Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আশকোনায় জঙ্গি আস্তানায় প্রবেশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কিশোর আফিফের লাশের পাশে ৫টি গ্রেনেড
স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর দক্ষিণ খানের আশকোনায় জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের পর গতকাল রোববার ভবনটিতে আবার প্রবেশ করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সকাল পৌনে ১১টার দিকে তিনতলা ভবনে প্রবেশ করে ২৫ সদস্যর একটি বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল।
ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি। এর আগে সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য ওই ভবন ঘিরে রাখে। বাড়িটির নিচতলায় বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল গতকাল দিনভর তল্লাশি চালিয়েছে। পুলিশ বলছে, বাড়িটির যে ঘরে নিহত ‘জঙ্গি’ কিশোর আফিফ কাদরীর লাশ রয়েছে সেখানে পাঁচটি গ্রেনেড রয়েছে। এর মধ্যে দুটি গ্রেনেড বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে ওই ঘটনায় আহত শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গতকাল তার দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, আরো ৭২ ঘন্টা পর বলা যাবে শিশুটি আশঙ্কামুক্ত কিনা। এর আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, দুটি গ্রেনেডের পিন খোলা রয়েছে। ওই কক্ষের খাটের পাশে একটি গ্রেনেড আছে। আরেকটি গ্রেনেড রয়েছে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে। তিনি আরও জানান, জানালা দিয়ে দেখা গেছে, ওই কক্ষের দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে একটি সুইসাইডাল ভেস্ট পড়ে আছে। আরেকটি সুইসাইডাল ভেস্ট পড়ে আছে কিশোরের লাশের পাশে। রান্নাঘরের তাকের ওপরও একটি গ্রেনেড দেখা গেছে।
ছানোয়ার হোসেনের ভাষ্য, খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁরা কাজ করছেন। কোন গ্রেনেড কী অবস্থায় আছে বুঝতে পারছেন না। বাসার ওই ঘরটি অনেকটা মৃত্যুফাঁদের মতো হয়ে রয়েছে।
সিটিটিসি’র এডিসি ও বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, লাশের পাশে ও দরজার পাশে সুইসাইডাল ভেস্ট আছে। দরজার পাশের ভেস্টটি জেবুন্নাহার শিলার। তিনি গত শনিবার আত্মসমর্পণ করেছেন।
ছানোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ও খাটের ওপরে দুটি গ্রেনেড আছে। গ্রেনেডের পিনগুলো খোলা। যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। রান্নাঘরের তাকের ওপর একটি গ্রেনেড আছে।’ তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা মারা যাওয়ার আগে আমাদের জন্য কোনো ফাঁদ তৈরি করে গেছে কি না, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।’
পরে দুপুর আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের উত্তরা ইউনিটের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, তারা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত কাজ করে ওই কক্ষ থেকে গ্যাস নিঃসরণ করেন। স্মোক রিজেকটরের মাধ্যমে জানালায় ভ্যাকুয়েশন তৈরি করে গ্যাস বের করা হয়। এখন বোমা ডিসúোজাল ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভেতরে অবস্থান করছে।
তিনি আরো জানান, তাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে আছে। এ ছাড়া, পাঁচটি ইউনিট আশপাশে স্ট্যান্ডবাই করে রাখা হয়েছে।
গ্যাস নিঃসরণে বিলম্ব হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ভেতরে বদ্ধ রুম ছিল। গ্যাসটা ভারী। তা ছাড়া, ঘরে আসবাবপত্র থাকার কারণে গ্যাস নিঃসরণে বিলম্ব হয়। ভেতরে কাঁদানে গ্যাস ও গ্রেনেডের ধোঁয়া ছিল।’
 এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের দল ভবন থেকে বের হয়ে গেলে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ শুরু হয়। ২টা ৪৮ মিনিটে ও ২টা ৫৪ মিনিটে দুটি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়।
উত্তরা ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, গত শনিবার অভিযান চলাকালে ছোড়া গ্যাস ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঝাঁজ ঘরটিতে জমেছিল। গ্যাস বের করার কাজ আপাতত শেষ। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এখনো ঘটনাস্থলে আছে।
সকালে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন ডিভিশনের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাস দূর করার পর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ করবে। এরপরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজমের ক্রাইম ইউনিট কাজ করবে। সবশেষে পুলিশ লাশ নিয়ে যাবে।
জঙ্গি আস্তানায় অভিযান ধারাবাহিক কার্যক্রম   Ñকমিশনার
রাজধানীর কাকরাইলে গির্জা পরিদর্শন শেষে ব্রিফ করেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, হলি আর্টিজানের পর যেসব জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) আশকোনায় অভিযান চালানো হয়। এটি নতুন কোনো পরিকল্পনার অংশ নয় বলেও জানান তিনি।
গতকাল  সকাল ১০টায় বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর কাকরাইলে গির্জা পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, উত্তরা দক্ষিণ খানের আশকোনায় ‘সূর্যভিলা’ নামে ওই বাড়িতে জঙ্গিদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র বা গোলাবারুদ পাওয়া গেছে তা লোকালি তাদের কাছে এসেছে। কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ বাইর থেকেও এসেছে। তবে এসব অস্ত্রের উৎস কোথায় থেকে এসেছে তা আমার তদন্ত করে দেখবো।
অভিযান প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘রিপল২৪’ অভিযানে ৭ জঙ্গির মধ্যে ৪ জন আত্মসমর্পণ করেছেন, দু’জন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে মিরপুর রূপনগরের জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদের স্ত্রী ও সন্তান এবং আরেক জঙ্গি মুসার স্ত্রী ও তার সন্তান আত্মসমর্পণ করেছে।
এদিকে অভিযানে নিহত হয়েছে সুমন নামের এক জঙ্গির স্ত্রী, আর আহত শিশুটি জানিয়েছে তার বাবার নাম ইকবাল ও মা শাকিলা। নিহত আরেকজনের নাম পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, নারী জঙ্গির সন্ধান আমরা আগেও পেয়েছি, এটা প্রথম নয়। নারী জঙ্গিরা জঙ্গি পরিবারেরই সদস্য। এখানে পুরুষ ও নারী সবাই জঙ্গি কার্যক্রমে মোটিভেট হতে পারে।
জঙ্গি মুছা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুছা বাংলাদেশ আত্মগোপন করে আছে। জঙ্গি মুছা আমাদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত আসামি। তিনি জেএমবির তালিকাভুক্ত সদস্য। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে, চলবে। এটি ধারাবাহিক কাজের অংশ। জঙ্গি দমনে পুলিশ শতভাগ সফল। প্রতিটি অভিযানই শতভাগ সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর ৬২টি গির্জায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার।
তিনি বলেন, প্রতিটি গির্জায় আসা এবং যাওয়ার পথে থাকবে পুলিশের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গেটে থাকবে আর্চওয়ে, সবাইকে তল্লাশির মধ্যদিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। রাজধানী জুড়ে থাকবে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এছাড়াও আসন্ন ‘থার্টি ফাস্ট’ উপলক্ষে রাজধানীতে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়। ওই দিন রাজধানী জুড়ে পুলিশের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানান ডিএমপি কমিশনার।
কিশোরের লাশের পাশে পিস্তল ছিল  ------মনিরুল ইসলাম
এদিকে রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে অভিযান চালানো বাড়ি ‘সূর্য ভিলা’ থেকে  এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাড়ির একটি কক্ষে পড়ে থাকা ওই লাশের হাতে পিস্তল ছিল। ওই বাড়ি থেকে গ্রেনেড, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে গতকাল।গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম উদ্ধার অভিযান শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এছাড়া এ ঘটনায় গত রাতেই রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সর্বমোট ১৯টি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম, কনটেইনার ও স্পিøন্টার পাওয়া গেছে। জঙ্গিরা বেশ কিছু কাগজপত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল ও প্রায় ১২ লাখ টাকা পুড়িয়ে নষ্ট করেছে।
তিনি বলেন,  যে কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার হাতে একটি নাইন এমএম পিস্তল ছিল। পাশে আরও একটি একই ধরনের অস্ত্র পড়ে ছিল। এ নিয়ে সেখান থেকে মোট তিনটি অস্ত্র পাওয়া গেল। তিনি জানান, লাশটি আফিফ কাদেরীর। আফিফ আজিমপুরে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরীর যমজ দুই ছেলের একজন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য উদ্ধার হওয়া লাশ গতকালই ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হবে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, পুলিশের হাতে যারা আটক রয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে গতকাল আত্মঘাতী জঙ্গি নারীর প্রথম স্বামীর নাম ইকবাল। কিছুদিন আগে ইকবাল ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে ওই নারী সুমন নামের একজন সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেন। এক-দেড় মাস আগে সুমন নিখোঁজ হয়। চিকিৎসাধীন আহত মেয়েটি আত্মঘাতী নারীর আগের স্বামী ইকবালের মেয়ে বলে জানা গেছে। মইনুল ইসলাম মুসা ইমতিয়াজ পরিচয়ে ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে নব্য জেএমবির অন্যতম প্রধান নেতা। গুলশান হামলায় এই মুসার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশান হামলার আগেই মুসা দলে যোগ দেয়। তবে ওই হামলার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে ১৬ ঘণ্টা ধরে ওই বাড়ি ঘিরে অভিযান চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ‘অপারেশন রিপল ২৪’ নামে ওই অভিযানে নিহত হন দুই ‘জঙ্গি’। তাঁদের মধ্যে এক নারী ‘জঙ্গি’ আত্মঘাতী হন। আত্মসমর্পণ করেন দুই শিশুসহ দুই নারী। আহত এক শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ