Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

৩৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার জন্য

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিষয় : বাংলা (বিরচন অংশ)
শামসুল আলম
চেয়ারম্যান
ক্যারিয়ার গাইডলাইন

সারাংশ ও সারমর্ম  
গদ্য বা পদ্য রচনার অন্তর্নিহিত মূল ভাবকে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সংক্ষেপে প্রকাশই সারমর্ম বা সারাংশ। কখনো কখনো এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিবেচনা করা হয়। তবে প্রচলিত রীতিতে সাধারণত গদ্যের ভাব-সংক্ষেপণ বোঝাতে সারাংশও পদ্যের ভাব-সংক্ষেপণ বোঝাতে সারমর্ম কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সারমর্ম বনাম সারাংশ : বাংলায় সারমর্ম ও সারাংশের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যের অবকাশ আছে। সারাংশ বলতে বক্তব্যর সংক্ষিপ্ত মূল অংশকে বোঝায়। পক্ষান্তরে সারমর্ম বলতে বক্তব্যের বা ভাবের সংক্ষিপ্ত মূল অংশের (সারাংশের) মর্ম বা তাৎপর্যকে বোঝায়।
সারাংশ বনাম সার-সংক্ষেপ: সারাংশ ও সার-সংক্ষেপ উভয়েই মূলত গদ্য রচনা সংক্ষেপণের ব্যাপার হলেও এ দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে:
১. সার-সংক্ষেপ সাধারণত সারাংশের তুলনায় পরিসরে অনেক ছোট হয়ে থাকে। এক কথায় সার-সংক্ষেপ হচ্ছে সারাংশের সারাংশ।
২. সারাংশ মূলত সাহিত্যধর্র্মী রচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে এ ধরনের সংক্ষেপণ মনোজ্ঞ হয় এবং তাতে সাহিত্যের ভাবের আস্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু সার-সংক্ষেপণে রচনার সৌন্দর্য ও সৌকর্যের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। সার-সংক্ষেপণের ক্ষেত্রে মূলত দাপ্তরিক, বৈষয়িক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিই কাজ করে। ফলে যতটা সম্ভব সময় ও পরিসর সাশ্রয় করে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা সবচেয়ে সংক্ষেপে গুছিয়ে ও প্রাঞ্জল করে বলাই এক্ষেত্রে কাম্য।
৩. সারাংশের ক্ষেত্রে নামকরণ বা শিরোনাম সংযোজনের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সার-সংক্ষেপের ক্ষেত্রে নামকরণ বা শিরোনাম সংযোজন প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়।
সারমর্ম/সারাংশ বনাম ভাব-সম্প্রসারণ: সারমর্ম/সারাংশ বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভাব-সম্প্রসারণের বিপরীত। সারমর্ম/সারাংশে কোনো বিশদ বা পল্লবিত ভাবের মধ্য থেকে তার মূলটুকু খুঁজে নিয়ে তা খুব সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়। পক্ষান্তরে ভাব-সম্প্র্রসারণে মূল ভাবকে বিশদ ও বর্ধিত আকারে প্রকাশ করার জন্যে তাকে সম্প্রসারিত করা হয়ে থাকে।
সারমর্ম/সারাংশ লেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি পরামর্শ:
সারমর্ম/সারাংশ লিখনে পারদর্শী হতে হলে শিক্ষার্থীকে তা নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়। চর্চা যত বেশি হয় ততই শিক্ষার্থী পক্ষে রচনার মূল ভাববস্তু উপলব্ধির ক্ষমতা ও রচনা- নৈপুণ্য বাড়ে। সারমর্ম/সারাংশ লেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দিকগুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখা দরকার।
পঠন: প্রদত্ত অংশের মূল ভাবটুকু সংলাপ, উদাহরণ, উপমা, রূপক ইত্যাদির আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে। সারমর্ম বা সারাংশ লিখতে গেলে মূল অনুচ্ছেদের তথ্য লিখলে চলে না, মূল ভাব বুঝে নিয়ে তাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতে হয়। তাই প্রথমেই মূল ভাব অনুধাবন করতে হয়। এজন্যে রচনাটি বারবার মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার। মাত্র একবার কি দুবার ভাসাভাসাভাবে চোখ বুলিয়ে সারমর্ম লেখা শুরু করলে মূল ভাবটি চোখে নাও পড়তে পারে।
মূল ভাব সন্ধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিহ্নিতকরণ: প্রদত্ত রচনাংশে সাধারণত একটি মূল ভাব থাকে (বিরল ক্ষেত্রে একাধিক মূল ভাবও থাকতে পারে)। মূল ভাবটি উপলব্ধি করতে পারলে সারমর্ম/সারাংশ লেখা সহজ হয়। প্রদত্ত পাঠ থেকে মূল ভাব সন্ধানের একটা ভালো উপায় হচ্ছে, যেসব বাক্য বা বাক্যাংশ মূল ভাবের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করা। এভাবে অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ আলাদা করার মাধ্যমে সহজে মূল ভাব বের করা যায়।
বাহুল্য বর্জন : সারমর্ম/সারাংশ যেহেতু মূল ভাবের সংক্ষেপণ সে জন্যে প্রদত্ত অংশে যেসব বাহুল্য থাকে তা যথাসম্ভব বর্জন করতে হয়। এজন্যে মূল রচনাংশে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি, বর্ণনা, সংলাপ, উদাহরণ, অলংকার (উপমা-রূপক ইত্যাদি) থাকলে সেগুলো বাদ দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় মূল ভাবকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে এসব ব্যবহৃত হয় বলে বাদ দেয়ার আগে এসবের প্রয়োগের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য খোঁজা উচিত। তাহলে ভাববস্তুর মর্মমূলে পৌঁছানো সহজ হয়। কাহিনী বা বর্ণনামূলক রচনার ক্ষেত্রেও সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পরিবর্তে মূল ভাবটুকু নিয়ে নিতে হয়।
ভিন্নতর প্রসঙ্গের অবতারণা: সারমর্ম/সারাংশ অবশ্যই মূল রচনার ভাবধারণার মধ্যে সীমিত থাকে। তার বাইরের কোনো প্রসঙ্গ বা বিষয়ের উপস্থাপনা চলে না। মূল ভাবের বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তিগত মতামত, বা মন্তব্য প্রকাশের কোনো সুযোগ সারমর্মে/সারাংশে নেই। অন্যত্র প্রয়োজনে রচয়িতার নাম উল্লেখের সুযোগ থাকলেও পরীক্ষার বেলায় রচয়িতার নাম উল্লেখ করতে হয় না।
সারমর্ম/সারাংশ রচনা-কৌশল:
অনুচ্ছেদ: সারমর্ম/সারাংশ একটি অনুচ্ছেদে লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রারম্ভিক বাক্য: প্রারম্ভিক বাক্য যথাসম্ভব সুসংহত ও আকর্ষণীয় হতে হবে, যেন পাঠক বা পরীক্ষক পড়তে শুরু করেই চমৎকৃত হন।
প্রসঙ্গ বাক্য: প্রসঙ্গ বাক্য (মূল ভাবটুকু প্রকাশের চুম্বক বাক্য) সারমর্ম/সারাংশের প্রথমে থাকলে ভালো। তা প্রয়োজনে মধ্যে থাকতে পারে কিংবা তা দিয়ে সারমর্ম/সারাংশ শেষ হতে পারে।
প্রত্যক্ষ উক্তি: মূলে প্রত্যক্ষ উক্তি থাকলে তাকে পরোক্ষ উক্তিতে পরিবর্তন করে সংক্ষিপ্ত করতে হয়।
পুরুষ: সারমর্মে উত্তম পুরুষ (আমি, আমরা) ও মধ্যম পুরুষ (তুমি, তোমরা) পুরোপুরি বর্জনীয়। বক্তব্য বিষয় যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিক হওয়া উচিত। প্রয়োজনে প্রথম পুরুষের (সে, তিনি, কবি, বিধাতা) ব্যবহার চলে।
উদ্ধৃতি: মূলের উদ্ধৃতাংশ সারমর্মে উদ্ধৃতিচিহ্ন বর্জিত হয়ে এবং সংক্ষিপ্ত ও সংহত রূপে গ্রহণীয়।
ভাষা: ভাষা যথাসম্ভব বিষয়োচিত হওয়া ভালো। মূল রচনা আবেগধর্মী বা মননধর্মী হলে সেই অনুসারে সারমর্ম/সারাংশও আবেগধর্মী হওয়া উচিত। সারমর্ম/সারাংশ রচনার ক্ষেত্রে জটিল বাক্যের পরিবর্তে সরল বাক্য এবং দুরূহ শব্দের পরিবর্তে সহজ-সরল সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে ভাষাকে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল করলে ভাল হয়।
পুনর্লিখন: মূল গদ্য বা পদ্যের কোন অংশের হুবহু উদ্ধৃতি বা পুনর্লিখন সারমর্ম/সারাংশে কোনো অবস্থাতেই গ্রহণীয় নয়। মূলের কোনো অংশকে সামান্য অদল-বদল করে লিখে দেয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। এসব পন্থা সারমর্ম/সারাংশ লিখনের রীতিবিরুদ্ধ।
পরিসর: সারমর্ম/সারাংশ কত বড় বা ছোট হবে তা নির্ভর করে প্রদত্ত অংশে বর্ণিত বিষয়ের গুরুত্ব ও গভীরতার ওপর। প্রদত্ত রচনার ভাববস্তু, সুসংহত ও নিরেটভাবে প্রকাশিত হলে তা সংক্ষেপ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সারমর্ম/সারাংশ মূলের সমান, অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ বা তার কমও হতে পারে। তবে সাধারণভাবে গদ্যাংশের সারাংশ শব্দ সংখ্যার দিক থেকে এক-তৃতীয়াংশ বা তার কম হওয়া উচিত। পদ্যাংশের সারমর্মের পরিসর নির্ধারণ করা সুকঠিন। যতটা সংক্ষেপে মূল ভাব প্রকাশ করা যায় ততই ভালো।
ভাষিক সৌন্দর্য ও সৌকর্য: সারমর্ম/সারাংশ সুখপাঠ্য ও সুসংহত করার দিকে লক্ষ রাখা উচিত। প্রদত্ত অংশের মূল ভাবটি সংক্ষেপে উপস্থাপনা যথাসম্ভব সরল, প্রাঞ্জল, সাবলীল এবং সৌন্দর্য ও সৌকর্যম-িত হওয়া উচিত।
পরিমার্জন: সারমর্ম/সারাংশ লেখার সময়ে প্রথমে প্রদত্ত রচনার মূল ভাবটুকু নিয়ে তার আলোকে একটা প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করানো ভালো। তারপর তাতে প্রয়োজনমতো রদবদল ঘটিয়ে পরিমার্জিত রূপটি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করে পুনর্লিখন করে নিতে হয়। সময় হাতে থাকলে এবং প্রয়োজন মনে করলে পরীক্ষার খাতায় বাঁ দিকের পৃষ্ঠায় খসড়া করে ডানদিকের পৃষ্ঠায় পরিমার্জিত রূপটি লেখা যেতে পারে। পরিমার্জিত রূপটি লেখা হবার পর খসড়া অংশ কেটে দিয়ে বর্জিত উত্তর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।
সারাংশ    
১. অপরের জন্য তুমি প্রাণ দাও, আমি তা বলতে চাই নে। অপরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর কর। অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্টি কথা বল। পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটু করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ কর, তা’হলেই অনেক হবে। চরিত্রবান, মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশি অধীর হন, পরের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরব বোধ করে।
সারাংশ: পরের জন্যে জীবন বিলিয়ে না দিয়েও মানুষের উপকারে ব্রতী হওয়া যায়। দুঃখী মানুষের ছোট ছোট দুঃখ দূর করা, অসহায় মানুষের মনে আশা জাগানো, কিংবা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো ছোট ছোট উপকারে ব্রতী হওয়ার মধ্যেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ ঘটে।
২. অভাব আছে বলিয়াই জগৎ বৈচিত্র্যময়। অভাব না থাকিলে জীব-সৃষ্টি বৃথা হইত। অভাব আছে বলিয়াই পূরণের জন্য এত উদ্যম, এত উদ্যোগ। আমাদের সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়াই কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলকেই স্থাণু, স্থবির হইতে হইত, মনুষ্য-জীবন বিড়ম্বনাময় হইত। মহাজ্ঞানীরা জগৎ হইতে দুঃখ দূর কবিবার জন্য ব্যগ্র। কিন্তু জগতে দুঃখ আছে বলিয়াই তো আমরা সেবার সুযোগ পাইয়াছি। সেবা মানব-জীবনের ধর্ম। দুঃখ আছে বলিয়াই সে সেবার পাত্র যত্রতত্র সদাকাল ছড়াইয়া রহিয়াছে। যিনি অন্নদান, বস্ত্রদান, জ্ঞানদান, বিদ্যাদান করেন, তিনি যেমন জগতের বন্ধু তেমনি যিনি দুঃখে আমাদের সেবার পাত্রে অজস্র দান করিতেছেন, তিনিও মানবের পরম বন্ধু। দুঃখকে শত্রু মনে করিও না, দুঃখ আমাদের বন্ধু।
সারাংশ:  জীবনে অভাব আছে বলে জীবন হয়েছে বৈচিত্র্যময়। অভাব জীবনকে দিয়েছে কর্মের তাড়না। জীবনে যে দুঃখ আছে মহৎ জ্ঞানী-গুণীরা তা দূর করার সাধনা করেন। কিন্তু দুঃখ আছে বলেই মানুষ পরহিতব্রতী হতে পারে। তাই দুঃখ মানুষের শত্রু নয়, বন্ধু।
৩. অভ্যাস ভয়ানক জিনিসÑএকে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে ধীর ও সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক কর সপ্তাহে অন্তত একদিন মিথ্যা বলবে না। ছ’মাস ধরে এমনি করে নিজে সত্য কথা বলতে অভ্যাস কর। তারপর এক শুভ দিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা কর, সপ্তাহে তুমি দু’দিন মিথ্যা বলবে না এক বছর পরে দেখবে সত্য কথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। সাধনা করতে করতে এমন একদিন আসবে যখন ইচ্ছা করলেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামে তুমি হঠাৎ জয়ী হতে কখনও ইচ্ছা করো নাÑতাহলে সব প- হবে।
সারাংশ:  মনুষ্যত্বের সাধনায় চাই ধীরতা ও সহিষ্ণুতা। সত্যবাদী হতে হলে সত্য বলার অভ্যাস গঠন ও মিথ্যা বলার প্রবণতা দূর করার জন্যে দীর্ঘদিনের সাধনায় ব্রতী হতে হয়। পাপ ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্যেও চাই সাধনা। একদিনের চেষ্টায় তাতে সফল হওয়া যায় না।
৪. অমঙ্গলকে হাসিয়া জগৎ হইতে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিও না। তাহা হইলে মঙ্গলসমতে উড়িয়া যাইবে। মঙ্গলকে যেভাবে গ্রহণ করিয়াছ অমঙ্গলকে সেইভাবে গ্রহণ কর। অমঙ্গলের উপস্থিতি দেখিয়া ভীত হইতে পার, কিন্তু বিস্মিত হইবার হেতু নাই। অমঙ্গলের উৎপত্তির অনুসন্ধান করিতে যাইয়া হাবুডুবু খাইবার দরকার নাই। যেদিন জগতে মঙ্গলের আবির্ভাব হইয়াছে সেইদিনই অমঙ্গলের যুগপৎ উদ্ভব হইয়াছে। একই দিনে, একই ক্ষণে, একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উভয়ের উৎপত্তি। এককে ছাড়িয়া অন্যের অস্তিত্ব নাই, এককে ছাড়িয়া অন্যের অর্থ নাই। যেখান হইতে মঙ্গল, ঠিক সেইখান হইতেই অমঙ্গল। সুখ ছাড়িয়া দুঃখ নাই, দুঃখ ছাড়িয়া সুখ নাই। একই প্রস্রবণে, একই নির্ঝর ধারাতে উভয় স্রোতস্বতী জন্মলাভ করিয়াছে; একই সাগরে উভয়ে গিয়া মিশিয়াছে।
সারাংশ: মঙ্গল-অমঙ্গল, সুখ-দুঃখ মানবজীবনে সতত প্রবহমান অবিচ্ছেদ্য ধারা। অমঙ্গল আছে বলেই মঙ্গলকে উপভোগ করা যায়। দুঃখ আছে বলেই সুখের স্বরূপ বোঝা যায়। তাই জীবনে সুখ-দুঃখ উভয়কেই মেনে নিতে হবে।
৫. আজকের দুনিয়াটা আশ্চর্যভাবে অর্থের বা বিত্তের ওপর নির্ভরশীল। লাভ ও লোভের দুর্নিবার গতি কেবল আগে যাবার নেশায় লক্ষ্যহীন প্রচ- বেগে শুধুই আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। মানুষ যদি এই মূঢ়তাকে জয় না করতে পারে, তবে মনুষ্যত্ব কথাটাই হয়তো লোপ পেয়ে যাবে। মানুষের জীবন আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর হয়তো নামবার উপায় নেই, এবার উঠবার সিঁড়িটা না খুঁজলেই নয়।
সারাংশ:  বর্তমান বিশ্বে মানুষের মহিমার চেয়ে অর্থের হিসাব হয়ে উঠেছে বড়। ফলে মানবসমাজ এক চরম অধোগতির মুখে এসে ঠেকেছে। তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় এখনই খুঁজতে হবে।
৬. কবিতার শব্দ কবির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির প্রতীক। বাক্যের মধ্যে অথবা পদবন্ধের মধ্যে প্রত্যেকটি শব্দ আপন আপন বৈশিষ্ট্যতায় উজ্জ্বল। যারা কবিতা লিখবেন, তাদের মনে রাখতে হবে যে, অনুভূতিদীপ্ত শব্দসম্ভার আয়ত্তে না থাকলে, প্রত্যেকটি শব্দের ঐতিহ্য সম্পর্কে বোধ স্পষ্ট না হলে, কবিতা নিছক বাকচাতুর্য হয়ে দাঁড়াবে মাত্র। কবিতাকে জীবনের সমালোচনাই বলি বা অন্তরালের সৌন্দর্যকে জাগ্রত করবার উপাদানই বলি, কবিতা সর্বক্ষেতেই শব্দের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই শব্দকে আমাদের চিনতে হবে।
সারাংশ:  কবিতার মূল উপাদান শব্দ। ব্যঞ্জনাময়, অনুভূতিদীপ্ত শব্দের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে কবিতার শরীর। সুতরাং কবিতার মাধ্যমে জীবনের সমালোচনা করা হোক কিংবা সৌন্দর্যের জগৎ নির্মাণ করা হোক, কবিতার সার্থকতা নির্ভর করে যথার্থ ভাবব্যঞ্জক উপযুক্ত শব্দ চয়নের উপর।
৭. কিসে হয় মর্যাদা? দামি কাপড়, গাড়ি-ঘোড়া, না ঠাকুর-দাদার কালের উপাধিতে? না, মর্যাদা এসব জিনিসে নেই। আমি দেখতে চাই তোমার ভিতর, তোমার বাহির, তোমার অন্তর। আমি জানতে চাই, তুমি চরিত্রবান কি-না, তুমি সত্যের উপাসক কি-না। তোমার মাথা দিয়ে কুসুমের গন্ধ বেরুয়, তোমায় দেখলে দাস-দাসী দৌড়ে আসে, প্রজারা তোমায় দেখে সস্ত্রস্ত হয়, তুমি মানুষের ঘাড়ে চড়ে হাওয়া খাও, মানুষকে দিয়ে জুতা খোলাও, তুমি দিনের আলোতে মানুষের টাকা আত্মসাৎ করো। বাপ-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি তোমায় আদর করেন, আমি তোমায় অবজ্ঞায় বলবো, যাও।
সারাংশ: অর্থ, বিত্ত, বংশমর্যাদা, শক্তির দাপট মানুষকে দাম্ভিক ও অহংকারী করে; মর্যাদা দেয় না। মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে মহৎ মানবিক গুণাবলির উপর। চরিত্রবান, সত্যবাদী মানুষ ও জ্ঞানী-গুণীজনরাই জীবনে প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হন।
৮. ক্রোধ মানুষের পর শত্রু। ক্রোধ মানুষের মনুষ্যত্ব নাশ করে। যে লোমহর্ষক কা-গুলি পৃথিবীকে নরকে পরিণত করিয়াছে, তাহার মূলেও রহিয়াছে ক্রোধ। ক্রোধ যে মানুষকে পশুভাবাপন্ন করে, তাহা একবার ক্রুদ্ধ ব্যক্তির মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে ব্যক্তির মুখখানা সর্বদা হাসিমাখা, দেখিলেই তোমার মনে আনন্দ ধরে না, একবার ক্রোধের সময় সেই মুখখানির দিকে তাকাইও; দেখিবে, সেই স্বর্গের সুষমা আর নাইÑনরকাগ্নিতে বিকট রূপ ধারণ করিয়াছে। সমস্ত মুখ কী এক কালিমায় ঢাকিয়া গিয়াছে। তখন তাহাকে আলিঙ্গন করা দূরে থাকুক, তাহার নিকটে যাইতেও ইচ্ছা হয় না। সুন্দরকে মুহূর্তের মধ্যে কুৎসিত করিতে অন্য কোন রিপু ক্রোধের ন্যায় কৃতকার্য হয় না।
সারাংশ: মানুষের বড় শত্রু ক্রোধ। তা মানুষের মনুষ্যত্বের অন্তরায়। পৃথিবীতে যত অমানবিক নারকীয় ঘটনা ঘটে তার জন্যে মূলত ক্রোধই দায়ী। ক্রোধ মানুষকে নিয়ে যায় পশুর পর্যায়ে। মানুষের সুন্দর চেহারাকে করে দেয় কুৎসিত।
৯. খুব ছোট ছিদ্রের মধ্য দিয়ে যেমন সূর্যকে দেখা যায়, তেমনি ছোট ছোট কাজের ভিতর দিয়েও কোন ব্যক্তির চরিত্রের পরিচয় ফুটে উঠে। বস্তুত মর্যাদাপূর্ণভাবে ও সুচারুরূপে সম্পন্ন ছোট ছোট কাজেই চরিত্রের পরিচয়। অন্যের প্রতি আমাদের ব্যবহার কিরূপ তাই হচ্ছে আমাদের চরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা। বড়, ছোট ও সমতুল্যের প্রতি সুশোভন ব্যবহার আনন্দের নিরবচ্ছিন্ন উৎস।
সারাংশ: ছোট ছোট কাজ ও অন্যের প্রতি আচরণের মাধ্যমেই মানুষের চরিত্র-পরিচয় ফুটে ওঠে। সমাজের সবার প্রতি শোভন ও সমান ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষ রুচিশীল ও আনন্দময় জীবন রচনা করতে পারে।
১০. গুরুর আবশ্যক শিষ্যকে কতগুলি বুলি মুখস্থ করার জন্য নয়, তীক্ষè পর্যবেক্ষণের দ্বারা শিষ্যের আত্মার সামর্থ্য ও  বৈশিষ্ট্যের খোঁজ নিয়ে তাকে স্বীয় সত্তায় প্রতিষ্ঠিত করা। শিষ্যের যিনি প্রকৃত গুরু তিনি তার অন্তরেই বিরাজমান; বাইরে গুরুর কার্য এই অন্তর গুরুর সঙ্গে শিষ্যের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এইভাবে শিক্ষা পদ্ধতি চললে দেখতে পাব, সব ছেলেরই কিছু-না-কিছু শক্তি আছে, কোন ছেলেই একেবারে বাজে নয়। সুতরাং শিক্ষাবস্তুকে নয়, শিক্ষার্থীর অন্তরকে বড় করে দেখে তার ভিতরকার শক্তিকে জাগ্রত করাই যেন শিক্ষার লক্ষ্য হয়।
সারাংশ:  শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীর আত্মশক্তির জাগরণ ঘটানো শিক্ষার্থীকে কিছু বুলি মুখস্থ করিয়ে সেটা অর্জন করা যায় না। প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীর অন্তরের সত্তাকে জাগিয়ে তোলেন এবং বাইরের জগতের সঙ্গে তার পরিচয় ও সমন্বয় ঘটিয়ে দেন।
১১. জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সুখী করতে হলে শিক্ষা ও জ্ঞান বর্ষার বারিপাতের মতো সর্বসাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও সহজ ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কাজ সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটা জাতির মানসিক ও পার্থিব অবস্থার পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সংকীর্ণতাকে পরিহার করে একটা বিনয়-মহিমোজ্জ্বল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে, মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম মনে করে, আত্মমর্যাদা, জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং গভীর দৃষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট জাতির বিরাট দেহে বিরাট শক্তি জেগে ওঠে।
সারাংশ: জাতির সর্বতোমুখী উন্নতির জন্যে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার দরকার। সহজ ও সরল ভাষায় বই লেখা হলে তা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথকে সুগম করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহৎ জীবনে ব্রতী করতে পারে। এভাবেই জাতির মধ্যে আত্মশক্তির জাগরণ ঘটে এবং জাতি হয় মহৎ ও উন্নত।
১২. জীবন বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তা-ই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ্য রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটাসোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোন মালী গাছের গোড়ায় জল ঢালে না। সমাজ-ব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে তুলবার জন্য নয়, মানুষের চিত্তে জাগে তখন এক আধ্যাত্মিক সুষমা এবং সে সুষমায় তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারই প্রতিফলনে সমস্ত জগৎ আলোকময় হয়ে দেখা দেয়। ফলে মানুষ ইতর জীবনের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে লঘুপক্ষ প্রজাপতির মতো হালকা মনে করে।
সারাংশ: মনুষ্যত্ব জীবন-বৃক্ষের ফুলের মতো। সমাজের দায়িত্ব মানুষের জীবনকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যেন মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। মনুষ্যত্বের ভিত্তি হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ, যার প্রকাশ ঘটে মানুষের সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দবোধে। মানুষের জীবনে মনুষ্যত্বের আলো জ্বলে উঠলে সে আলোয় বিশ্ব হয় আলোকিত আর মানবজীবন হয় সার্থক ও ভারমুক্ত।
১৩. ধনে কি মানুষ বড় হয়? ধনের বড় মানুষ কখনই মনের বড় মানুষ নহে, ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই মানুষ। আমি ধন দেখিয়া তোমাকে সমাদর করিব না, জন দেখিয়া তোমার আদর করিব না, সিংহাসন দেখিয়া তোমার সম্মান করিব না, বাহুবলের জন্য তোমায় সম্ভ্রম করিব নাÑকেবল মন দেখিয়া তোমার পূজা করিব। তুমি যদি স্বয়ং অমানুষ হও, অথচ দ-ধর হইয়া আমাকে দ-করণে উদ্যত হও, তথাপি আমি দ-ভয়ে কদাচ দ-বৎ করিব না। কিন্তু তুমি যদি পবিত্রচিত্তে সাধুভাবে ভিক্ষার ঝুলি ধারণ করিয়া আগমন কর, তবে তোমার দর্শনমাত্রেই তৎক্ষণাৎ আমি ধূলি ধূসরিত হইয়া পদতলে প্রণত হইব। অতএব যদি মানুষ হইবার অভিলাষ থাকে, তবে মনকে বিমল কর ও সরল হও।
সারাংশ:  বিত্ত ও ক্ষমতার দাপটে মানুষ বড় হয় না, বড় হয় নৈতিক চরিত্র ও মনের ঐশ্বর্যে। তাই যারা সৎ, সাধু ও চরিত্রবান তারাই বড় মাপের মানুষ এবং প্রকৃত সম্মান প্রাপ্য তাদেরই। নিজেকে বড় মনে করলেই কেউ বড় হয় না। বড় হতে হলে উদার ও মহৎ গুণের অধিকারী হতে হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন