Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিনস্তরে ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম

উৎপাদনকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত পাকা রশিদ ও চালান ছাড়াই চলছে ব্যবসা ঢাকার বেশিরভাগ দোকানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন করা হচ্ছে না একে অপরের ঘারে দোষ চাপানোর চেষ্টা রমজান সামনে রেখে অপকৌশল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রমজান মাস সামনে রেখে তিনস্তরে ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের কারণে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। পণ্যের মূল্য নিয়ে লুকোচুরি করতে পাকা রশিদ, চালান, মেমো কিংবা ইনভয়েস ছাড়াই উৎপাদনকারি, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। মূল্য নির্ধারণের ফাঁকফোকরে উৎপাদনকারি থেকে খুচরা কারবারি একে অপরের কাছ থেকে দাম বেশি নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি ভোক্তার ওপর। কারণ দিনশেষে ভোক্তাকে বেশি দাম পরিশোধ করে পণ্যসামগ্রী কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে চিনি, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। এমনকি মুদিপণ্যের খুচরা দোকানে প্রতিদিনের মূল্য তালিকা প্রদর্শন করার বিধান থাকলেও খোদ রাজধানীর বেশিরভাগ ভোগ্যও নিত্যপণ্যের দোকানে সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। দাম বাড়াতে বিভিন্ন অপতৎপরতা শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এদিকে, বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে- রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ছোলা, ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনি ও আটার মতো পণ্যের দাম ইতোমধ্যে আরও বেড়ে গেছে। আমিষের প্রধান উৎস ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম এখন আকাশচুম্বী। অতিরিক্ত দামের কারণে নি¤œ মধ্যবিত্তের পাত থেকে উঠে যাচ্ছে গরু ও খাসির মাংস। প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। রোজার আগে আরেকদফা দাম বাড়ানোর আভাস দিয়েছে মাংস ব্যবসায়ীরা। সেক্ষেত্রে রমজান মাসে ৮০০ টাকায় গরুর মাংস মিলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। মহামারি করোনা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সঙ্কটের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সঙ্কটকে পুঁজি করে অতিরিক্ত ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে বলে মনে করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীদের পরস্পর যোগসাজশের কারণে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য, পণ্যমজুদ, আমদানি ও রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ওই বৈঠকে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে উৎপাদনকারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মুখোমুখী আলাপে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণের ফাঁকফোকর। এছাড়া বৈঠকে নিত্যপণ্যের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি কেন, তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। এ নিয়ে বচসাও হয়েছে।
মিল গেটে বেশি দাম রাখা, চালানে যে দর লেখা হয় তার চেয়ে বেশি নেওয়া, বিভিন্ন পর্যায়ে কেনা দর লুকিয়ে রাখার মত বিষয়গুলো নিজেদের বক্তব্যেই তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে পুরান ঢাকার মৌলভী বাজার কেন্দ্রিক পাইকারি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ভোজ্যতেল ও চিনি উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান বা মিলমালিকদের প্রতিনিধিরা রীতিমতো বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তারা মুখোমুখি বক্তব্যে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপান। পণ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সভায় তেল ও চিনি ব্যবসায়ীরা মূল্য নির্ধারণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়ান। তবে সব কথা বললে ব্যবসা হারাতে হবে বলেও শঙ্কার কথা জানান মৌলভী বাজারকেন্দ্রিক পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী েেগালাম মাওলা। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত চিনির সর্বোচ্চ দাম প্রতিকেজি ১০৭ থেকে ১১২ টাকার মধ্যে হলেও বাস্তবে খুচরা দোকানে ১২০ টাকার নিচে খোলা বা প্যাকেট চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। ওই সময় চিনির পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, সরকার যে দর নির্ধারিত করে দিয়েছে মিল থেকে সেই দরে চিনি পাওয়া যায় না। তারা রশিদও দেয় না। তাহলে আমরা কিভাবে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করব? এসময় সেখানে উপস্থিত সুগার রিফাইনার্স এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি মেঘনা গ্রæপের সিনিয়র এ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার দাবি করেন, পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি সঠিক নয়। তারা অবশ্যই ইনভয়েস দেন। সেখানে বিক্রির তথ্য উল্লেখ থাকে।
তখন ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা বলেন, ইনভয়েস বলেন আর যাই বলেন, যেটা দেওয়া হয় সেখানে প্রকৃত দামের চেয়ে আরও কম লেখা থাকে। আরও অনেক বিষয় আছে। কাগজে যে দাম লেখা থাকে নেওয়া হয় তারচেয়েও বেশি। এসব কথা বলতে গেলে ব্যবসা করা যাবেনা। মিলথেকে আমাদেরকে আর পণ্যও দেওয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে সিটি গ্রæপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, যারা পণ্য কেনেন, তারা রসিদ পান। যিনি রসিদ পান না, তিনি তো পণ্যই নেন না। কারণ, রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি হয় না। এসময় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আপনারা এসব নাটক সিনেমা বন্ধ করেন। এক কোটি মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। মাত্র কয়েকজন লোকের জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে অসাধু বলা হয়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্যই অনিয়মগুলো করছে। সেই সভায় ট্যারিফ কমিশনের এককজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেনর, যেই মূল্য ঘোষণা করা হয় সেটা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করেন। আমাদের বিভিন্ন রকম প্যারামিটার আছে। ব্যবসায়ীরা ওইসব খাতে তাদের খরচের হিসাব ট্যারিফ কমিশনে জমা দেন। সূত্র অনুযায়ী তাদের তথ্যগুলো যাচাই বছাই করে আমরা দামটা ঘোষণা করি। এই মূল্য কেন কার্যকর হয় না সেটা বলতে গেলে অনেক ভেতরের খবর চলে আসবে।
এদিকে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান মনে করেন, রমজান মাস সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। তিনি বলেন, পাইকারি থেকে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত ব্যবসা চলছে অনেকটা মৌখিক অথবা গোপন নথির মাধ্যমে। মূলত দাম বাড়াতে তাদের এই অপকৌশল। সরকারি নির্ধারিত দাম কার্যকর না করা। দিনশেষে এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর। কারণ তাকে বেশি মূল্য দিয়ে নিত্যপণ্য কেনাকাটা করতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নজরে আনা হয়েছে। আশা করছি, ব্যবসায়ীদের এই অপকৌশল টিকবে না। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবো। এফবিসিসিআইয়ের ওই বৈঠকে একজন ফল ব্যবসায়ী জানান, বিদেশি ফল আমদানি নিরৎসাহিত করা হয়েছে। এ কারণে বাজারে আমদানিকৃত ফলের দাম বেশি।
ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোজার মাসে ৪০-৪৫ হাজার টন খেজুরের চাহিদা আছে। গত নভেম্বরে খেজুরের মৌসুমের সময়ে এলসির কিছু সমস্যা ছিল। পরে সেই সমস্যা কেটে গিয়ে খেজুর আমদানি করা গেছে। এখন আশা করছি, রোজার মাসে খেজুরের কোনো সংকট হবে না। তবে ৮৫ টাকার ডলার ১০৫ টাকা হয়ে যাওয়ায় দাম গতবছরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হতে পারে। মসলা আমদানিকারক হানিফ মিয়া বলেন, রসুনের দাম বেড়েছিল এলসি সমস্যার কারণে। কিন্তু এখন সমস্যা কেটে গেছে। রসুনের দাম শিগগির কমে যাবে। ছোলা ব্যবসায়ীরা জানান, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত থেকে ছোলা আসছে। ছোলার কোনো সংকট হবে না। ৮২ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে ছোলা খাওয়া যাবে। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে ইতোমধ্যে ছোলা ও খেজুরর দাম বেড়ে গেছে। প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকায়। যা গত একমাস আগেও ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে খুচরা বাজারে। এছাড়া আদা ও রসুনের দামও বেশি। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, একদিকে ডলার সঙ্কট, অন্যদিকে বিকল্প বাজার থেকে পণ্য আমদানির উদ্যোগ এবং এলসি বা ঋণপত্র সমস্যার কারণে এবার পণ্য আমদানি ২৫-৩০ভাগ কম হয়েছে। একারণে পণ্যের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, রোজা সামনে রেখে এবার ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পণ্য আসতে শুরু করেছে। একারণে রমজানে সঙ্কট হবে না। জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ