Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সামাজিক অবক্ষয়ে শিশু নির্যাতন বাড়ছেই

গৃহকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় মামলা করতে চান না বা মামলা করলেও তা চালাতে পারেন না। এর বাইরের তাদের দারিদ্র্যের সুযোগ গ্রহণ করে সালিসের মাধ্যমে মিটমাট করা হয়-এমজেএফ-এর নির্বাহ

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করা হয় শিশু গৃহকর্মী নাদিয়ার লাশ। তার মাথার উপরের অংশে ক্ষতচিহ্ন, কপালে নখের আঁচড়, মুখমন্ডল ফোলা এবং বাম কানে কালো দাগ। তখনও নাক-মুখ দিয়ে ঝরছিল রক্ত। খুনের শিকার নাদিয়া লাশের সুরতাল প্রতিবেদনে নির্যাতনে এমনই ভয়াবহতা উঠে এসেছে। রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার এসআই সোহেলি আকতার এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। নির্যাতন শেষে হত্যার ঘটনায় নাদিয়ার গৃহকর্ত্রী ফরহাদ বাধন মৌকে (৬৯) রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। নাদিয়ার মতো দেশে হাজারো শিশু কোনো না কোনো ভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনকারীদের মধ্যে আছেন গৃহকর্তা-কর্ত্রী, প্রভাবশালী, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, চাকরিদাতা, প্রতিবেশী এবং সৎমা।
গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পোমরা ইউনিয়নে ছয় বছরের শিশু ইসফাকে (ছদ্মনাম) ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে মো. জাহেদুল ইসলাম নামের এক তরুণের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিশুকে বাড়ির পাশের পেয়ারা বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে অভিযুক্ত পাষণ্ড। শিশুটির চিৎকারে মা ছুটে এলে পালিয়ে যায় জাহেদ। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। শিশু নির্যাতনের এমন ঘটনা এত দিন শহরে বেশি দেখা গেলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও।

গত মঙ্গলবার মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩১৭ নারী ও শিশু। যা জানুয়ারী মাসের চেয়ে বেশি। জানুয়ারিতে ২৭৫ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। ফেব্রুয়ারিতে ৪৩টি ধর্ষণ, ১৩টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, তিনটি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ১৫টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হয়েছে।

অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ে নির্যাতন বাড়ছে। অনেক সময় শিশু নির্যাতনের ঘটনা অভিভাবকরা লোক লজ্জা বা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিরবে সহ্য করেন। ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় অভিভাবকরা লজ্জায় সামনে আনেন না। তারা মামলা করতে চান না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে না। কখনও আবার সাক্ষীর অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যায়। এসব কারণে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা পুলিশ দায়সারা তদন্ত করে। আবার যথাযথ তদন্ত করলেও বিচারের সময় সাক্ষীর অভাবে অনেক আসামি খালাস পেয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর সবুজবাগের ভুক্তভোগী এক শিশুর বাবা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমার মেয়ের বয়স ১৩। আমার মেয়ে এখনও ঘুমের মধ্যে ভয় পায়। মাঝ রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার দিয়ে বলে, জাহেদ (ছদ্র নাম) আসছেৃ। সে আমার মেয়েকে নির্যাতন করে। জাহেদ এলাকায় আরও ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু টাকা আর প্রভাব থাকার কারনে তাদের কিছুই হয় না।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িত অপরাধীরা ধরা পড়লেও শাস্তি হচ্ছে না। ক্ষমতার জোরে বা আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছে। ১০ বছরের নাদিয়াকে এত নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে যে, কোনো সুস্থ মানুষ তা কল্পনাও করতে পারবে না। নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত ৬৯ বছরের মৌ যেন কোনভাবেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

তিনি বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনার এতো ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পরও যদি একটা মামলারও বিচার না হয়, তাহলে মানুষ ভাববে যে এই অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। অর্থ বিত্ত দিয়ে অপরাধ ঢেকে ফেলা যায়। আর এই কারণেই দিনে দিনে গৃহকর্মী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। শুধু মিডিয়ার কল্যাণে যেসব ঘটনা আমরা জানতে পারি, বাস্তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা আরও অনেক বেশি। সব ধরনের পেশাজীবীর বাড়িতেই গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনার খবর ছাপা হচ্ছে। গৃহকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা মামলা করতে চান না বা মামলা করলেও তা চালাতে পারেন না। এর বাইরের তাদের দারিদ্র্যের সুযোগ গ্রহণ করে সালিশের মাধ্যমে মিটমাট করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শিশুরা অবুঝ, অল্পকিছুতে সন্তুষ্ট করা যায়। আজকাল শিশু -কিশোরদের দিয়ে মাদক পাচার থেকে শুরু করে অসামাজিক কাজ করানো হচ্ছে। কাজ করতে না চাইলে তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মা-বাবা, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম-সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু-সংবেদনশীল একটি সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। শিশুদের অধস্তন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাবীব আহসান বলেন, শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক অবক্ষয়। পুলিশের একার পক্ষে এ অবক্ষয় সামলানো কঠিন। নৈতিকতার শিক্ষা পরিবার থেকেই দেয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেয়া দরকার। একযোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রচারণা বাড়াতে হবে।
তিনি আরো বলেন, শিশুদের সহজেই প্ররোচিত করা যায়। তাই তারা বেশি বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা কমাতে অভিযুক্তদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও শাস্তি দিতে হবে। যেন তারা ‘চিহ্নিত অপরাধী’ হিসেবে সবার ঘৃণার পাত্র হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, শিশু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনা পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। জড়িতদের পরিচয় কি বা তারা কারা সেটা তদন্তের ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি। শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িতদের কোন ভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবক বা বড়দের আরো যত্মবান হতে হবে, কারো মাধ্যমে যেন শিশু নির্যাতনের শিকার হওয়ার কোন সুযোগ তৈরি না হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ