Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাদামনের মানুষের দেশ মরক্কো

| প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : সাহারা মরুভূমির দেশ মরক্কোর রাজধানী রাবাত হলেও টেটোয়ান মরক্কোর একেবারে উত্তরে ভূমধ্যসাগরের পারে রিফ পর্বতমালার ওপর গড়ে ওঠা পুরনো এক বন্দরনগরী। সৌভাগ্যক্রমে একজন ভ্রমণপিপাসু হিসেবে এ বন্দরনগরী দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এর লোকসংখ্যা ৫ লাখের একটু কম। ‘বারবার’ ভাষার শব্দ ‘টেটোয়ান’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘চোখ’ হলেও আলঙ্কারিত অর্থে টেটোয়ান বলতে বোঝায় ‘পানির ফোয়ারা’। এটা যে একটা চোখজুড়ানো, মনমাতানো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যম-িত আরব জনপদ, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এর ইতিহাস শ’শ’ বছরেরও বেশি। স্পেনে মুসলমানি আমলে অষ্টম শতক-পরবর্তী সময়ে টেটোয়ানের গুরুত্ব ছিল তুঙ্গে। কারণ তখন এ শহরই মরক্কো এবং আন্দালুসিয়ার একমাত্র যোগসূত্র হিসেবে কাজ করত। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে টেটোয়ানের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ফরাসির চেয়ে স্প্যানিশ প্রভাব অনেক বেশি।
মরক্কো কোনো তেল বা গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ নয়, আবার খুব ধনীও নয়, তথাপি এখানে কেউ মাটির ঘরে থাকে না, কুঁড়েঘরে থাকে না, টিনের ঘরেও না। সবাই পাকা দালানের বাসিন্দা। ঘরগুলো সব সাদা রঙের। দূর থেকে টেটোয়ানকে দেখলে মনে হয় সাদা কংক্রিটের চাদরে ঢাকা পাহাড়, যেন এক বিশাল তাঁবু। মরক্কো কোনও গণতান্ত্রিক দেশ নয়, এখানকার শাসনভার রাজার হাতে। এ রাজপরিবারের রয়েছে শত শত বছরের বাদশাহি ঐতিহ্য। রাজতন্ত্র হলেও সে-দেশের শাসক স্বৈরতান্ত্রিক নয়, জনগণও নির্যাতিত নয়। নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বা বিশ্বাস করতাম না, মরক্কোর রাজার সমালোচনা করলেও পেছনে গোয়েন্দা লাগে না, পুলিশ তাড়া করে না। হোটেলের ডেস্ক ক্লার্ককে দেয়ালের ছবি দেখিয়ে বললাম, ‘Who is this man?' 'He is our kung’ না বলে অত্যন্ত মহবতের সঙ্গে গর্ব ভরে বলল, ‘ÔHe is my king!' 'My king’ যে ‘Our king’-এর চেয়ে অনেক আপন, তা তার কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠে। টেটোয়ানের পাহাড়ের গায়ে গাছপালা তেমন নেই, মাটি বা পাথর যাই বলুন-দেখতে সাদা সাদা, চুনা পাথরের মতো। এ নগরীর পাহাড়ের মাটি সাদা, পাথর সাদা, দালানকোঠা সাদা। মাত্র তিন দিন সেখানে থেকে টেটোয়ানবাসীর যেটুকু পরিচয়ই পেয়েছি, তাতে মনে হয় তারা সাদা মনের মানুষই বটে!
হোটেলে চেক-ইন করে রুমে গেলাম, গোসল সেরে নামাজ পড়ে খেতে এলাম হোটেলের রেস্তোরাঁয়, তখনও সন্ধ্যা নামেনি। দেখতে পেলাম ওয়াটার-কাম-শেফ অবসরে বসে ঝিমোচ্ছেন। ডিনারে আমিই প্রথম কাস্টমার। বিমানে এক তরুণ মরক্কান সহযাত্রী আগেই বলে দেন, টেটোয়ান গিয়ে কী কী খেতে হবে। তার কথামতো আমিও ঠিক করেছি প্রথম দিন খাব মরক্কান ডেলিকেসিÑ ‘তাজিন’, পরদিন ‘পাস্টেলো’ এবং শেষ দিন ‘কুসকুস’। মরক্কোর সুস্বাদু খাবারের মধ্যে তিনি প্রথমেই ‘কুসকুস’-র কথা বলেন। আমি ভুরু কুঁচকে জবাব দিয়েছিলাম, ‘কুসকুস’ তো অনেক খেয়েছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় খেয়েছেন?’ আমার উত্তর, ‘লন্ডনে খেয়েছি, আমেরিকায় খেয়েছি, আরব বন্ধুদের বাড়িতে খেয়েছি, মসজিদে খেয়েছি, রেস্তারাঁয়ও খেয়েছি।’ অত্যন্ত আস্থা ও গর্বের সঙ্গে এবার তিনি জানান, ‘ওই কুসকুস’ আর ‘এই কুসকুস’ এক হবে না, আপনি এখানে একবার খেয়ে যান, তফাৎটা বুঝতে পারবেন!’ পরিকল্পনামাফিক প্রথম দিন অর্ডার করলাম ‘তাজিন’। খেয়ে মনে হলো, টেটোয়ানের ‘তাজিন’ নয়, যেন দিল্লি কা লাড্ডু! বুঝতেই পারছেন, হতাশ হলাম। মনে মনে বললাম, ঠকা খেলাম, ‘কুসকুস’ নিলেই বুঝি ভালো করতাম। স্বাদে আহামরি কিছু না হলেও তাজিন দিয়ে পেট ভরাতে সেদিন আমার কোনও অসুবিধা হয়নি, কারণ খিদে ছিল যে! টেটোয়ানে আরও দু’দিন থাকলেও আফসোস, এ যাত্রা আমার কিন্তু পাস্টেলো এবং ‘কুসকুস’ খাওয়া হয়নি। কেন হয়নি, সে দুঃখের কথা বলতে গেলে এর চেয়ে মজার কাহিনী বাদ পড়ে যাবে, তাই সেদিকে আজ আর নেই বা গেলাম। গরম পানীয়র মধ্যে টার্কিশ কফি এবং মরক্কান টি দুটোই বিখ্যাত। টার্কিশ কফি সার্ভ করা হয় ছোট্ট চায়ের পেয়ালায় আর চা-রসিকরা মরক্কান টি এস্তেমাল করে থাকেন ছোট্ট পুরু কাচের গ্লাসে। একটা যেমনই ঘন, আরেকটা তেমনই পাতলা। টার্কিশ কফি ঘন কালো রঙের, ওপরে বাদামি ফেনা ওঠা, মরক্কান টি পাতলা। দুটোর রং ভিন্ন, স্বাদও ভিন্ন, তবে দুটোই খেতে আচ্ছা মজাদার!
ডিনারের পালা চুকিয়ে লবি এরিয়োতে একটু ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। ফজরে ওয়েকআপ কলের জন্য ফ্রন্ট ডেস্কে অনুরোধ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। বিছানা বদলে সবসময়ই আমার ঘুমের অসুবিধা হয়, কিন্তু সে রাতে ঘুম হলো খুব ভালো। ওয়েকআপ কলের একটু আগেই ঘুম পুরো হয়ে গেল। উঠে জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে দেখতে পেলাম সামনেই ‘ড্রিমস’ হোটেল। দুই হোটেলের মাঝখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা তিন-চার একরের একটা খোলা ময়দান। নিরিবিলি দশ-বারোটা গরু ঘাস খাচ্ছে, আলো-আঁধারীর মাঝে লাঠি হাতে একজন রাখালও হাঁটাহাঁটি করছে। কার্যত অন্ধকার! এত ভোরবেলা রাখাল গরু নিয়ে বেরিয়েছে, তা-ও আবার শহরের ভেতর। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ অবাক লাগছিল! ভাবছিলাম, বাহ! বেশ মজার দেশ তো! এমন সময় মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি, ফজরের আজানÑ ‘‘আল্লাহু আকবর...’’। এক মুয়াজ্জিনের আজান শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল বহু মুয়াজ্জিনের আহ্বান, বিস্ময়ের আর শেষ রইল না! অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক মসজিদ থেকে মাইকে ভেসে আসা আজানের আওয়াজ। এদিকে মোরগের ডাকে আমার কাছে মনে হলো, আমি যেন আমার গ্রামের বাড়ি বা নানার বাড়িতে শুয়ে আছি আর ফজরের আগে মোরগের ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠছি। গল্প নয়, সত্যি, ইটপাথরের নগর, টেটোয়ানের মাঝখানে ফজরের সময় মোরগের ডাক, এক-দুটো নয় অনেকগুলো আসছে একই দিক থেকে, ‘কুকুরুক্কু..., কুকুরুক্কু...’, একটা থেকে আরেকটার গলায় তেজ বেশি! কান খাড়া করে কতক্ষণ শুনলাম, উপভোগ করলাম! গত চল্লিশ বছরে এমন প্রাণকাড়া মোরগের ডাক আমি আর কোথাও শুনিনি। মনে মনে ভাবলাম, শুধু আধুনিক জমানার ইন্টারনেটই বিশ্বায়নের জন্ম দেয়নি, বিশ্বায়ন তো সর্বজনীন, সর্বকালের! সব দেশের মোরগ একই সময়, একইভাবে ডাকে, একই ফ্রিকোয়েন্সি এবং একই ওয়েভলেন্থে আজান দেয়, নামাজের জন্য মানুষকে আহ্বান করে, কেউ শোনে, কেউ শোনে না, কেউ সাড়া দেয়, কেউ দেয় না! সৃষ্টির শুরুতে সবকিছুর মাঝেই আল্লাহতায়লা বিশ্বায়নের বীজ ছড়িয়ে রেখেছেন। কখন কোন বীজ কীভাবে অঙ্কুরিত হয়, তা সবসময় আমরা বুঝতেও পারি না, আর বোঝার চেষ্টাই বা করে ক’জন?
নামাজ পড়ে নিচে নামলাম। রেস্তারাঁ খুলেছে কিন্তু নাস্তা তৈরি হয়নি। লবিতে গেলাম ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে, সহযোগিতা নিলাম কম বয়সী একজন গাইডের। যা দেখতে চাইনি, তা-ই দেখলাম, যা পড়তে চাইনি, তা-ই পড়লাম। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলিদের খুনখারাবির কথা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল! নাস্তার পর ভাড়াকরা গাড়ি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ দেখতে বের হলাম, সঙ্গে একজন গাইড দেয়া হলো হোটেল থেকে। তিনিই সব দেখালেন ও বুঝালেন। পরদিন শুক্রবার, বন্ধের দিন, করার কিছু নেই। সারা দিন শুয়ে-বসে হোটেলেই কাটালাম। বিকেলের দিকে আর সময় কাটছিল না। তাই রাস্তায় বেরিয়ে ফুটপাত ধরে বাঁদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। একদিকে হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, কার ডিলারশিপ, অন্যদিকে আবাসিক এলাকা। চার লেনের চওড়া রাস্তা। মাঝখানে আইল্যান্ড আছে। আমি রাস্তা পেরিয়ে মানুষের বাড়িগুলো দেখছিলাম। চারদিকে দেয়াল ঘেরা ভিলা টাইপের বড় বড় বাড়ি। বড়লোকদের বাস। উঁচু উঁচু দেয়াল আর বন্ধ গেটের কারণে ভেতরে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে সবার ঘরের সামনে যে ফুলের বাগান আছে, তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। অনেকের দেয়ালের বাইরেও আছে সাজানো ফুলবাগিচা। কত জাতের বাহারি ফুল দেখলাম! একমাত্র জবা ছাড়া আর কোনো ওটাই চিনলাম না। আরেকটা ফুল দেখলাম বেলি আর শিউলির মাঝামাঝি ছোট ছোট সাদা সাদা ফুল, গাছে ফুটে আছে থরে থরে, মাটিতে ঝরে পড়েও আছে। খুশবুতে ম-ম করছে গাছতলা, কিন্তু ফুলের নামধাম কিছুই জানা হলো না। মৌমাছির গুনগুন, প্রজাপতির ওড়াওড়ি যেমনটা দেখেছি গ্রেড ব্রিটেন, আমেরিকায়, সবই তো এক! এর মাঝে তফাৎ তো কিছুই ধরতে পারলাম না! মনে হলো, সারাটা পৃথিবী যেন হাজার লক্ষ, কোটি ফুলে গাঁথা একই মালা, একই আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি।
আরেকটু সামনে গেলাম, ট্রাফিক সার্কেল ঘুরে রাস্তা পেরিয়ে বাণিজ্যিক এলাকার দিকে এলাম। সামনে কোরিয়ান কার কোম্পানি ‘হোন্ডাই’র ডিলারশিপ। পাশে একটা বড় রেস্তারাঁ। অনেক মানুষ গমগম করছে। পেছনে ছোট্ট খেলার জায়গা, মহিলারা ছোট ছেলেমেয়েদের বিনোদনের জন্য নিয়ে আসছেন। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে, ‘সি সো’ খেলছে আর মা’রা বাইরে বসে চা/কফি খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। দেখতে পেলাম, ঘরে-বাইরে, বারান্দায়, দেয়ালে এবং খাম্বার সঙ্গে বড় বড় চ্যাপ্টা পর্দার টিভি ঝুলছে, মানুষজন চা/কফিতে মশগুল হয়ে মনের সুখে ফুটবল খেলা দেখছে। আমারও ইচ্ছা হচ্ছিল ওই আসরে বসে তাদের আনন্দে শরিক হই। কিন্তু অন্ধকার হয়ে আসছে বলে ও বেলা পদযাত্রায় ইতি টেনে হোটেলে ফিরে এলাম।
ট্যাক্সি ঠিক করে রেখেছি আগেই। কোনও রকম রাতটা পোহালেই বাড়ি ফেরার পালা। টেটোয়ান থেকে গাড়িতে রওনা দেব তানজিয়ার, সেখান থেকে বিমানে মাদ্রিদ, তারপর সিঙ্গাপুর হয়ে দেশে ফিরে আসার কথা। সোমবার সকাল ৮টা বাজতেই ট্যাক্সি এসে হাজির। আমিও খেয়েদেয়ে চেক-আউট করে লবিতে তৈরি। গাড়িতে উঠলাম, শুরু হলো আমার ফেরত যাত্রা। টেটোয়ান থেকে তানজিয়ার-ষাট-সত্তর মাইলের মতো পাহাড়ি পথ। আসার সময় শহর বাইপাস করে হাইওয়ে ধরে এসেছিলাম। এবার শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। কর্মচঞ্চল দিন শুরু হয়ে গেছে। মানুষ জীবিকার সন্ধানে এদিক-ওদিক ছুটছে। রাস্তায় নানা জাতের যানবাহন দেখছি। রাস্তাঘাটে হাঁটাচলায় প্রতি তিন কি চারজন নারী দেখলে একজন পুরুষ চোখে পড়ে। শহর পার হবার পর উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু দৃশ্য দেখলাম। রাস্তাটা একটু উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা, রিফ পর্বতমালা হলেও খুব উঁচু পাহাড় ও ঘন বন নয়। ছোট, বড়, মাঝারি আকারে টিলা ও খোলা প্রান্তর-আধা মরুভূমি-আধা শ্যামলিমায় ঢাকা রাস্তার দু’পাশ, কিন্তু কোথাও ডোবা-নালা নেই, খাল-নদী নেই, জলাভূমি নেই, এমনকি একটা পুকুরও নজরে পড়ল না। তা থাকবে কেন? এ যে উত্তর আফ্রিকা, সাহারা মরুভূমির দেশ! চাষিরা মাঠ চাষ করছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি দিয়ে, কোথাও হালের বলদ এবং লাঙলের দেখা পেলাম না। চাষ করা মাঠে সারস পাখির মতো এক জাতের সাদা সাদা বড় বড় পাখি হাঁটছে আর পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
কিছু দূর পরপর রাস্তার পাশে বিরাট বিরাট পটারির দোকান। পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। হাজারো জাতের পোড়া মাটির লাল লাল বাসন। এত মাটির বাসন দিয়ে এরা কী করে? ট্যাক্সি ড্রাইভার ইংরেজি তেমন জানে না, তাই খুব একটা জানা সম্ভব হয়নি। টিলার পাদদেশে আনাচে-কানাচে দলে দলে মেষ চরে খাচ্ছে, কোনও দলে রাখাল নেই, কোনও দলে আছে। সব পালেই দেখলাম ভেড়া বেশি, সঙ্গে দু’চারটা বকরিও দেখা যায়। এক মেষ রাখাল বিশেষভাবে আমার নজর কাড়ল। তার পরনে জোব্বা, বাঁ-বগলে এক মাঝারি আকারের গাট্টি এবং ডান হাতে লাঠি। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা ছবি ভেসে উঠল। সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে আরবের মরুভূমিতে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) তাঁর বালক বয়সে তো এভাবেই মেষ চরাতেন! ভেবে ভেবে আবেগে আপ্লুত হলাম! পাশে দেখতে পেলাম এক কুকুর। কুকুরটা রাখালের সরকারি, নাকি নেড়ি কুকুর, বুঝতে পারলাম না। চার লেনের ডিভাইডেড হাইওয়ে। লোকজনকে ব্রাশ দিয়ে মহাসড়কের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছি। তানজিয়ারের ঠিক প্রবেশমুখে ছোট্ট পুলিশ ফাঁড়ি। সেখানে দেখলাম এক লোক হাইওয়েতে ধুলো ঝাড় দিচ্ছে, ব্রাশ দিয়ে নয়, তাজা সবুজ খেজুরের ডাল দিয়ে।
টেটোয়ান থেকে তানজিয়ারের পুরো যাত্রাপথে যে বিষয়টা আমাকে নস্টালজিক করে তুলেছিল, তা হলো কিছু দূর পরপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসযাত্রীদের দৃশ্য। কোনও কোনও জায়গায় বাসের ডেজিগনেটেড স্টপ আছে, শেল্টারও আছে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকজনকে যত্রতত্র রাস্তার ধারে বাসের জন্য বসে থাকতে দেখেছি, দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। কোনও নারী বোরকা পরা, কেউ বোরকা ছাড়া ছাতা মাথায়, তবে কোনও মহিলাকেই পুরুষবিহীন দেখলাম না। নিদেনপক্ষে একটা দশ-বারো বছরের ছেলে হলেও সঙ্গে আছে। কোনও জায়গায় দেখেছি নবদম্পতি বাসের অপেক্ষায় আছেন, হয়তো শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন অথবা বেড়ানো শেষে বাড়ি ফিরে আসছেন। কোনও জায়গায় দেখেছি মা-বাবা ছেলেমেয়েসহ দাঁড়িয়ে আছেন গাছতলায়। তরুণ বয়সে আমি যখন সিলেট মদন মোহন কলেজে পড়তাম তখন জকিগঞ্জ থেকে চারখাই অথবা গোলাপগঞ্জ থেকে সিলেট যাওয়ার পথে এসব দৃশ্য সবসময় দেখতে পেতাম এবং খুব উপভোগ করতাম। মরক্কোর গ্রামের মানুষ পাকাঘরে থাকে কিন্তু তাদের গ্রামীণ সমাজে নারীদের চলাফেরার সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ নারীদের চলাফেরায় এক অপূর্ব মিল দেখতে পেলাম!
এভাবে রাস্তার দু’পাশে নানা দৃশ্য দেখে দেখে তানজিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। শহর ও জনসংখ্যার আন্দাজে মনে হলো, এয়ারপোর্টটা ছোট, বোর্ডিং ব্রিজ নেই, হেঁটে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠতে হয়। বিমানবন্দরে ব্যাগেজ চেক-ইন করে সিকিউরিটি পার হয়ে গেটে ওয়েটিং এরিয়াতে বসে আছি। সেখানে একটা মজার ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। আমার উল্টোদিকে বসে আছেন এক ভদ্রলোক, তার বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। সঙ্গে একটা ছোট্ট ছেলে, বয়স অনুমানিক চার কি পাঁচ হবে, তার নাম আনোয়ার। আনোয়ারের পাশে বসে আছে দুই বোন, আমার ঠিক সামনে। বড়টার নাম জামিলা, বয়স বারো কি তেরো। ছোটটার নাম আমিনা, সে হবে ১০/১২ বছর বয়সের। একটু দূরে অন্য বেঞ্চে বসে আছেন তাদের মা, হিজাব পরা মাঝ বয়সী মহিলা। পাশে জামিলার ভাই-বয়স সাত কি আট। তার ছোট আরেকটা বোন, সে হয়তো বা ৭/৮ হবে-শুধু লাফাচ্ছে আর এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে, মা’র এতে কোনও পেরেশানি দেখলাম না। জামিলা এবং আমিনা ফুলের মতো সুন্দর ফুটফুটে দুটো মেয়ে। বড় বোন স্মার্ট ফোনে খেলছে আর আমিনা বোনের ঘাড়ে মাথা কাত করে আধো ঘুম-আধো জাগ্রত অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি আনোয়ারের মা এবং জামিলার বাবার হিসাব মেলাতে পারলাম না, অর্থাৎ তাদের আশপাশে কোথাও দেখলাম না। আনোয়ার বাবাকে বলছে, তার পিপাসা পেয়েছে, বাবা এক বোতল কমলার রস এনে দিলেন, সে এক চুমুক খেয়ে আর খেল না। আমিনা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে মা’র কাছে গেল, হাতের ব্যাগ থেকে দুটো ক্যান্ডি আনল। একটা বোনকে দিল, আরেকটা নিজে খাবে বলে খুলতে লাগল। এমন সময় আনোয়ারের করুণ চাহনি আমিনার চোখে পড়ল, সে ক্যান্ডিটা নিজে না খেয়ে আনোয়ারের হাতে গুঁজে দিল। আনোয়ার হাতে নিয়েই ক্যান্ডিটা লুকিয়ে ফেলল, হয়তো বা বাবার ভয়ে, নিশ্চয়ই অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু খেতে বাবার মানা। এমন সময় আনোয়ার বাবা ছেলের হাতে ক্যান্ডি দেখে তার দিকে কটমট করে তাকালেন। ভয়ে এবং অপরাধবোধ আনোয়ারে কাঁদো কাঁদো চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না! আনোয়ারের এ অবস্থা দেখে আমিনার অবস্থা আরও খারাপ! তার চঞ্চল দুটো চোখ স্থির হয়ে এলো, ভয়ে চোখে পানি টলমল করছে আর ফুলের মতো নিষ্পাপ দুধে-আলতা বদনখানা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল। তার ভয়, ভদ্রলোক যদি তাকে কিছু বলে ফেলেন! আমিনার চেহারা দেখে আনোয়ারের বাবার মন গলে গেল। আনোয়ারের হাতের ক্যান্ডি এখন মুখে যেতে আর কোনও বাধা রইল না। আনোয়ার খুশি, আমিনার মুখে স্বর্গীয় হাসি ঝিলিক মেরে উঠল। নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলার ওপর অবশেষে জয় হলো নিষ্পাপ শিশুর প্রতি শিশুর মায়া ও তার মমতামাখা হাত বাড়ানো। আমি খুব কাছে বসে সব দেখছি। ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে গিয়ে আমিনাকে আদর করে বলি,Amina you are indeed a wonderful girl! এমন সময় আমার ডাক পড়ে গেল! মাদ্রিদ ফ্লাইটের বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। আমিনাদেরও এবার ওঠার পালা, মাত্র বোর্ডিং অ্যানাউন্সমেন্ট হয়েছে। তার বাবা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন, লাইন ধরে তারা সবাই গিয়ে উঠল এয়ার-এরাবিয়ান ব্রাসেলস ফ্লাইটে। জামিলা আর আমিনার মুখে যতখানি হাসি তাদের মা-বাবার বুকে ততখানি ভয়। কারণ, ব্রাসেলসে মুসলমানদের ঘরে ঘরে পুলিশি তল্লাশি চলছে, বুটের আঘাতে কড় কড় তালা ভাঙছে, দরজা খুলছে, মানবতা পদদলিত হচ্ছে!  
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • ডাঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক আজম ৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:৩৭ পিএম says : 0
    খুব ভাল লাগল আমার মন চাচ্ছে বাকি জীবনটা সেখসনে গওয়ে কাটাতে আসলে সাদা মনের মানুষ পাসে থাকলে চিন্তা দুর হয়ে জায়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন