Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪, ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

কিংবদন্তির নাম : বিচারপতি মোরশেদ

| প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ব্যারিস্টার তমিজ উদ্দিন : পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত আটান্ন বর্গমাইলের ভূখ-টি বিশ্ব মানচিত্রে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বে ব্রিটিশ-পাকিস্তানের শাসকদের শাসন এবং শোষণের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনার সে অস্বাভাবিক সময়ে যে ক’জন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ স্বমহিমায় জ্ঞান ও পা-িত্যে নিজেকে উজ্জ্বল করে রাষ্ট্রের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত হন বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের সমাপ্তির বছরগুলোতে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ থার্মোমিটারে উচ্চাঙ্গের দিকে প্রবাহিত সে সময় তিনি ব্রিটেনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দি অনারাবল সোসাইটি অব লিংকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট-ল লাভ করেন। সেটি ছিল ১৯৩৮ সাল। বিলেত ফেরত একজন ব্যারিস্টারের কদর সে সময় বাঙালি মুসলমান সমাজে কতটা শিহরণ জাগানো ছিল তার বর্ণনা দেয়া বাহুল্য মাত্র। ইতোপূর্বে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে বিএ (সম্মান) ও এম এ এবং আইনশাস্ত্রে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
উচ্চ মেধাসম্পন্ন আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী এ মানুষটির গৌরবময় জীবন সম্পর্কে বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক, সাবেক বিচারপতি, আইনজ্ঞরা পত্র-পত্রিকায়, বই-পুস্তকে লিখেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমদ, বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
বিচারপতি মোরশেদ সম্পর্কে কবীর চৌধুরীর মূল্যায়ন : তার ব্যক্তিত্বের অন্যতম উপাদান ছিল ¯িœগ্ধ আভিজাত্যবোধ, রুচিশীলতা, রসজ্ঞান, সৌজন্য ও সহানুভূতি এবং অপরের দৃষ্টিকোণকে উপযুক্ত গুরুত্ব দানের সহজাত প্রবণতা। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিতচিত্ত। কোনো রকম চাপের মুখে, তা সেটা সর্বোচ্চ মহল থেকে এলেও তিনি কখনো ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে আপসকামিতাকে প্রশ্রয় দেননি। স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা সর্বজনবিদিত। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য তার ওপর বিশেষ চাপ ছিল কিন্তু তিনি তা সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লেখেন : সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর একাগ্র সাধনার সাথে যোগ হতো নির্ভীকতা, যখন এক পক্ষে থাকতেন নাগরিক অন্য পক্ষে সরকার। এ সম্বন্ধে তিনি প্রায়ই বলতেন, অসততা দুই রকমের, দুটোই ঘৃণ্য এবং দুটোই সমাজ ধ্বংসকারী। একটি অর্থের দ্বারা প্রতাবান্বিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত প্রদান, অন্যটি ভয়ে সরকারের পক্ষে রায় দেয়া। সুবিচার অধিকার সবারই আছেÑ নাগরিকের এবং সরকারেরও। আমি এখানে ভয়ে ভুল রায় দেয়ার উল্লেখ করেছি। বিচারক হিসেবে তিনি যেমন তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি তার নির্ভীকতার জন্য সবার শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। মানুষ বোঝে যা সত্য ও ন্যায়ের দ্বারা সমর্থিত তা বলতে বিচারক ভয় পাবেন না, তাহলে জনগণের মনে নিরাপত্তার বিশ্বাস জন্মে। অন্যথায় মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটায়। তাই নির্ভীকতা বিচারকের সবচেয়ে বড় গুণ।
আইয়ুবের দমনমূলক স্বৈরশাসন তথা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর বিপরীতে তিনি ছিলেন কঠোর এবং পাথরের মতো দৃঢ়। গভীর দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি মূল্যবোধ তাকে প্রেরণা জুগিয়েছে রাজনীতির ভাবধারায়। সে কারণেই ১৯৬৭ সালে প্রধান বিচারপতির পদ ত্যাগ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের পক্ষ সমর্থন করেন, যা সে সময় অখ- পাকিস্তানে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মৌলিক রূপায়ণের মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসার পাশাপাশি সে সময়ের অনেক বিখ্যাত রাজনীতিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ৬-দফা প্রণীত হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিচারপতি মাহবুব মোরশেদের ব্যক্তিত্ব, পেশাগত দক্ষতা, আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীলতা, গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস এবং জনগণের প্রতি তার অকৃত্রিম প্রেম, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য ও অবদান তুলে ধরা আমার মতো একজন আনকোরা নবীন লেখকের জন্য দুঃসাহসের সাথে আলিঙ্গন মাত্র। তবুও বলছি এ লেখার প্রয়াস পেয়েছি বিশাল একটি উৎসাহের জায়গা থেকে। দ্বিতীয় যে শক্তিশালী কারণটি আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে তা মাহবুব মোরশেদের চরিত্র, তার সততা, নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করে বিচারপ্রার্থীকে ন্যায়বিচার দেয়ার নির্ভীক প্রচেষ্টা।
বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ বহুমুখী প্রতিভার একটি কিংবদন্তির নাম। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রুচিশীলতা, তার নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণার উৎস। বর্তমানে ধসে যাওয়া বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকদের বিরুদ্ধে এ নামটি একটি বর্শার তীরের মতো সর্বদা বিদ্ধমান থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন