Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হেঁটেই তিস্তা পারাপার!

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে; পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। গ্রামের মৃতপ্রায় ছোট নদীর প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার রূপময় চিত্র এঁকেছেন কবি এ কবিতায়। কিন্তু তিস্তা ছোট নদী নয়। দেশের যে কয়টি বড় নদী রয়েছে তিস্তা তার অন্যমত। ভারত যুগের পর যুগ ধরে পানির ন্যার্য্য হিস্যা নিয়ে ‘তিস্তা চুক্তি’ ঝুলে রাখায় তিস্তা নদী পানির অভাবে বেহাল অবস্থা। রবীন্দ্র নাথের ছোট নদী নয়, বড় নদী তিস্তায় মানুষ এখন পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। এ দৃশ্য গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের উলিপুর, লালমানির হাটের হাতিবান্ধায় এ দৃশ্য প্রতিদিন চোখে পড়ছে। ফাল্গুন মাসেই নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে মানুষ নদী পাড় হচ্ছে।
চৈত্রের অনেক বাকি, ফাল্গুন মাসের শুরুতেই তিস্তা নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগেও তিস্তা নদী পারাপারে ভরসা ছিল নৌকা। এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে হাঁটু পানি। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা এখন মানুষ পায়ে হেঁটেই পান হচ্ছেন। তিস্তা নদীর নিলফামারির ডলিয়া পয়েন্ট থেকে শুরু করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত ছোট বড় অসংখ্য চর জেগে ওঠায় নৌকা চলছে না। ফলে মানুষে বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছেন। রংপরের কাউনিয়া রেল সেতুর পাশ দিয়ে মানুষ পায়ে হেঁটেই নদী পাড় হওয়ার দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায়। একই দৃশ্য দেখা যায় রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলার সিবদেব চর গ্রাম ও কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরের থেতরাই এলাকার তিস্তা নদীতে। মানুষ নৌকার বদলে এখন পায়ে হেঁটেই নদী পাড় হচ্ছেন, চরে গবাদিপশু চড়াচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সাপ্তাহে পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় চর। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজে মানুষজন পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন নদী। অথচ এই নদীর প্রবল স্রোতে শত শত ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা পায়ে হেঁটে নদী পাড় হচ্ছে। উলিপুর থেকে পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে পীরগাছা উপজেলার শিবদেব চর গ্রামে আসা হাসনা হেনা বেগম বলেন, ‘হামার বাপের বাড়ি শিবদেব চরে। আগত নৌকাত করি যাওয়া আইসা করছি। এখন নদীত পানি নাই, সেইজন্যে হাঁটি পার হইনো নদী।’
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ভারত তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখায় চৈত্র মাসের আগেই নদী শুকিয়ে গেছে। এতে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য চরে নানান ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার ভারতীয় অংশে গজলডোবায় স্থাপিত বাঁধের কারণে নদীটির বাংলাদেশ অংশে প্রায়ই পানি সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া খনন কাজ না করায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি। পানি প্রবাহের গতি প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। এ নদীর নাব্যতা হারানোর কারণে বর্ষা মৌসুমে দুই কূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে প্রায় শত শত একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এ অঞ্চলের কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভেঙ্গে নিয়ে যায় ফসলি জমি ও মানুষের ঘরবসতি। অথচ প্রতিবছর বর্ষায় একতরফাভাবে ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অসংখ্য মানুষকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর দুই তীর প্লাবিত হয়ে রংপুরের পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া, লালমনির হাটের হাতিবান্ধা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। শত শত একর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে নষ্ট হয়। একইসঙ্গে তীব্র নদী ভাঙনের ফলে অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। ফলে দুই পাড়ের মানুষজনকে চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। নদী পারাপারে একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় নৌকা। চলতি শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় খরস্রোতা তিস্তা এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ চরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা সামান্য খালের মধ্যে হাঁটু পানি পার হলেই এখন তিস্তা নদী পাড়ি দেওয়া সম্ভব।
নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল চীনের অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হব্ েএতে ভাগ্য বদলাবে নদী পাড়ের মানুষের। নদীর ভাঙ্গন বন্ধ হবে, শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু সে স্বপ্ন এখন সুদূর পরাহত। ভারত তথা নরেন্দ্র মোদী সরকারের চাপের মুখে চীনের অর্থায়নে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্প এখন লাল ফিতায় বন্দী হয়ে রয়েছে।
কাউনিয়া রেল ব্রিজের পাশের গ্রামের তিস্তার ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব আফছার আলী সরকার নামে এক কৃষক বলেন, তিস্তার ভাঙনে বাড়িঘর নদীতে গেইছে। তিস্তা হামার জন্য অভিশাপ। ভাঙন থামাতে সরকার কিছুই করতেছে না। আশা ছিল চীন প্রকল্প করলে ভাগ্য ফিরবে। কিন্তু কিছুই দেখছি না।’
পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া এলাকার মৎস্যজীবী মো. আতোয়ার হোসেন বলেন, যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা নদীতে মাছ ধরে শত শত পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু নাব্যতা কমে যাওয়ায় মৎস্য শিকার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছে মৎস্যজীবী পরিবারগুলো। অনেকে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় গিয়ে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ ঢাকায় গিয়ে রিক্সা চালাচ্ছেন, কেউ রংপুর ও কুড়িগ্রামে রিক্সা চালাচ্ছেন।
তিস্তা নদীর তীরের বাসিন্দা মো. হারিছুর রহমান বলেন, প্রতি বছর খরস্রোতা তিস্তা উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বন্যাসহ নদী ভাঙন দেখা দেয়। আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হয়।
নৌ শ্রমিক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নদী মরে গেছে। তাই বাপ-দাদার পেশা বদল করে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছি। বর্তমানে তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে কৃষি কাজ চলছে পুরোদমে। পানি না থাকায় অনেক কৃষক শ্যালো মেশিনে সেচ দিয়ে বালুচরে কৃষিকাজ করছে। তাই খরচ বেশি হচ্ছে। এতে কৃষকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তিস্তা নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের মানুষ এখনো চেয়ে আছে পানির অপেক্ষায়। ###



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ