Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বছরজুড়ে আস্থা ফেরানোর চেষ্টায় দুদক

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান : পঞ্চবার্ষিকীয় কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা : অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান

| প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মালেক মল্লিক : গেল বছরে সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো প্রচেষ্টায় ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পর দুদক বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিশেষ করে, দুনীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান, পঞ্চবার্ষিকীয় কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২১), দুদক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম অংশগ্রহণ ও অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান। এ ছাড়াও বরাবরের মতো গণশুনানি, তদন্ত ও অভিযোগ নিষ্পত্তি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজরদারি, পরমুখাপেক্ষিতা কাটিয়ে দুর্নীতবাজকে গ্রেফতার নামে দুদক। এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনার ফলে বিদায়ী বছরের শেষ দিকে এসে সাধারণ মানুষের কাছে দুদকের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হয়। দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ে দুদকের সচিব আবু মো: মোস্তফা কামাল ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে দুদকে বেশি অভিযোগ আসছে, এতে প্রমাণ হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমি মনে করি এটা বিদায়ী বছরের একটা অর্জন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান  কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতির সংবাদ পাওয়ার পর পর তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীকে গ্রেফতার ও মামলা করা হয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যানের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে যেমন দুর্নীতি কমবে, অন্য দিকে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের দুদকের প্রতি আস্থা বাড়বে। গত বছর ২১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাবাষির্কী অনুষ্ঠানে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা অর্জনে দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
২০১৬ সালের ১৪ মার্চ দুদকের চেয়ারম্যান হয়ে আসেন সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ। এরপর প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা উদ্ধারে কর্মতৎপরতা শুরু হয়। শুরু হয় আস্থা অর্জনে উদ্যোগ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব অনিয়মের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে সাঁড়াশি অভিযান। বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতারের সুযোগ পায় দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের প্রতি আস্থা ফেরাতে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযানে নামে। এ ছাড়াও নেয়া হয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।
অনিয়মের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান : গেল বছর শেষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, জনপ্রতিনিধিসহ  প্রায় চার শতাধিক জনকে গ্রেফতার করেছে দুদক। বর্তমান কমিশনের সময় ৩৮৮ জনকে। শুধু ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঋণ জালিয়াতির প্রায় দেড় শত হোতা গ্রেফতার হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, ব্যাংক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, ভূমি কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তা। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় অন্তত ১৮৯ ব্যক্তির ওপর। সরকারের ১০ টাকার চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে খাদ্য পরিদর্শক, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ  প্রায় ২০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে দুদক।  
আস্থা অর্জনে উদ্যোগ :  বছরের পর বছর ঝুলে থাকা অনুসন্ধান দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। অনুসন্ধান নিষ্পত্তিতে ৩০ দিনের বাধ্যবাধকতা প্রতিপালনের ওপর জোর  দেন। মামলা পরিচালনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রসিকিউশন প্যানেল থেকে বিতর্কিত আইনজীবীদের বরখাস্ত করা হয়। নিয়োগ দেয়া হয় নতুন আইনজীবী। ফলে বিচারিক আদালতে মামলার হার ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৯ শতাংশে উন্নীত হয়।
অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান : কাজের গতি বৃদ্ধি করতে আট শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়। একাধিক কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলকভাবে সরকারের অন্য দফতরে প্রেষণে পাঠানো হয়। এ  ক্ষেত্রে কমিশনের বক্তব্য হলোÑ যারা কমিশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের অবশ্যই সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মঠ হতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলে বা কারো বিরুদ্ধে অসাধুতার প্রমাণ মিললে চাকরিতে বহাল থাকা নয়, তাকে বাড়ি পাঠানো হবে। পৃথক অভিযোগে দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কর্মকর্তাদের ফাইল এবং মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার চালু করা হয়। ‘ড্রেসকোড’ চালু হয়। কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিক গণশুনানির আয়োজন করা হয়। শুদ্ধাচার চর্চায় আলোকিত প্রজন্ম নির্মাণে স্কুলে স্কুলে ‘সততা  স্টোর’ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি : গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে পাঁচটি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করেছে দুদক। সংস্থার পাঁচ পরিচালক দলগুলোর নেতৃত্ব দেবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর।
অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত : গেল বছরের দুদকে প্রায় ৯ হাজারের মতো অভিযোগ আসে। এর মধ্য  থেকে অনুসন্ধান হয় একহাজার ১৩০টি অভিযোগের। নিষ্পত্তি করে ৮৬০টি অভিযোগ। এ সময় দুদক মামলা করে ২৮০টি। তদন্ত  শেষে চার্জশিট  দেয় ৫১৪টি মামলার। চূড়ান্ত প্রতিবেদন  দেয় ৪৯০টি মামলার। বিচারিক আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয় অন্তত ৩৩১টি। এর মধ্যে ৮০টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে আসামিদের সাজা হয়। বিদায়ী বছরে মামলার সাজার হার  বেড়ে ৬১ শতাংশ হয়েছে। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৩৭ শতাংশ। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ বছর ১৬৯ জনকে সম্পদ বিবরণীর নোটিস দেয় দুদক।
পঞ্চবার্ষিকী কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) : দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরো কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে আটটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এই মধ্যে রয়েছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা  তৈরি, কার্যকর অনুসন্ধান ও তদন্ত, কার্যকর মামলা পরিচালনা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কৌশল, শিক্ষা  কৌশল, উদ্ভাবনী গবেষণা ও উন্নয়ন, নিরপেক্ষতা-স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সুদৃঢ়করণ। এ ছাড়া সরকারি কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সহজে সেবাদান নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিশেষ সুপারিশমালা  পেশ করা হয়েছে প্রেসিডেন্টের কাছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির ফাঁকফোকর বন্ধে একাধিক পরিচালকের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক টিম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনায় গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ