Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪, ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইউরোপের মুসলিম, সাঁতার প্রশিক্ষণ আদালতের রায় ও ধর্মনিরপেক্ষতা

| প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল জাজিরা : সুইজারল্যান্ডের বাসেলের এক মুসলিম দম্পতি স্কুলে তাদের মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে ছেলেদের সাথে সাঁতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি দেয়া এক রায়ে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত (ইসিএইচআর) তাদের আপত্তি খারিজ করে দিয়েছে।
তুর্কি বংশোদ্ভূত ঐ পরিবার ইসিএইচআর-এ দায়ের করা মামলায় বলেন, সহশিক্ষা তাদের মুসলিম ধর্মবিশ^াসকে লংঘন করে। স্ট্রাসবুর্গের আদালতের বিচারকরা রায়ে বলেন, পিতা-মাতার ইচ্ছার চেয়েও সামাজিক একীকরণের লক্ষ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকরা স্বীকার করেন যে এ বিষয়ক আইন ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক, কিন্তু তা মানবাধিকার লংঘন করে না। তারা বলেন, এ আইন হচ্ছে বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করার জন্য। আদালতের রায়ে বলা হয়, মুসলিম মেয়েদের অবশ্যই ছেলেদের সাথে সাঁতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।   
এ রায়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, আর কোনো শূন্যতার মধ্যেও তা দেয়া হয়নি। ধর্মীয় স্বাধীনতার মত বিষয়গুলোতে মত দেয়ার জন্য আগেও ইউরোপীয় আদালতকে ডাকা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে যা অগ্রাহ্য করা কঠিন।
দু’টি মৌলিক ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে যেখানে আদালত অধিকতর নিরপেক্ষ ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করেছে এবং যেখানে বিচারকরা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে ব্যক্তিগত ধারণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যা কতিপয় বিধিনিষেধের যৌক্তিকতা প্রতিপন্নের জন্য অপরিবর্তনীয় জনশৃঙ্খলার আহ্বান।
তবে এ প্রবণতা গতানুগতিকভাবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের দায়ের করা ধর্মীয় স্বাধীনতার মামলার সাথে সম্পর্কিত যার মধ্যে রয়েছে এক ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ নারী কর্মচারীর কথা যাকে তার মালিকপক্ষ বলেছিলেন যে তিনি গলায় ক্রশ পরতে পারবেন না। বস্তুত রাষ্ট্রীয় অনুমোদন থাকার প্রেক্ষিতে খ্রিস্টান ঐতিহ্য দর্শনীয়ভাবে প্রদর্শন করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় স্কুলগুলোতে প্রকাশ্যে ক্রশ প্রদর্শনের অনুমোদনের জন্য আদালতে আবেদন করে এবং তা করতে সফল হয়।
তা সত্ত্বেও আরেকটি ধারা সেখানে কাজ করছিলÑ তা এমন যা অনেক বেশী আগ্রাসনমূলক ধর্মনিরপেক্ষ এবং যা অপরিবর্তনীয়ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে। ফরাসি ও তুর্কি নাগরিকেরা নির্দিষ্ট ধরনের পোশাক বিশেষ করে মস্তকাবরণ বা হিজাব এবং মুখাবরণ বা নিকাব পরার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছেন।
এ ধরনের মামলার আেেলাকে ইউরোপীয় আদালতের এক সাবেক কর্মচারী যেমন উল্লেখ করেন: “... কেউ কেউ মনে করেন যে আদালত অনেক ঘন ঘন এক ধরনের কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা এক ধরনের অসহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা আলোকিতকরণমূলক মৌলবাদ বজায় রাখেন। এটা বিশেষ করে সেই সব ক্ষেত্রে যখন ব্যক্তির ধর্মীয় প্রকাশ রাজনৈতিক ইচ্ছার কোনো লক্ষণ প্রদর্শন করে না কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজ রক্ষার প্রয়োজনীয়তার সাথে সমঝোতার ক্ষেত্রে এসব বিধিনিষেধ প্রকৃতই কঠিন অবস্থার সৃষ্টি করে।”
সামাজিক একীভূতকরণ  
এই ধারায় আদালত বিবেকের স্বাধীনতার উপর এমন একটি পর্যায় পর্যন্ত রাষ্ট্রের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে যেখানে মনে হয় যে আদালত রাষ্ট্রের যুক্তিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যাকে তা বৈধ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে।
তবে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এই বিশেষ ঘটনাটিতে মেয়েরা হচ্ছে শিশু, এমনকি তারা বয়ঃসন্ধিতেও পৌঁছেনি এবং স্কুল বলেছিল যে বুরকিনি নামে পরিচিত একটি পুরো দৈর্ঘের ওয়েটসুট পরা যেতে পারে। যে কেউ ভাবতে পারেন যে একটি সমাধান খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন পূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে এবং আদালতও পরিষ্কার।
বয়ঃসন্ধিকালের নীচে বা পার হওয়া বয়সে বুরকিনি, বুরকিনি নয় প্রসঙ্গে মনে হয় মুসলিম পিতা-মাতারা যারা মিশ্র সাঁতার প্রশিক্ষণ থেকে তাদের মেয়েদের প্রত্যাহার করতে চান তারা তা করতে সক্ষম হবেন না।
এ মামলার বিষয়টি সাঁতার প্রশিক্ষণের চেয়েও বেশিকিছু। আদালত যেসব কারণ উল্লেখ করেছে তা এর চেয়ে অনেক বেশি বোঝায়। ব্যাপকভিত্তিক বিবৃতির বদলে এতে দাবি করা হয় যে ‘স্থানীয় প্রথা ও রীতিনীতি অনুযায়ী সফল একীকরণে’ সুইজারল্যান্ডের অধিকার নজির স্থাপন করেছে।
আরো কথা, ‘আদালত লক্ষ্য করেছে যে সামাজিক একীকরণ ক্ষেত্রে স্কুল বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এবং যেখানে বিদেশী বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রী আছে সেক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সিদ্ধান্তমূলক ছিল।’
ইউরোপে ইসলাম
এ রায়কে ইউরোপ ব্যাপী ‘দৃশ্যমান মুসলমানত্বের’ অর্থে ব্যাপক মুসলিমবিরোধী মনোভাব থেকে পৃথক করা কঠিন। স্মরণযোগ্যঃ সুইজারল্যান্ড হচ্ছে সেই দেশ যেখানে কয়েক বছর আগে মসজিদের মিনার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় (যদিও সেখানে মিনারের সংখ্যা বিরল) এবং তার ফলস্বরূপ সুইসরা মিনার নিষিদ্ধ করে।
তবে সুইসদের এ ঘটনা দিয়ে সার্বিকভাবে বিচার করা যায় না। সাধারণভাবে তারা সহিষ্ণু জাতি ও বৈচিত্র্য অনুমোদন করে। সুইসরা ব্যাপক আলোচনার অংশ, যেখানে ইউরোপব্যাপী তিনটি জিনিস ধাক্কা দিয়েছে। প্রথম হচ্ছে ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপে ধর্মকে কিভাবে স্বীকার করা হবে যে মহাদেশে এখন মাত্র ৮টি স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় গির্জা আছে? উদাহরণ স্বরূপঃ কয়েক সপ্তাহ আগে নরওয়ে তাদের নিজস্ব জাতীয় চর্চাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে জাতীয় জীবনে ধর্মকে আর আগের মত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় না।
দি¦তীয়ত, ইউরোপীয় জনজীবনের পটভূমিতে ধর্ম হিসেবে ইউরোপ ইসলামকে কিভাবে গ্রহণ করবে? ঐতিহাসিকভাবে ও আজকেও ইউরোপে ব্যাপক ইসলামবিরোধিতা রয়েছে। তবে আমরা পছন্দ করি বা না করি, ইসলাম একটি ইউরোপীয় ধর্ম এবং তার অনুসারীরা শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে ইউরোপীয়দের থেকে আলাদা নয়। ইউরোপকে সার্বিকভাবে এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
সর্বশেষ হচ্ছে, দৃশ্যমান হোক আর না হোক, ইউরোপ কিভাবে ব্যক্তি হিসেবে বা সমাজে কিভাবে মুসলমানদের অঙ্গীভূত করবে যেখানে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া থেকে তারা আলাদা? এমনকি মিশ্র-লিঙ্গের খেলাধুলাতেও যখন তারা অনীহা প্রকাশ করে যা রীতিবহির্ভূত?
এর শেষ কোথায় এবং কে এ সিদ্ধান্ত নেবে? মুসলিম ইউরোপীয়রা কি এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে অন্য ইউরোপীয়দের মত ইউরোপীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে? অথবা তাদেরকে কি স্রেফ বলে দেয়া হবে যে এটাই পথ এবং যদি তা তাদের পছন্দ না হয় তাহলে তাদের ইউরোপীয়ত্ব প্রত্যাখ্যান করা হবে। তারা কি বাস করতে পারবে? তবে কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, তারা ইউরোপীয়।
এ সব কিছুই ঘটছে সন্ত্রাস ও অভিবাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রেক্ষাপটে এবং এগুলো নিরসন হওয়া উচিত হলেও তা হচ্ছে না। ইউরারাবিয়ার ভয় রয়ে গেছে, যতটা অস্বাভাবিক হওয়া দরকার ততটা।
ডানপন্থী ও বামপন্থীদের অনেকেই এ সব বিষয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। খুব সম্ভাবত তা চলতেই থাকবে মনে হয় এবং হায়! আদালতের এ ধরনের রায় পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে।  
ইউরোপ এক ভীষণ চ্যালেঞ্জিং সময় পাড়ি দিচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সর্বোত্তমভাবে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে তৎপর হতে হবে। সর্বশেষ ঘটনা এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ নয়।
নিবন্ধকার ড. এইচ এ হেলিয়ার আটলান্টিক কাউন্সিলের আর এইচ সেন্টার ফর দি মিডল ইস্ট এবং লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অনাবাসিক ফেলো। তিনি ‘দি ‘আদার’ ইউরোপিয়ানস : মুসলিমস অব ইউরোপ’ গ্রন্থের লেখক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ