটি খেলা। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দাদের হৃদয়ে এখনো স্থায়ী আসন পেতে আছে এ খেলাটি।
এখানকার গ্রামীণ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এ খেলা বরাবরের মতো এবারো বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে স্থানীয়দের। পৌষের শেষ দিনে শুক্রবার বিকেলে উপজেলার লক্ষ্মীপুর ও দশমাইলের মাঝামাঝি বড়ই আটা নামক স্থানে শুরু হয় এ খেলা। রাতের নিকষ কালো আঁধারেও চলতে থাকে ভারী গুটি নিয়ে দাপাদাপি।
আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লাখো মানুষ ভিড় করে দাপটের সঙ্গেই টিকে থাকা এ লোকজ খেলাটি দেখতে। ফলে গোটা উপজেলাজুড়ে দিনমান ছিল উৎসবের আমেজ। অবশেষে একপক্ষ গুটি লুকিয়ে ফেলার পর রাত ১০টার দিকে সাঙ্গ হয় গুমগুটির মিলনমেলা।
দেশের কোনো প্রান্তে এ খেলার প্রচলন না থাকলেও প্রতি শীতে জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলায় পৌষের শেষ বিকেলে এ খেলা চলে। টানা আড়াই’শ বছর যাবত চলে আসছে এ গুমগুটি খেলা। এখানকার গ্রামীণ পরিবেশে যারা বেড়ে ওঠেছেন, তাদের প্রত্যেকেরই কম-বেশি এ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
স্বমহিমায় উজ্জ্বল এ খেলার মধ্যেই শতভাগ বাঙালিয়ানার ছাপ রয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। আর তাই কি না এতো বছর পরও আপন ঐতিহ্যে টিকে আছে জনপ্রিয় এ খেলা।
স্থানীয়রা জানায়, জমির পরিমাপ নিয়ে মুক্তাগাছা জমিদার রাজা শশীকান্তের সাথে ত্রিশালের বৈলরের হেমচন্দ্র রায়ের বিরোধ তৈরি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে ও পরগণার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে।
একই জমিদারের দ্বৈত নীতির প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ নিষ্পত্তি করতে স্থানীয় লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে যেখানে শুরু তালুক পরগণার সীমানা সেখানেই এ গুমগুটি খেলার আয়োজন করেন জমিদাররা।
মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়ে গুমগুটি পরগণার সীমানায় নিয়ে আসে। এরপর থেকেই পরগণা সীমানার জমির পরিমাপ সাড়ে ৬ শতাংশে কাঠা হয়। মূলত জমির পরিমাপ নির্ধারণ করতেই এ খেলার সূত্রপাত হয়েছিল।
খেলা চলাকালেই আলাপ হলো স্থানীয় লক্ষ্মীপুর বাজার এলাকার বয়োবৃদ্ধ আরফান আলী ও ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। সত্তোরের কোঠায় তাদের বয়স। তারা জানান, শৈশবে বাবার কাঁধে চড়ে তারা এ খেলা দেখতে আসতেন। এখন বয়সে বুড়িয়ে গেলেও তরুণ-যুবাদের হুমগুটি নিয়ে শক্তির লড়াইয়ে আমোদিত হন।
‘সবাই ধাক্কাধাক্কি করেই এ খেলা খেলে। যারাই গুটি নিজেদের এলাকায় নিয়ে যেতে পারবে তাদেরই সুনাম। এ সুনামের জন্যই সবাই মরিয়া হয়ে দাপিয়ে বেড়ায়’ গুমগুটি উৎসবে যোগ দেয়া স্থানীয় ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী রেজাউল নাহিদ ফয়সালের মন্তব্য এমনই।
স্থানীয় তেলিগ্রাম এলাকার ৮০ বছর বয়সী আবদুল খালেক জানান, তাদের শৈশবে এ খেলা চলতে দুই কি তিনদিন। ওই সময় শক্তিমান জোয়ান ছিল। এখন কয়েক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায় এ খেলা।
জানতে চাইলে ফুলবাড়িয়া উপজেলা আ’লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম জানান, গুমগুটি খেলায় নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড় নেই। রেফারিও থাকে না। এরপরও কোনো ঝগড়া-বিবাদ হয় না। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই স্থানীয়রা খেলাটি ধরে রেখেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ