Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আইনি জটিলতা কাটেনি গচ্ছিত অর্থ প্রাপ্তিতে

মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন ৬ বছর আগে। রেখে যান তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ওয়ারিশ রেখে যান স্ত্রীসহ ৬ জন। তিন ছেলে, দুই মেয়ে। পুরনো কাগজপত্র ঘেটে পাওয়া গেলো একটি বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ডিপোজিট সিøপ। সন্ধান মিললো একই ব্যাংকে তিনটি অ্যাকাউন্ট। একটি চলতি হিসাব। দু’টি সঞ্চয়ী। সঞ্চয়ীর একটিতে টাকা আছে ১৩ হাজার। আরেকটিতে ৭ লাখ। ১৩ হাজার টাকার অ্যাকাউন্টের নমিনি মেজো ছেলে। ৭ লাখের অ্যাকাউন্টটির নমিনি ছোট ছেলে। পিতার রেখে যাওয়া টাকা ছোট ছেলে তুলতে গেলে আটকে দেয় ব্যাংক। বলা হয়, উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সব ওয়ারিশ হার অনুযায়ী পাবেন গচ্ছিত টাকার ভাগ। অ্যাকাউন্টধারীর মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশান সার্টিফিকেট, এনআইডি/পাসপোর্ট, নানা রকম প্রমাণাদি সংগ্রহে লেগে যায় ৭ থেকে ৮ মাস। টাকা উত্তোলনের স্বার্থে অন্য ওয়ারিশগণও তার টাকা উত্তোলনে অনাপত্তি দেন। টাকা প্রদানের দিন প্রত্যেক ওয়ারিশকে ফোনও দেয়া হয় ব্যাংক থেকে। টাকা উত্তোলনের স্বার্থে সবাই ছোট ভাইয়ের হাতে টাকা প্রদানে সম্মতি দেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে পরক্ষণেই। মাজহারুল ইসলামের ছোট ছেলে পুরো টাকাই ‘নিজের’ দাবি করেন। বলেন, এ টাকা বাবা আমার জন্য অ্যাকাউন্টে রেখে গেছেন।

রাজধানীর পোস্তগোলার একটি পরিবারের ঘটনা এটি। কিন্তু এ ধরণের ঘটনা সারা দেশেই ঘটছে।
ব্যাংক আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত টাকা তার নমিনি (মনোনীত ব্যক্তি) পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ীও, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংকের টাকা তার নমিনি বা নমিনির অনুপস্থিতিতে রেখে যাওয়া নির্দিষ্ট ব্যক্তি পাবেন। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল একটি সিভিল রিভিশন পিটিশনের প্রেক্ষিতে এই আইনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ এই মর্মে রায় দেন যে, সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি মারা গেলে ওই সঞ্চয়ের টাকা নমিনির (মনোনীত ব্যক্তির) পরিবর্তে অ্যাকাউন্টধারীর উত্তরাধিকারী পাবেন। নমিনি পালন করবেন ট্রাস্টির ভূমিকা। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নমিনি টাকা উত্তোলন করে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হার অনুসারে বণ্টন করে দেবেন।

এই রায়ের প্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো অ্যাকাউন্টধারী, নমিনি, উত্তরাধিকারী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মাঝে নতুন নুতন সঙ্কট দেখা দেয়। প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, মৃত ব্যক্তির সঞ্চিত টাকা উত্তরাধিকারীও দাবি করছেন । নমিনিও দাবি করছেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে দেশের তফসিলি ও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো দ্বিধায় পড়ে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া টাকা নমিনি পাবেন আবার আদালতের রায় অনুযায়ী এ টাকা পাবেন উত্তরাধিকারী। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় অনেকে উত্তরাধিকারের বাইরেও নমিনি মনোনীত করে যান। অনেকে সন্তান নাবালক থাকার কারণে ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, ঘনিষ্ট আত্মীয় কিংবা বিশ্বস্ত কাউকে নমিনি করে যান। অবিবাহিত নারীরা বাবা-মা, ভাই- বোনকে নমিনি করেন। অবিবাহিত পুরুষরা নমিনি করেন বাবা-মা, ভাই- বোনকে। কিন্তু এই ব্যক্তিই যখন মারা যান তখন সম্পত্তির ওয়ারিশ হয়ে যান নমিনি বহির্ভুত স্বামী কিংবা স্ত্রী। নিঃসন্তান কিংবা অবিবাহিত পুরুষদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে যান ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে। কিন্তু ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ নমিনিকে দিলে ওয়ারিশগণ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসব কারণে ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির অর্থ উত্তোলনে জটিলতা আরো বেড়ে যায়। নমিনি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং পরিবারের সদস্যদের মাঝে ব্যাংকে থাকা অর্থ-সম্পদ নিয়ে বাঁধে বিরোধ। ঝগড়া-বিবাদ, মোকদ্দমা, খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটে। এর ফলে ব্যাংকগুলোও টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। অনেক সময় উত্তরাধিকারকে টাকা দিতে গিয়ে ব্যাংকও আইনি জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছে। নমিনি আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন। আবার নমিনিকে টাকা দেয়া হলে উত্তরাধিকারীরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের ওই রায় প্রকাশের পর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখেন। ফলে এ নিয়ে নানামুখী সঙ্কটে রয়েছেন ভুক্তভোগীরা। উভয়সঙ্কটের মুখোমুখি এখন ব্যাংকগুলো। উচ্চ আদালত রায় দিলেও বিষয়টি এখনও শতভাগ মীমাংসিত নয়।

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও ব্যাংক আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজের মতে, আইন অনুযায়ী নমিনিই ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে থাকা টাকা পাওয়ার কথা। তবে এ কারণে উত্তরাধিকারীরা সেই অর্থ থেকে যে বঞ্চিত হবেন সেটি নয়। কেউ মারা গেলে তার সঞ্চিত অর্থ বা তার অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ নমিনিকে দিয়ে এ সম্পর্কিত প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পরের বিষয়টি হলো, নমিনি ও উত্তরাধিকারীদের। আইনে বলা আছে, নমিনিকে দেয়া মানে উত্তরাধিকারীদের অধিকার ক্ষণœœ হওয়া নয়। অর্থাৎ নমিনি যদি উত্তরাধিকারীদের সেই টাকা না দেন, তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবেন। অর্থাৎ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন শেষ করবে নমিনির হাতে অর্থ তুলে দিয়ে। কিন্তু তিনি যদি সেই অর্থ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিতরণ না করেন তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবে।

এর মানে হচ্ছে, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাওয়ার পর নমিনির কাজ হবে ওই ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের মাঝে সেটি বণ্টন করে দেয়া। সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী নাজনীন নাহারের মতে, মৃত ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখে যাওয়া টাকা নমিনিকে দেয়ার বিধানও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওই অ্যাকাউন্টের নমিনি ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করবেন মাত্র। যদি তিনি এর ব্যত্যয় ঘটান তাহলে সেটি হবে আইনের লঙ্ঘন। সে ক্ষেত্রে ওয়ারিশগণ প্রতিকার চাইতে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।

কী বলছে শরীয়াহ আইন : শরীয়ত অ্যাপ্লিকেশান অ্যাক্ট ১৯৩৭-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়া আইন প্রযোজ্য হবে। অপরদিকে ব্যাংকিং কোম্পানিজ আইন, ১৯৯১-এর ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রচলিত অন্য কোনো আইনে কিংবা কোনো উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোনো প্রকার দলিলে যাই থাকুক না কেন, আমানতকারী কোনো ব্যক্তিকে নমিনি হিসেবে মনোনীত করলে আমানতকারীর মৃত্যুর পর উক্ত আমানতের ব্যাপারে মনোনীত ব্যক্তিই আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করবেন এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার থকে বঞ্চিত হবেন।

এখন দ্ব›দ্ব দেখা দিচ্ছে, শরীয়াহ অ্যাপিক্লেশান অ্যাক্ট ১৯৩৭ এবং ব্যাংকিং কোম্পানিজ আইন-১৯৯১ এই দুটি বিশেষ আইনের মধ্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে কোন আইনটি প্রযোজ্য হবে? সিনিয়র অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী এ প্রশ্নে বলেন, দু’টি বিশেষ আইনের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিলে সর্বশেষ আইনটি প্রাধান্য পাবে। পারিবারিক আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট সালমা আলীর মতে, দু’টিই যেহেতু বিশেষ আইন, সেক্ষেত্রে সর্বশেষ আইনটি প্রয়োগ করা হবে। প্রসঙ্গত ব্যাংকিং কোম্পানিজ আইন-১৯৯১, আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে। সেক্ষেত্রে এই আইনটিই প্রয়োগ করা হবে। সুতরাং এখনও পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা নমিনিই পাবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপিল বিভাগ ভিন্ন কোনো রায় না দেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ