পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আফজাল বারী : জামায়াত। চার অক্ষরের দলটির এখন ত্রাহি অবস্থা। ইতোমধ্যেই সংগঠনটির নির্বাচনী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আদালত। দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। টিকে থাকার চেষ্টায় নাম পরিবর্তন করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। দেশের রাজনীতিতে সাংগঠনিক শক্তির বিচারে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পর সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল জামায়াত। ভোটের রাজনীতিতে কখনো তৃতীয় কখনো চতুর্থ অবস্থানের সংগঠনটি আর্থিকভাবে বুনিয়াদি।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের মতে, দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক-বীমা, মিডিয়া-প্রযুক্তি, রিয়েল এস্টেট, পরিবহন সেক্টরে দলটির প্রতি বছর আর্থিক নিট মুনাফা ২ হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতিতে দলটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৮ শতাংশ অবদান রাখছে। আর্থিকভাবে সমৃদ্ধশালী দলটির বর্তমান অবস্থা ছন্নছাড়া। গত ৮ বছরে দলটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সুনামি-আইলা-সিডর সব দুর্যোগ। বর্তমানে হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। ফেরারি জীবনযাপন করছে শত শত নেতা। নেতাকর্মীদের ওপর অব্যাহত জুলুম-নির্যাতনে দলটির প্রতি ‘মানবিক সহানুভূতি জানালেও ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী ধারার দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই। দলের এ অবস্থা নিয়ে জামায়াতের কোনো নেতাই কথা বলতে রাজি হননি। পলাতক নেতারা দাবি করেন তাদের দলের ওপর ‘অবিচার’ হচ্ছে। তারা মিডিয়ায় লেখার সময় দলটির ওপর ‘ইনসাফ’ করার দাবি জানান।
দেশের রাজনীতিতে ক্যাডারভিত্তিক সুসংগঠিত দল জামায়াত প্রলয়ংকরী ঝড়ের কবলে পড়ে মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায়। দলটির কেন্দ্রীয় সদর দফতরের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ‘কার্যালয়’ বন্ধ করে দেয়া হয়। ’৭১ সালে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় দলটিতে যেমন দেখা দেয় নেতৃত্বশূন্যতা; তেমনি সরকারের দমন-পীড়নে কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ে নেতাকর্মীরা হয়ে পড়েন দিশেহারা। এতদিন বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে ‘সমর্থক’ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক-সচল থাকায় ‘ট্যানেলের শেষ প্রান্তে ‘আলোর রশ্মি’র মতোই দলটির অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলে কব্জা করায় সেই ‘আলোর রশ্মি’ দপ করে নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বলা যায় চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছে দলটি। দমন-পীড়নের মুখে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী টিকে থাকার কৌশলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে ক্ষমতাসীনদের ব্যবসায়িক পার্টনার করেছে। ফলে নড়বড়ে হয়ে গেছে দলটির সাংগঠনিক ভিত।
৮ বছর ধরে কর্মকা- না থাকায় সাংগঠনিকভাবে ইসলামী ধারার দল জামায়াত চরম বিপর্যয়কর অবস্থার সম্মুখীন। অথচ সাংবিধানিক ধর্ম ‘ইসলামের’ এই দেশের সাধারণ আমজনতা দলটির প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হচ্ছেন না। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের ডাকে লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেমে আসে। অথচ জাতায়াতের ডাকে কেউ সাড়া দেন না! কারণ কী? কারণ হলো দলটির আদর্শ-নীতি ও কর্মকৌশল। দেশের মুসলমানদের যাপিত জীবনে ইসলাম ধর্ম চর্চার সঙ্গে জামায়াতের আদর্শিক ইসলাম চর্চা বিস্তর ফারাক। এ উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম এসেছে অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশদের হাত ধরে। উপমহাদেশের প্রায় অর্ধশত কোটি মুসলমান পীর-মাশায়েখদের শেখানো পথেই ইসলাম ধর্মচর্চায় অভ্যস্ত। কিন্তু ইসলামী ধারার দল হলেও ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত জামায়াত ধর্ম পালনে ‘মওদুদীবাদ’ চর্চায় অভ্যস্ত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দলটির কর্মী-সমর্থক থাকলেও এ কারণেই দেশের মূল ¯্রােতের মুসলমানদের মননে দলটি প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে কয়েক বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে নেতাকর্মীদের ওপর ন্যায়-অন্যায় দমন-পীড়নে সাধারণ আলেম সমাজ ধর্মীয় ভাই হিসেবে মানবিক কারণে কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ করলেও দলটির প্রতি সমর্থন দিচ্ছে না। ফলে ইসলামী ধারার দল জামায়াত স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও গণমানুষের দল হয়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় কর্মীনির্ভর সুসংগঠিত দলটির অস্তিত্ব রক্ষাই হয়ে গেছে দায়।
প্রতীক ও নিবন্ধন বাতিল
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াতের দলীয় প্রতীক ছিল দাঁড়িপাল্লা। নিবন্ধিত দল হিসেবে জাতীয় নির্বাচনেও তারা এই প্রতীক ব্যবহার করেছে। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত এক নির্দেশনায় উল্লেখ করেছে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়ের প্রতীক এটি কোনো রাজনৈতিক দল তাদের প্রতীক হিসেবে যেন ব্যবহার না করা হয়। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে একটি চিঠি দিয়েছে আদালত। কমিশন এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই ইসির নিজস্ব ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে দাঁডিপাল্লা প্রতীক হিসেবে ব্যবহার কবা যাবে না।
এর আগে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। টিকে থাকার জন্য আরপিও মতে, দলীয় গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন আনে জামায়াত। আগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হিসেবে পরিচয় প্রদান করলেও তা বদল করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম নির্ধারণ করা হয়। নারী নেতৃত্বের প্রতি অনীহা প্রকাশ করলেও তা বদল করে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এখন দাবি উঠেছে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। ৭ বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।
নেতৃত্বের কোন্দ্বল
দীর্ঘ ৮ বছর ধরেই এই সংগঠন নিপীড়নের শিকার। দলের শীর্ষ ও সিনিয়র নেতাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মৃত্যুদ-ও হয়েছে সংগঠনের শীর্ষ কয়েক নেতার। সাজাপ্রাপ্ত তবে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষার পালা গুনছেন কয়েকজন। তারা কারাগারে। এই সংগঠনের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সকল স্তরের নেতাই মামলার শিকার। পরিবারের সদস্যদেরও মাশুল গুনতে হচ্ছে। কর্মীরা কিছুদিন নিজ ঘরে বসবাস করতে পারলেও অর্ধযুগ আগে থেকে পদধারী নেতারা ফেরারি জীবনযাপন করছেন। দিন যত যাচ্ছে নিপীড়নের খড়গ তত প্রখর হচ্ছে। জামায়াতপন্থীদের পরিবার থেকে রাজনৈতিক সংগঠন এখন অভিভাবকহীন। এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনের নেতৃত্বের পরিবর্তন আনা হয়েছে। মাওলানা মকবুল আহমাদকে আমির নিযুক্ত করা হয়েছে। কর্মপরিষদের পরামর্শক্রমে তিনি ৫ জনকে নায়েবে আমির, একজন সেক্রেটারি জেনারেল ও ৭ জন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করেছেন। নায়েবে আমিরদের মধ্যে রয়েছেনÑ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, আব্দুস সোবহান, মজিবুর রহমান, মিয়া গোলাম পরওয়ার, আ ন ম শামসুল ইসলাম ও আতাউর রহমান। এদের মধ্যে সাঈদী ও সোবহান একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত হয়েছেন।
নতুন নেতৃত্বে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে ডা: শফিকুর রহমানকে। ৭ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলরা হলেনÑ এ টি এম আজাহার, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, এ টি এম মাসুম, মাওলানা আবু তাহের, ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত হয়ে কারাগারে আছেন এ টি এম আজাহার। দেশজুড়ে এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি ছিল আর যা-ই হোক নতুন কমিটি অন্তত নিষ্কন্টক হবে। যেসব অভিযোগে আজ সংগঠনটির বেহাল দশা সে বিষয়টি মাথায় রেখেই নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বিতর্কিতদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত আমিরের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম তার নিজ জেলা ফেনীতে তদন্ত করছেন। নিবতির্কতদের নিয়ে দলে চরম কোন্দল বিরাজ করছে। নেতৃত্ব কব্জায় রাখতে সংগঠনের আমির ক্ষুব্ধ নেতাদের প্রতি দলীয় গঠনতন্ত্র অস্ত্র ব্যবহারের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে গত ৫ বছরে জামায়াতসহ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী ঠাঁই নিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে।
হাতছাড়া হচ্ছে নিজে গড়া প্রতিষ্ঠান
অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যে দেশের এক নম্বর ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংক’-এর পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। জামায়াত মতাদর্শের পরিচালকদের বিদায় করা হয়েছে। একইভাবে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক-বীমা, মিডিয়া-প্রযুক্তি, রিয়েল এস্টেট, পরিবহন সেক্টরে তাদের নিজেদের গড়া প্রতিষ্ঠান একে একে সবগুলোই হাতছাড়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের আমূল পরিবর্তন এসেছে, আসছে।
এছাড়াও জামায়াত-শিবির পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ফোকাস কোচিং সেন্টার এবং মেডিক্যালে ভর্তির জন্য রেটিনা কোচিং সেন্টারের বিভিন্ন শাখা বন্ধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সেন্টারে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ততধিকবার। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিকই নয়, জেলা-উপজেলা এমনকি উপশহরে তাদের অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেখা মেলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ওই সব প্রতিষ্ঠানে ধস নেমেছে। বন্ধ হচ্ছে আয়ের উৎস।
জোটেও দুর্বল অবস্থান
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাথে মিত্রতা করে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে জামায়াত। আবার ১৯৯৮ সালে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনÑএই তিন ইস্যুতে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠন করে জামায়াত। সরকারও গঠন করেছিল। চার দলের কলেবর বৃদ্ধি হয়ে এখন ২০ দল। সেই জোটে জামায়াতের অবস্থান যতটা মজবুত ছিল এখন সে অবস্থা নেই। এখন জোটের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক শীতল। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বেলায় অনেক বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি দেখা যায়। ইতোমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও স্পষ্ট করেছেন যে, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে আদর্শিক অমিল রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্ক শুধু সেই তিন ইস্যুতেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।