Inqilab Logo

শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানিকে হাজার কোটি টাকা ছাড়

আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিলাম প্রক্রিয়ায় সরকারের শত কোটি টাকা ক্ষতি

স্টাফ রিপোর্টার ও আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিইপিসিএল) ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। সেই বেসরকারি কোম্পানিকে সরকারি ভাবে এক হাজার কোটি টাকার শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আসলে কাগজে-কলমে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

অপর দিকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল) এর ৬৪ মেগা ওয়াটের দুটি পুরাতন ইউনিট বিক্রয়ের নিলামে (দরপত্র) অস্বচ্ছতা ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কারণে সরকারের শত কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানিকে ১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প আইনের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এই ছাড় দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রকল্পে আর্থিক দলিল ও চুক্তির বিপরীতে আরোপ করা স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ১ হাজার ২৩ কোটি ৭২ লাখ ২০ হাজার ৬১৮ টাকা মওকুফ করা হয়েছে। এ কোম্পানির স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফের জন্য কয়েক বছর আগে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি আইআরডির কাছে আবেদন করে। জাতীয় স্বার্থে এবং ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই অনুরোধ করা হয়। এর আগে অন্য কোম্পানির জন্যও এমন অনুরোধ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এসব অনুরোধে সাড়াও দেয় আইআরডি। কারণ, ১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প আইন মানলে ওই সব কোম্পানিকে শত শত কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে দিতে হতো। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে স্ট্যাম্প আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি যাই আরোপযোগ্য হোক না কেন, এর পরিমাণ কোনোভাবেই ১০ কোটি টাকার বেশি হবে না। গত ১ জুলাই থেকে নতুন সংশোধনী কার্যকর করা হয়। কিন্তু বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি আবেদনটি কয়েক বছর আগে করায় সেভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে তা অনুমোদন হয়। প্রজ্ঞাপনেও ওই ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোট ১৫টি খাতে এই শুল্ক মওকুফ করা হয়। সবচেয়ে বেশি ১৯৯ কোটি টাকা মওকুফ করা হয় মেরিন বিমা খাতে। এ ছাড়া ভূমি ভাড়া, বিমা, নিরাপত্তা, শেয়ারের চুক্তি, বিদ্যুৎ বিতরণ চুক্তি ইত্যাদি খাতেও বিপুল অর্থ মওকুফ করা হয়।

দেশে বিভিন্ন বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিকে শুল্ক-করসহ নানা ধরনের কর ছাড় দেওয়া হয়। এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব সুরাইয়া পারভীন জানান, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে বড় বড় প্রকল্পে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুরোধে আমরা স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করে থাকি। এই কোম্পানির আবেদনটি ২০২২ সালের আগে করায় সেই অনুযায়ী তাদের শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। তাই মওকুফ করা স্ট্যাম্প ডিউটির অঙ্কটি অনেক বড় মনে হচ্ছে। আসলে সরকার মওকুফ করেছে মাত্র ১০ কোটি টাকা।

এদিকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল) এর ৬৪ মেগা ওয়াটের দুটি পুরাতন ইউনিট বিক্রয়ের নিলামে (দরপত্র) অস্বচ্ছতা ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কারণে সরকারের শত কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ উঠেছে। নিলাম প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেটের দাপটে ১০ থেকে ১৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে না পারা এবং একাধিক ঠিকাদারকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করে টেন্ডার ড্রপ করতে না দেওয়ায় প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তার সাথে শতকোটি টাকার মূল্যের ইউনিট দুটিকে প্রস্থাবিত প্রাক্কলিত মূল্য মাত্র ২১ কোটি টাকা নির্ধারণ করায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোন রুপ কারসাজি রয়েছে কিনা এ নিয়ে সচেতন মহলের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের অভিযোগে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের অনভিজ্ঞতা-অদক্ষতা-অসততায় বাজার মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক কম মূল্যে ইউনিট দুটির প্রস্তাবিত মূল্য নির্ধারণ, নিলাম প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম, ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের প্রভাব ও অবৈধ হস্তক্ষেপে এমনটি হয়েছে। রাষ্ট্রিয় আর্থিক স্বার্থে পুরু নিলাম প্রক্রিয়াটি তদন্ত, বাজার মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পুনঃপ্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণ ও যথাযথ নিলাম প্রক্রিয়া অনুসরণের দাবি করেন তারা। তবে এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষের দাবি নিয়ম মেনেই নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৭০ সালে ৬৪ মেগাওয়াটের দুটি থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট (ইউনিট) স্থাপনের মধ্য দিয়ে আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু যা পরবর্তীতে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল) নামকরণ হয়। স্থাপিত দুটি ইউনিটের আয়ুস্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ২০০৫ সালে অতিক্রম হয়। ফলে ২০১৪ সনে ইউনিট-১ এবং ২০১৮ ইউনিট-২ অবসরে যায়। এদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের নেয়া মহাপরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অংশ হিসেবে ইউনিট দুটির স্থলে নতুন অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সেই মোতাবেক ইউনিট দুটি নিলামে বিক্রয় ও অপসারনের উদ্দেশ্যে এদের প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণে এপিএসসিএল এর প্রধান প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। অভিযোগ উঠেছে এ কমিটির প্রধানসহ কোন সদস্যের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তারা ইউনিট দুটির প্রস্তাবিত (প্রাক্কলিত) মূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ২১ কোটি টাকা যা বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ গত দুই বছরে লোহা ও জাতীয় পণ্যের মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে গত ডিসেম্বরে ইউনিট দুটি বিক্রয়ে পত্রিকায় দরপত্র দেয় কর্তৃপক্ষ। এপিএসসিএলসহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় হতে দরপত্র সংগ্রহের স্থান উল্লেখ করা হলেও দরপত্র জমা কেবল তাদের নিজস্ব কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে ১০০টির বেশি বিক্রি হলেও মাত্র ৬টি দরপত্র জমা পড়ে। অপরদিকে একাধিক বড় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নিলামে অংশগ্রহণে বাধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে, দরপত্র জমা দানে স্থানীয় ঠিকাদারি সিন্ডেকেট গুষ্টি বাধা দেন। এ নিয়ে হাতা-হাতির ঘটনাও ঘটে। যে ৬টি দরপত্র দাখিলকারি প্রতিষ্ঠান হলো- মেসার্স সফিউল্লাহ ট্রেডার্স ৩৭ কোটি ৪০ লক্ষ, নীরা স্টীল কর্পোরেশন ৩৮ কোটি সাড়ে ৬২ লাখ, মেসার্স নাবিল এন্টারপ্রাইজ ৬১ কোটি সাড়ে ৮৭ লাখ, চন্দ্রপুরি এন্টারপ্রাইজ ৩২ কোটি ২০ লাখ, ত্রিরতœ ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মায়াবি এন্টারপ্রাইজ (কোন মূল্য দেওয়া হয়নি)। নিলামে অংশগ্রহণকারী নাবিলা এন্টারপ্রাইজ ৬১ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা সর্বোচ্চ দরদাতা হলেও ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা দর দিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেওয়ায় সম্পূর্ণ নিলাম প্রক্রিয়াটি প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে। ঠিকাদারদের অভিযোগ সিন্ডকেট সদস্যরা তাদেরকে নিলামে অংশগ্রহণ করতে বাধা দিয়ে জোরপূর্বক নিলামটি ভাগিয়ে নিয়েছে। নিলাম প্রক্রিয়াটি বাতিল না করা হলে কোম্পানি প্রায় শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে।

এ ব্যাপারে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে ফোনে বলেন, যথাযথ ব্যবস্থায় নিলাম প্রক্রিয়া হয়েছে। এখনো কাউকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। কোন প্রকার অনিয়ম থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।যারা অভিযোগ দিয়েছে তা ঠিক হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ