ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী : মানব সভ্যতায় ইসলামের মহানতম অবদান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাকে আল্লাহতায়ালা অপরিসীম মূল্য দান করেছেন। নবী করিম হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয় সূরায়ে ‘ইকরা’ অর্থাৎ ‘পড়’। সূরাটির প্রথম আয়াত ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ জ্ঞান সাগরের মহাধিপতি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেন- ‘লেখকের কালি শহীদের রক্ত অপেক্ষাও খোদার নিকট অধিক পবিত্র।’ ‘এক ঘণ্টা জ্ঞান-বিজ্ঞান আলোচনা সহ¯্র রজনী উপাসনাপেক্ষা শ্রেয়।’ ‘খোদার সৃষ্টি সম্পর্কে নিবিষ্ট মনে এক ঘণ্টা চিন্তা করা এক হাজার বছর এবাদত করা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।’
জ্ঞান-বিজ্ঞানের এহেন গুরুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যযুগের মুসলমানরা আপন হৃদয়ের জ্ঞানরূপ আলোকবর্তিকা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেন। পৃথিবীর সকল জ্ঞানভা-ার আহরণ করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। মুসলিম বৈজ্ঞানিকরা লোহাকে সোনা করার অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যদিও তা সম্ভব হয়নি তথাপি এ গবেষণা সূত্রপাত করে নব নব উপাদান আবিষ্কারের। খলিফা মনসুর, হারুন অর রসিদ, মালিক শাহ ও মামুনের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা চরমে পৌঁছে ছিল। বাগদাদ, মিশর, মরক্কো, স্পেন, পারস্য, সিসিলি, গ্রানাডা প্রভৃতি স্থান ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক, বিজ্ঞান, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, সামরিক শিক্ষা, তফসীর, হাদিস, ফেকাহ, শিল্পকলা, নৌবিদ্যা, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি শিক্ষা লাভের প্রাণকেন্দ্র। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইউরোপে যখন জ্ঞানের আলো পৌঁছেনি তখনও আরববাসী জ্ঞান-বিজ্ঞানে ছিলেন অনেক অগ্রগামী।
রসায়ন শাস্ত্রকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণা থেকে উদ্ধার করে পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে উন্নত করতে মুসলিম বৈজ্ঞানিক জাবির ইবনে হাইয়ানের রয়েছে অভূতপূর্ব অবদান। জার্মান প-িত ল জঁংশধ, চধঁষ কৎধঁং, ইংল্যান্ডের ঊ.ল. ঐড়ষহুধৎফ এবং আমেরিকার এ. ঝধৎঃড়হ স্বীকার করেন, যে জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ। জাবির (এবনবৎ) দু হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন যার মধ্যে রয়েছে ২৬৭ খানা রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে রচিত। মধ্যযুগে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে গভীর সাধনা করেন ইবনে সিনা, ইবনে জাহর, আল জাহরাওয়ী, উবায়দুল্লা জেব্রিল, আলী ইবনে সহল রব্বান আল-তাবায়ী, আল রাজী, আলী বিন-আব্বাস ও আল মজসী। চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে ইবনে সিনার লিখিত গ্রস্থ ‘আল কানুন’-কে চিকিৎসা শাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। আরববাসীর মধ্যে গণিত শাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন খোয়ারীজমি ও ইবনে মুল্লাহ। খোয়ারীজমির লিখিত ‘হিসাবুল জবর ওয়াল মু কাবল’ গ্রন্থটি সর্বপ্রথম বীজগণিতের পাঠ্যপুস্তকরূপে সমাদৃত হয়। পৃথিবী যে গোল তাও তিনি ১১৮৬ সনে তার রচিত ‘সুরাত আল আরদ্ব’ নামক গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণ করে দেখান। তাছাড়া ইবনে মুসা একধারে গণিতবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোর্তিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। ৮৫০ সনে তিনিই প্রথম মানচিত্রের ব্যবহার দেখান।
নৌ সংক্রান্ত কম্পাস আবিষ্কার করে মধ্যযুগের মুসলমানরা সমুদ্র যাত্রা করে বিভিন্ন দেশ আবিষ্কার করেন। আব্দুর রহমান, জায়হানী, আল ইদ্রিসী, আল বকরী, খুরদেচ্ছি, আল মামুদী, হাওকল আল-মুকদ্দসী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভূগোলজ্ঞ ছিলেন। আরবি নাবিক আব্দুর রহমানের নির্দেশে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। ১৫১৩ সনে নায়ক পিরী রইস দূরত্ব ও কম্পাস নির্দেশনার মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা উপকূল চিত্র হরিণের চামড়ার ওপর অঙ্কন করেন। তিনি নৌবিজ্ঞান, আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগর নিয়ে অতি মূল্যবান কয়েক খানা গ্রন্থ রচনা করেন। বৈজ্ঞানিক আব্দুর হাসান টিউব থেকে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ও ইবনে বয়তার মুসলিম স্পেনে উদ্ভিদ বিদ্যায় অসাধারণ পা-িত্য দেখিয়েছিলেন। আল-মাজিরিত, আল জারকালি ইবনে আফলাহ মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম ও আল ফাজারি সে যুগের প্রসিদ্ধ জ্যোর্তিবিদ ছিলেন। ১০৬৮ সনে স্পেনের সঈদ আসসাফি একটি আন্টোলের তৈরি করেন যাদ্বারা বছরে সূর্যের গতিপথ নির্দেশিত এবং ২৮টি তারকার অবস্থান বুঝা যায়। বর্তমানে এটা অক্সফোর্ডের মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স-এ সুরক্ষিত আছে।
মধ্যযুগে কাব্য ও সাহিত্য সাধনায় অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন ইবনে আব্দে রাব্বি, আবু ওয়ালিদ, শেখ সাদী, ইসফেহানী, ইবনে খালিকান, ফেরদ্দৌসী, আবু নেওয়াজ, আলবুহতারী, দাকিকি, জালাল উদ্দিন রোমী ও মোহাম্মদ বিন ইসহাক। সাদীর গোলস্তান, বোস্তান এবং ফেরদ্দৌসীর ‘শাহনামা’ গ্রন্থ পৃথিবীতে বিরল। মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ হামাদান, মামুদি, তাবারী ইবনে আলকাতুহার আব্বাসী যুগে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে আল কাতিব, ইবনে খালদুন আবু উবায়দুল্লাহ, আবু মারওয়ান, আলী ইবনে হাজম স্পেনের সমুন্নত ঐতিহাসিক ছিলেন। হাজন ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, তর্কশাস্ত্র ও কবিতা নিয়ে চারশত অধ্যায়ের গ্রন্থ রচনা করেন। মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ওমর খৈয়ামের দান অতুলনীয়। তিনি গণিতবিদ, জ্যোর্তিবিদ, ঔপন্যাসিক ও প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। পদার্থ বিদ্যা, অঙ্ক, রসায়ন শাস্ত্র মুসলিম সাধক আল কাবরীর রয়েছে অসংখ্য অবদান। আরববাসীর মধ্যে দর্শন নিয়ে গভীর সাধনা করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন ইমাম গাজ্জালী, আলফারাবী, ইবনে সিনা এবং আলকিন্দি। মালিক শাহ নিজামুল মুলকের সরকারের নিয়মকানুন ও কৌশল সংক্রান্ত ‘সিয়াসত নামা’ গ্রন্থটি রাজনীতিবিদদের পথ প্রদর্শনস্বরূপ।
খলিফা মনসুর পৃথিবীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ বিভাগ স্থাপন করেন। খলিফা হারুণ ও মামুনের সময় তা আশাতীত প্রসার লাভ করে। মামুন লুকের পুত্র কাতাকে আর্কিমিদিস, ইউক্লিড, এরিস্টটল, প্লেটো, গ্যালনপ্রমুখ গ্রীক মনীষীদের গ্রন্থাবলী অনুবাদের পদে নিযুক্ত করেন। প-িত হোসাইনকে বিদেশি বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলী, আহয়া নামক পারসিককে ফার্সী গ্রন্থাবলী এবং ভারতের ব্রাহ্মণ দুবানকে সংস্কৃত ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদের জন্য নিয়োগ করেছিলেন। তিনি ‘বায়াতুল হিকমত’ বাগদাদে স্থাপন করে আধুনিক ফার্সী কবিতায় প্রতিষ্ঠাতা কবি আব্বাস ও আলকিন্দিকে নিযুক্ত করেন। প্রসিদ্ধ জ্যোর্তিবিদ মোহাম্মদ-বিন-ইব্রাহিম আল ফাজারী খলিফা মামুনের অনুরোধে ভারতীয় জ্যোর্তিবিদ্যার ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
৭১২ সালে আরবরা যখন ভারতের সিন্ধু, মুলতান ও পাঞ্জাব জয় করে তখন থেকে আরব জাতি ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আল-বেরুণী মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় পা-িত্য লাভ করে আরবি ভাষায় সংস্কৃতের অনেক নীতিমূলক গল্প ও তত্ত্ব তুলে ধরেন। বিশ্ব-বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাও ভারতের মান-মর্যাদাগুলো পৃথিবীর মানুষের সম্মুখে তুলে ধরেন। তাছাড়া আল-বেরুণীর ‘আল-হিন্দ’ গ্রন্থটি বিশ্ব আলবেরুণীর ইন্ডিয়া নামে পরিচয় লাভ করে। বিভিন্ন বিজ্ঞানে, গণিত, জ্যোর্তিবিদ, চিকিৎসা শাস্ত্র, ভূগোল, ইতিহাস নিয়ে গভীর সাধনা করেন আলবেরুণী। তার গণিত ও জ্যোর্তিবিদ্যা সম্বন্ধে লিখিত ‘আলমামুদ ফিল হায়াৎ ওয়ান্নাজুম’ এবং ‘কানুন’ গ্রন্থদ্বয় এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য যার মধ্যে ছিল জ্যোর্তিবিদ্যা, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি ও অঙ্ক।
এটাই প্রতীয়মান যে, বর্তমান বিশ্বের বিশেষ করে ইউরোপের নবজাগরণই হচ্ছে মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীদের সাতশত বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার অমৃত ফল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম মানব সভ্যতাকে উন্নত শিখরে পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক- কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।