Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উচ্চ খরার ঝুঁকি

বৃষ্টি নেই, রাজশাহীসহ উত্তরের ছয় জেলায় প্রলম্বিত হচ্ছে খরা

রেজাউল করিম রাজু, রাজশাহী থেকে | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর চলে গেছে অনেক নিচে। খরার উচ্চ ঝুঁকিতে রাজশাহীসহ উত্তরের ছয় জেলা। দেশের ২২ জেলা খরার ঝুঁকিতে থাকলেও খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ছয় জেলা। এগুলো হলো, রাজশাহী, নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের বাংলাদেশ ক্লাইমেট এ্যান্ড ডিজাষ্টার রিকস এটলাস শীর্ষক প্রতিবেদনে এতথ্য এসেছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মওসুম ভিত্তিক জলবায়ুর এলোমেলো আচরনে শীত হচ্ছে স্বল্পকালীন খরা হচ্ছে প্রলম্বিত। কমে গেছে ভয়ানক ভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। বৃষ্টি নির্ভর ফসল এখন সেচ নির্ভর ফসলে পরিনত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে বছরজুড়েই পানির নীচ থেকে পানি তুলে চাষাবাদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাতালের পানি পূন:ভরন হচ্ছেনা। ফলে পানির স্তর নামছেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে অনেক স্থানে পানির নাগাল পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটা দাগে রাজশাহী অঞ্চলের পানি সঙ্কট তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে লাইফলাইন খ্যাত প্রমত্ত পদ্মা নদীকে পরিকল্পিত ভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। পদ্মা নদীর উপর ভারতের ফারাক্কাসহ অসংখ্য ড্যাম ব্যারেজ ক্যানেল দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহারের মধ্যদিয়ে এর মরণ দশা শুরু হয়েছে। যার ভয়াবহ বিরুপ প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের সর্বক্ষেত্রে। পদ্মা মরে যাওয়ায় অর্ধশত শাখা নদ নদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। খাল বিল বছরজুড়ে থাকছে পানি শূন্য। ফলে কৃষি মৎস্য নৌপথ জীব বৈচিত্র সব হারিয়ে সব ক্ষেত্রেই মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী কেন্দ্রীক মানুষের জীবন যাত্রা পাল্টে গেছে। জেলে, মাঝি তার পেশা বদলেছে। নদী ভাঙনে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিটে মাটি ছাড়া হয়েছে।
এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী দুর্ভোগ বয়ে এনেছে প্রলম্বিত খরা। টানা বৃষ্টিহীনতা এমনকি শীত মওসুমেও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়া। সবকিছু মিলিয়ে পানির শঙ্কা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। বর্ষা মওসুমে মাস দুয়েকের জন্য পদ্মাসহ শাখা নদীতে খানিকটা পানি এলেও তা আবার শুকিয়ে গেছে। ফলে ভূ-উপরিস্থ পানির সঙ্কট যেমন চলছে। তেমনি চাহিদা মেটাতে খাবার থেকে কৃষি সর্বক্ষেত্রে ভূগর্ভস্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। পানির অভাবে সেচে চাষাবাদ সঙ্কুচিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দেড়শো ফুটের বেশী নিচে নেমে গেছে। হস্তচালিত নলকূপ পরিত্যাক্ত হয়েছে। বছর দশেক আগে এই অঞ্চলে ষাট সত্তর ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। এখন দেড়শো ফুটেও পানি পাওয়া যায়না। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে। দেশে বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির পর পূন:ভরন হার ২৫ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র আট শতাংশ। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয় তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবে পূরণ হবার কথা। ব্যাপক পানি উত্তোলন ও বৃষ্টিহীনতা পানির সেই স্তর পূরণ হচ্ছেনা।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আবদুল সালামের অভিমত রাজশাহী এমনিতে উষ্ণতম জেলা। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছেনা। ফলে খরা প্রলম্বিত হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি নিয়ে কাজ করছেন প্রফেসর ড. সরওয়ার জাহান সজল বলেন, মৌসুম ভিত্তিক জলবায়ুর যে স্ট্রাকচার তা এখন আর ঠিক নেই। এখন সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে গরম বাড়ছে। বিগত এক দশক ধরে আবহাওয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে বৈশাখের প্রথম দিনই ঝড় বৃষ্টি দেখা যেত। এখন আর তেমন দেখা যায়না। খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বরেন্দ্র অঞ্চলে অধিক পরিমাণে ধান চাষ হচ্ছে। অন্যান্য ফসলও আবাদ হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্ত পানির উপর চাপ বাড়ছে। পানির স্তর ক্রমশ: নিচের দিকে নামছে। এরমধ্যে রাজশাহীতে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। জাতীয় বৃষ্টিপাতের আড়াই হাজার মিলিমিটার হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে অর্ধেকের কম মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্ত পানি রিচার্জ হতে পারছেনা। যে পরিমাণ পানি চাষাবাদের জন্য উত্তোলন তার রিচার্জের পরিমাণ অনেক কম। ফলে পানির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরনে ভূগর্ভস্ত পানির উপর চাপ কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ুর বিরুপ আচরনের কারণে মানুষ প্রাণীকূল বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে উদ্যাগ নিতে হবে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদের কথা হলো পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় পাতালের পানি ভরছেনা। আর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সেচ ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। পানির স্তর নেমে যাবার কারণে ২০১২ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে আর নতুন করে গভীর নলকূপ বসাচ্ছেনা। বর্তমানে প্রায় নয় হাজার গভীর নলকূপ চালু আছে। অল্প সেচ লাগে এমন ফসল আবাদের জন্য আমরা কৃষকদের উৎসাহিত করছি। শুধু বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ নয় ব্যক্তি মালিকানা পর্যায়েও পাম্প বসিয়ে পানি তুলে চাষাবাদ, মাছের খামারে ব্যবহার হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রমত্ত পদ্মার মরণ দশার শুরু থেকে এ অঞ্চলে মরুময়তা ধেয়ে আসতে থাকে। এক ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রুপান্তর ও ধেয়ে আসা বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ১৯৮৬ সালে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে গভীর নলকূপ বসাতে থাকে। শুরুতে পঁচিশটি উপজেলা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। পানির কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে সবুজে ভরে ওঠে। ধীরে ধীরে পুরো উত্তরাঞ্চলজুড়ে তাদের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে। মরুময়তা ঠেকাতে গভীরনলকূপ বসিয়ে পানি তুলে বরেন্দ্র অঞ্চলে সবুজতা আনলেও এখন পানির অভাবে উল্টো প্রভাব দেখা যাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ