পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে : খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার চেংড়াছড়ি গুচ্ছগ্রামের আব্দুল লতিফ (৭০) ছোট একটি ছাউনি ঘরে পরিবারের পাশপাশি গরু-ছাগল নিয়ে একইসাথে রাত্রি যাপন করেন। ৩০ বছর আগে সরকার তাকে পার্বত্য অঞ্চলে এনে বসতের জন্য ২৫ শতাংশ এবং চাষের জন্য চার একর জমি দিলেও তা কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। সব হারিয়ে সরকারি রেশন পেয়ে ছোট একটি ঘরে দিনাতিপাত করছেন তিনি। একদিন রেশন না দিলে বন্ধ থাকে খাওয়া-দাওয়া। আশপাশের পাঁচ-ছয়টি গ্রামের ৪শ’ পরিবার সেই গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় নিয়ে একইভাবে জীবনযাপন করছেন। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান (টিন, কম্বল) বিতরণে গিয়ে একজন বাঙালিরও নাম খুঁজে পাননি সরকারি কর্মকর্তারা। পার্বত্য অঞ্চলকে অনগ্রসর অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চাকরি, উচ্চশিক্ষা বৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা রকম কোটা ও সুযোগ-সুবিধা চালু করেছে সরকার। তবে একই এলাকায় বসবাস করে এবং জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হয়েও তা পাচ্ছেন না বাঙালিরা। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগিরা। অবিলম্বে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে জনসংখ্যানুপাতে সকল সুযোগ-সুবিধা বণ্টন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে একজন বাঙালি প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়ার দাবি জানান তারা।
তিন পার্বত্য জেলার সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই এলাকার বাঙালিরা সরকারি বরাদ্দের কোনো কিছুই পান না। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে যেসব সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ অঞ্চল এবং অনগ্রসর অঞ্চল হিসেবে যেসব বরাদ্দ দেয়া হয় তার পুরোটাই ভোগ করছে উপজাতিরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে উপজাতিরা নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং তারাই তালিকা করেন কাদেরকে বরাদ্দ দেয়া হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্থানীয় প্রতিনিধিদের তালিকায় কোনো বাঙালির নাম থাকে না। ফলে জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছাড়ায় চলতে হচ্ছে। অন্য দিকে উপজাতি জনগোষ্ঠী এককভাবে এর পুরোটা লাভ করছে।
জানা যায়, মেডিক্যাল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সকল উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর কোটার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে কোটাতেই। নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে। অন্য দিকে একই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বাঙালিদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ এখনো তৈরি করা হয়নি। পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী দু’টি জনগোষ্ঠীর জন্য দুই রকম নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। পার্বত্য বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তাও সেটি পার্বত্য বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের ফলে। শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন পাহাড়ের বাঙালিরা। উপজাতি জনগোষ্ঠী করের আওতামুক্ত হলেও বাঙালিদের কর দিতে হচ্ছে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর আদায় করা চাঁদার ক্ষেত্রে বাঙালিদের কাছ থেকে অধিক হারে আদায় করা হয়। পার্বত্য এলাকায় উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ দু’লাখ টাকার মধ্যে হলে ঠিকাদারী সম্পূণরূপে উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। দু’লাখ টাকার ঊর্ধ্বে বরাদ্দকৃত প্রকল্পের ১০ শতাংশ উপজাতিদের আর বাকি ৯০ শতাংশ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হলেও তার বেশির ভাগ পায় উপজাতিরাই। আয়কর দিতে হয় না বলে তারা বাঙালিদের চাইতে কম দরে কাজ করার সুযোগ পায়। উপজাতীয়রা ব্যাংক ঋণ নিলে তাদের সুদ দিতে হয় শতকরা মাত্র পাঁচ টাকা। আর বাঙালিদের সুদ দিতে হয় ১৬ শতাংশ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ শিক্ষাবৃত্তিতে বাঙালিরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। জনসংখ্যার দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা ৪৮ হলেও তাদের জন্য মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষাবৃত্তি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্য দিকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন উপজাতি তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫২ শতাংশ অধিবাসীদের জন্য ৭৭ শতাংশ শিক্ষাবৃত্তি বরাদ্দ করা হয়েছে। আর ২৩ শতাংশ বাঙালি শিক্ষার্থীদের তালিকায় মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দু ও বড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও রাখা হয়েছে। ফলে বৈষম্যের শিকার হয়েছে তারাও।
গতবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ শিক্ষাবৃত্তি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় সর্বমোট ৪৭৫ জনকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ৩৬৪ জন আর মাত্র ১১১ জন বাঙালি (মুসলিম, হিন্দু ও বডুয়া) শিক্ষার্থী। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় দেয়া ১৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে উপজাতি শিক্ষার্থী ১২১ জন, ৩৭ জন বাঙালি। রাঙামাটি জেলায় ১৫৯ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে উপজাতি শিক্ষার্থী ১১৩ জন আর মাত্র ৪৬ জন বাঙালি। বান্দরবান জেলায় ১৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রীকে উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেয়া হয়। এর মধ্যে উপজাতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩০ জন, আর মাত্র ২৮ জন বাঙালি শিক্ষার্থীকে এই বৃত্তি দেয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেড় শতাধিক এনজিওর মাধ্যমে কয়েক হাজার খানেক প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কোনোটিতেই বাঙালি অধিবাসীরা সুযোগ পাচ্ছে না। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে তা দেয়া হচ্ছে। রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলায় এনজিওগুলোর ২২৫টি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯টি ক্ষুদ্র প্রকল্প বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়।
পার্বত্য অঞ্চলের শহরের বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হলেও গ্রামের মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে বসতি ও চাষের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা। তিন জেলাতে এরকম মোট ৮৬টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। এগুলো ২৬ হাজার পরিবার পুনর্বাসন করা হয়। বর্তমানে পরিবারের সংখ্যা পাঁচ গুণ বাড়লেও রেশন কার্ড বাড়েনি একটিও। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার চেংড়াছড়ি গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মানবেতর জীবনযাপন করছেন পাহাড়ি বাঙালিরা। থাকার জায়গার অভাবে একই ঘরে গরু, ছাগল এবং মানুষ বসবাস করছে। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১ সালে ৫৬টি পরিবারকে ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাসের জন্য খাস জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু পাহাড়ি উপজাতিদের অব্যাহত বিরোধীতা ও আক্রমণের কারণে ১৯৮৮ সালে তাদেরকে একটি গ্রামে একত্রিত করে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। সে সময় ৫৬টি পরিবারকে ২৫ শতাংশ বসতি জমি এবং পৌনে চার একর চাষযোগ্য জমি দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়। ৩০ বছর পর সেই ৫৬ পরিবার এখন ৪০০ পরিবারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ জমির মধ্যে এক শতাংশও বাড়েনি। অন্য দিকে চাষযোগ্য যে পৌনে চার একর জমি তাদের দেয়া হয়েছিল তা পাহাড়ে হওয়ার কারণে উপজাতিদের বাধা ও অপহরণের ভয়ে সেগুলোতে চাষ তো দূরের কথা, পা পর্যন্ত ফেলতে পারে না বাঙালিরা। কেউ বাধা ডিঙিয়ে চাষ করার কথা চিন্তা করলেই রাতের অন্ধকারে তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মুকুল হোসেন বলেন, ৩০ বছর আগে যে বসতি জমি দিয়েছিল, এখন সেই জমিতের আমাদের পরিবারদের আর জায়গা হয় না। মানুষ বেড়েছে পরিবার বেড়েছে কিন্তু জমিতো বাড়েনি। অন্য দিকে চাষের জন্য পাহাড়ে যে জমি দিয়েছে, সেই জমিতে তো আমরা যেতেই পারি না। পুলিশের কাছে অভিযোগ এবং কোর্টের কাছে সুরাহা চাইলে বলা হচ্ছে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান কর। ৭০ বছর বয়সী মো: আব্দুল লতিফ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যে চাষের জমি দিয়েছিল, সেখানে তো ভয়ে যেতে পারছি না। আর যে জমিতে প্রথমে বাড়ি করেছিলাম, সেখানে শান্তিবাহিনীর অত্যাচারে ছেড়ে আসতে হয়। আবুল হাসেন বলেন, কুলারাম পাড়া, লেম্বু ছড়িতে প্রথমে তাদের বসবাস ছিল। যখন শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসের কারণে নিরাপত্তা দেয়া যাচ্ছিল না তখন ৮৮ সালে এই গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, ৮২’ সালে বসবাস শুরু করার পর শান্তিবাহিনী অত্যাচার শুরু করে। রাতের বেলা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়। ফায়ার করে ভীতি তৈরি করা হয়। এই নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আশপাশের বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে নিয়ে এসে এই গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়। গুচ্ছগ্রামের প্রধান ও ১১ নম্বর সেক্টরের ২ এম এফ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বলেন, এখানে বাঙালিরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গণতন্ত্র নাই, পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। নিকৃষ্ট, খুনি, রাজাকারের জাতি স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আবার সরকারও নতজানু হয়ে তাদের সহযোগিতা করছে। আমাদের নিজেদের দেশে আমরা নাগরিক না, নতুন করে নাগরিক হতে হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংরক্ষিত আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, এনজিওগুলো বলছে- পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কনফিডেন্স তৈরিতে তারা কাজ করছে। এর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ের বাঙালিরা এর কোনো অর্থই পায় না, সহযোগিতা পায় না। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে স্বীকার করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।