Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চিকিৎসা ব্যবস্থা সুস্থ হবে কবে

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মুখে মুখে অর্থাৎ বাজারে অনেক কথা ঘোরাফেরা করে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, দেশের মানুষ সরকারী হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোথাও ঠিক মত চিকিৎসা সেবা পান না। সংবাদপত্রে প্রায়ই চিকিৎসা ব্যবস্থার নেতিবাচক সচিত্র চালচিত্র দেখে মানুষ কেবল হতাশই হয়। দেশের জনগণও নেতিবাচক চিকিৎসা ব্যবস্থার সংবাদ পাঠ করে, সাময়িক সময়ের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার ভালমন্দের বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। অনেকে মন্তব্য করে থাকেন, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতই উন্নত কিংবা আধুনিক হোক না কেন, তা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নাগালের বাহিরে থাকে সকল সময়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা তারাই ভোগ করে থাকে, যাদের পকেটে আছে রাশি রাশি টাকা। অভিযোগ আছে, দেশের সরকারী হাসপাতালে রোগীরা যখন যান, তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তখন সুন্দর ব্যবহারটুকু পর্যন্ত করেন না। এসব অভিযোগ নতুন কোন ব্যাপার নয়। আমরা সকল সময় শুনে আসছি, সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী ব্যক্তিদের অনেক সময় ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। আবার অনেকে বলেন, সরকারী হাসপাতালগুলোতে “ওয়ান ইলেভেনের” মতো ব্যবস্থা এলেই রোগীদের ব্যাপারে হাসপাতালের ডাক্তারসহ চিকিৎসা সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটু বেশি সময় দেন এবং যথাসময়ে হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন। এটা যে কেবল হাসপাতালের ব্যাপারেই দেখা যায় তা নয়, আমাদের সকল সরকারী অফিসে “ওয়ান ইলেভেনের”  মতো ব্যবস্থা এলেই দেশের মানুষ সেবা পেয়ে থাকে। এসব কথা, কথার কথা কিনা জানি না। এমন কথা মানুষ বলে থাকে। অনেক মানুষ সকল অব্যবস্থাকে তাদের কপালের ফের অর্থাৎ নিয়তি বলে মেনে নেয়। এই মেনে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা থাকে না। আরও অভিযোগ করা হয়ে থাকে, সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের বেসরকারী হাসপাতালের সাথে নিবিড় একটা সম্পর্ক থাকে। সম্পর্কটাকে অনৈতিক এই জন্য বলা হয়ে থাকে যে, সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যস্ত থাকেন সরকারী হাসপাতালে আসা একজন রোগীকে বেসরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে কমিশন খেয়ে নিজেদের পকেট ভারি করার কাজে। সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে যখন এমন অভিযোগ উঠে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হয়ে যায়। আবার ভয়ও জাগে। মন খারাপ হয়ে যায় এই জন্যই যে, একজন লোক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়ে থাকেন। একটা লোক যখন অনেক পড়াশুনা করে ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তখন ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তির চিন্তার মাঝে কোন ধরনের আবর্জনা থাকবে না। যাদের চিন্তা চেতনার মাঝে অন্ধকারের ছোঁয়া থাকে, তারাই অনৈতিক পথ ধরে টাকা-পয়সা আয় করতে চায়।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে আইসিইউ বাণিজ্য আজকাল ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সেখানে বিন্দুমাত্রও মানবিকতার কোন স্থান নেই। যে যেমন ভাবে পারছে অসহায় রোগীদের নিয়ে এই অমানবিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দেশের রাজধানীর সরকারী হাসপাতালগুলোর ইনটেনসিভ কেয়ার অর্থাৎ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে একজন রোগীর স্থান পাওয়া আর সোনার হরিণ লাভ করা সমান কথা। আইসিইউতে একটি আসন বরাদ্দ পাওয়া খুবই কঠিন থেকে কঠিনতর ব্যাপার। সহজে সেখানে আসন লাভ করা যায় না। কেননা দেশের হাসপাতালের আইসিইউ কেন্দ্রগুলোতে আসন সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। রোগীর স্বজনরা যখন রোগীদের জন্য আসন বরাদ্দ করতে পারেন না, তখনই সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠে যারা এই আইসিইউ-ই বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তাদের আইসিইউ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা খুবই ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী। অভিযোগ আছে, এর সাথে জড়িত আছে বড় বড় মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার, হাসপাতালের ব্রাদার, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ড বয়, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের চালক পর্যন্ত। এই ব্যবসায় একজন পাস করা ডাক্তারের সাথে একজন ওয়ার্ড বয়ের নিবিড় বন্ধুত্বের কোন বাধা নেই। তারা নাকি একত্রে বসে চা-নাস্তাও করে থাকে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীর স্বজনরা তাদের রোগীর জন্য হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে আসন না পেয়ে শরণাপন্ন হয়ে থাকেন আইসিইউ বাণিজ্যের সাথে জড়িত সিন্ডিকেটের ব্যক্তিদের সাথে। তখন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সুযোগ পেয়ে বেসরকারী হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকে। রোগীর স্বজনকে তার রোগীকে আইসিইউতে আসনের জন্য অনেক টাকা গুনতে হয়। অনেক সময় তা লক্ষ টাকার পর্যায়ে চলে যায়। অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, রোগী মারা যাওয়ার পরও রোগীকে আইসিইউতে রাখা হয়। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রাজধানীর একটি হাসপাতালে ষোল মাস বয়সী একটি শিশুকে আইসিইউতে মারা যাওয়া পরও রাখা হয়। বিনিময়ে শিশুটির অভিভাবকের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নেওয়া হয়। শেষে এই অভিযোগ সহ অন্যান্য অভিযোগের কারণে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেন প্রতিষ্ঠানটিকে। এমন সংবাদ দেখে যে কেউ আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আতঙ্কে থাকবেন। বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক হাসপাতালেই লেখা হয়ে থাকে মানুষ যেন দালাল থেকে সাবধান থাকে। অথচ অভিযোগ করা হয়ে থাকে, হাসপাতালের এসব অসাধু ডাক্তারই, এমনকি কর্মচারী পর্যন্ত দালালী পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এই দালালদের কাজ হলো তাদের মূল দায়িত্ব বাদ দিয়ে সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী বেসরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে অনৈতিকভাবে নিজের উন্নতি করা। এমন খবর পাঠ করে সবারই মনটা বিষণœতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভাবি আমরা কিসের মধ্যে আছি। আমাদের সকল অর্জনকে একশ্রেণীর নষ্ট মানুষে কি একেবারে শেষ করে দেবে। দায়িত্ববান ব্যক্তিদের কি উচিত নয় সকল অন্যায়ের প্রতিকারের ব্যাপারে একমত হওয়া। তা না হলে দেশের অসহায় জনগোষ্ঠী কষ্টের মাঝেই থেকে যাবে।
বলা হচ্ছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন অনেক চাঙ্গা। যেখানে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানী ছিল। সেখানে গত অর্থবছরে তা ৩ হাজার ৪ শত কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিস্ময়কর উচ্চতায় অবস্থান করছে আমাদের বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আরও বলা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রির হার বাড়ায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতাও কমেছে। ৫ মাসে পণ্য রপ্তানী করে ১ হাজার ৩ শত ৬৯ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময় থেকে ৬.৩০ শতাংশ বেশি। আগের বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি পণ্য ৪ মাসে আমদানী হয়েছে। এমন সুখবর যখন আমরা সংবাদপত্রে পাঠ করি তখন খুবই ভাল লাগে। ভাবি আমাদের দেশেরও পৃথিবীর উন্নত দেশের সারিতে দাঁড়াতে আর বেশি বাকি নেই। আমাদেরকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের নাগরিক বলতে পারবে না। দেশের বাইরের এবং ভিতরের যে সব ব্যক্তি আনন্দের সাথে আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের নাগরিক বলে ঠাট্টা-তামাশা  করতেন তারা আমাদের এই উন্নতির পরিসংখ্যান দেখে অবশ্যই চুপসে যাবেন। দেশের বাইরে আমাদের কেউ আর ভিক্ষুক বলতে পারবে না। কিন্তু আমরা যখন পত্রপত্রিকায় একশ্রেণীর লোকের অনৈতিক কা- কারখানার ব্যাপকতা দেখি, তখন আমাদের মনও চুপসে যায়। তখন ভাবি পড়াশুনা জানা একশ্রেণীর মানুষ কিভাবে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে নিয়ে নৈতিক মূল্যবোধহীন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। আমাদের মন থেকে কি মানবিক মূল্যবোধের কণাটুকু একেবারে বাষ্প হয়ে অন্ধকারে উড়ে গেছে ? দেশের বিবেকবান মানুষরা মনে করেন, এই ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল অধিক। রাষ্ট্রই পারে তার সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ ব্যবহার করে এমন আইসিইউ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের বড় বড় রাঘব বোয়ালের কঠিন শাস্তি দিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শুদ্ধ করতে। একদল লোক মানুষের জীবনমৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করবে, তা কি মেনে নেওয়া যায় ? তা চলতেও দেওয়া যায় না। আমাদের দেশের ডাক্তারদের বড় বড় সংগঠন আছে। তারা কি পারেন না দলবাজি ছেড়ে গুটি কয়েক অসাধু ডাক্তারকে শাস্তি দিয়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্নাম দূর করতে ? নাকি তারাও সিন্ডিকেট বাণিজ্যের ব্যক্তিদের সামনে অসহায়। এ ব্যাপারে হৃদয়বান ডাক্তারদের উচিত হবে, নিজেদের পেশার সম্মান রক্ষা করার তাগিদে কিছুসংখ্যক অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা চিকিৎসা ব্যবস্থার নামে অপচিকিৎসা কিংবা দুর্বৃত্তপনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার শ্রী বৃদ্ধি করা। সরকারের সাথে সাথে যদি হৃদয়বান ডাক্তাররাও আইসিইউ ব্যবসার সাথে জড়িত সিন্ডিকেটের লোকদের রুখে দেন তবে রক্ষা পাবে দেশের মানুষ এবং উজ্জ্বল হবে চিকিৎসা ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে নিয়োজিত সাধু ব্যক্তিদের মুখ।
লেখক: কবি, গল্পকার ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন