Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়ন কাজে ফিরবে গতি

নির্মাণ উপকরণের দর পুনঃনির্ধারণ থমকে থাকা কাজ নতুন উদ্যমে শুরু করবে ঠিকাদাররা : বিএসিআই সভাপতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মহামারি-উদ্ভূত বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং ইউরোপে চলমান যুদ্ধের ফলে উন্নয়ন খাতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সরকারকে। পাশাপাশি মহামারির কারণে কাজে ধীরগতি এবং রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণ উপকরণের বাজারদর অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদাররা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখে। এতে কয়েক লাখ কোটি টাকার হাজারের অধিক এরকম প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সময়মতো বিল পরিশোধ না করায় কাজে সেভাবে গতি আসছিল না। সরকারি অর্থ ছাড় বন্ধ, নির্মাণ সামগ্রীর চড়া বাজারদর, শিডিউল অভ রেট সংশোধন না করা, ঠিকাদারদের বকেয়া বিল পরিশোধ না করা এবং ডলার সঙ্কটে নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে এলসি খোলায় সমস্যা হওয়ায় চলমান প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার ১ হাজার ১৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের বেশিরভাগের কাজেই স্থবিরতা নেমে এসেছিল। প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের উন্নয়ন কাজের ৮০ শতাংশের বেশিই নির্মাণাধীন। এসব চলমান প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় বন্ধ। আর তাই দীর্ঘদিন থেকে নির্মাণ সামগ্রীর দামবৃদ্ধির সঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ের সমন্বয় করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে আসছিলেন ঠিকাদাররা। এই ধারাবাহিকতায় অবশেষে ইট, বিটুমিন, সিমেন্ট এবং রডসহ নির্মাণ উপকরণগুলোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে শিডিউল অব রেট পুনঃনির্ধারণ করেছে সরকার। এতে ঠিকাদারদের মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের হতাশা কিছুটা হলেও লাঘব হবে এবং নতুন উদ্যমে উন্নয়ন কাজ শুরু করতে পারবেন তারা।

বাংলাদেশ নির্মাণ শিল্প সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী শফিকুল হক তালুকদার বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোর সবগুলোই ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া। প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি। তিনি জানান, কোভিডের প্রাদুর্ভাবের পর সারা বিশ্বেই চলাচলে বিধিনিষেধ ও অর্থনৈতিক মন্থরগতি দেখা দিলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বাধা আসে। এরপর ২০২২ সালের শুরুতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে রড, সিমেন্টসহ অত্যাবশ্যকীয় নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ঠিকাদারদের ভোগান্তি ও বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাঁচামালের দাম বাড়ানোয় স্বস্তিতে থাকবেন তারা। একই সঙ্গে থমকে থাকা উন্নয়ন কাজ নতুন উদ্যমে শুরু করবে ঠিকাদাররা। তবে নতুন দর পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, প্রতিটি জিনিসের দাম বাজারদরের চেয়ে কিছুটা কম রয়েছে। ভবিষ্যতে দাম বাড়লে ঠিকাদাররা আবারও সমস্যায় পড়বেন, বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়াও সময়ে সময়ে মূল্য পর্যালোচনা এবং রেট শিডিউল হালনাগাদেরও আহবান জানান তিনি।

সূত্র মতে, প্রথম শ্রেণীর অধিক পোড়া বা ঝামা ইটের দাম ১০ টাকা থেকে ৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। আর অটোমেটিক মেশিনে তৈরি এক নাম্বার গ্রেডের ইটের দাম ১১ দশমিক ৫ টাকা থেকে ৪ দশমিক ৫ টাকা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ টাকায়। মানভেদে ইটের দাম ৩০ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ বাড়িয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নির্মাণকাজের শিডিউল অব রেট পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আওতায় ইট ছাড়াও প্রধান নির্মাণ উপকরণ বিটুমিনের দাম ৪২ শতাংশ, সিমেন্টের দাম ২২ শতাংশ ও রডের দাম ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারের সব দফতরের দর তফসিলের জন্য নতুন এই দাম কার্যকর হবে। ইতোমধ্যেই অনুমোদন হয়েছে এমন কাজগুলোর মোট ব্যয়ের তথ্য উপকরণগুলোর নতুন দামের ভিত্তিতে পুনঃনির্ধারণ করে তা জমা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায়।

পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় চলমান প্রায় ১৫শ’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ১ হাজার ৭৬২ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ২ দশমিক ৪৭ লাখ কোটি টাকা থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে ২ দশমিক ২৮ লাখ কোটি টাকায়। সরকারের উন্নয়ন কাজের ৮০ শতাংশের বেশি নির্মাণধর্মী হওয়ায় এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে প্রতিটি প্রথম শ্রেণীর ঝামা ইটের দাম ধরা হয়েছে ১৩ টাকা। বর্তমানের শিডিউল অব রেটে এই ইটের দাম ধরা আছে ১০ টাকা। এ হিসাবে ঝামা ইটের দাম বাড়ছে প্রতিটি ৩ টাকা বা ৩০ শতাংশ।

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ঝামা ইটের দাম ৯ দশমিক ৬ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২ দশমিক ৫ টাকায়। আর খুলনা ও বরিশালে ৯ দশমিক ৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২ দশমিক ৫ টাকায়। এ হিসাবে রাজশাহী ও রংপুরে ঝামা ইটের দাম প্রতিটি ২ দশমিক ৯ টাকা এবং খুলনা ও বরিশালে ২ দশমিক ৭ টাকা করে বাড়ছে।
সারা দেশেই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি প্রথম শ্রেণীর ইটের দাম ৪ দশমিক ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। ১১ দশমিক ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এই ইটের ব্যয় দেখানো হবে ১৬ টাকা। এ হিসাবে শতকরা দাম বৃদ্ধির হার ৩৯ ভাগ। প্রতি কেজি বিটুমিনের (গ্রেড ৬০/৭০) রিটেইল পর্যায়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে দাম বাড়ছে ২৩ টাকা। বিদ্যমান রেট শিডিউলে উপকরণটির দাম ৬৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৯২ টাকায়। শতকরা হিসেবে দাম বাড়ছে ৩৩ ভাগ। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৩২ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় ৩৪ শতাংশ করে বাড়ছে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের রিটেইল দাম। একই গ্রেডের বিটুমিনের বাল্ক দাম ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৪১ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাল্ক সংগ্রহে প্রতি কেজি ৬৩ টাকা থেকে বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ৮৯ টাকায়। চট্টগ্রাম ও সিলেটে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের পাইকারি দাম ৩৮ শতাংশ হারে বাড়লেও দেশের অন্য চার বিভাগে বাড়ছে ৪২ শতাংশ করে। একইভাবে খুচরা এবং বাল্ক সংগ্রহে অন্যান্য গ্রেডের বিটুমিনের দামও সারা দেশেই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হচ্ছে।

প্রতি বস্তা অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের দাম খুচরা পর্যায়ে ৭০ টাকা ও বাল্ক সংগ্রহে ৮০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ৪৯০ টাকা থেকে ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে খুচরা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫৬০ টাকা। আর ৪৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বাল্ক সংগ্রহে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫২০ টাকা। এ হিসাবে পাইকারি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। প্রতি বস্তা পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্টের খুচরা দাম ৪৬০ টাকা থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৫ টাকায়। এ হিসাবে বস্তায় দাম বেড়েছে ৬৫ টাকা। আর বাল্ক সংগ্রহে একই মানের সিমেন্টের দাম ৪১০ টাকা থেকে ২২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকায়। শতকরা হিসেবে দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ।

সরকারের সাত সংস্থার অধীনে বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রায় ২১ হাজারে কোটি টাকার ২৪৫টি প্রকল্পের ৫৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, যা সাত সংস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে কম অগ্রগতি হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৯১টি প্রকল্পে। পাউবোর এ প্রকল্পগুলোর সার্বিক অগ্রগতি ২৩ শতাংশ। অন্য পাঁচটি সংস্থা হলোÑস্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), গণপূর্ত বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।
নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়ন কাজের গতি কমে এসেছে বলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় উপকরণ স্বল্পতা, উপকরণের দামবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ রাখে। নতুন এই রেট শিডিউলের সুবাদে কাজে গতি আসবে বলে তারা মনে করেন। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. ওয়ালিউর রহমান বলেন, ঠিকাদার কাজ বন্ধ রাখায় অনেক প্রকল্পেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। রেট শিডিউল হালনাগাদ করার কারণে ঠিকাদাররা কিছুটা সুবিধা পাবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এবার কিছুটা হলেও কাজে গতি আসবে।



 

Show all comments
  • Jahangir Alam ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:৩২ এএম says : 0
    দেখা যাক আল্লাহ ভরসা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ