পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দরকার শুধু সরকারী উদ্যোগ
মিজানুর রহমান তোতা : ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বিশ্বের কোথাও কখনো ব্রাউন সুগার (বাদামী চিনি) উৎপাদন সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র বাংলাদেশে উৎপাদন হতো এক সময়। বাংলার ব্রাউন সুগারের দারুণ কদর ও খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। যা ছিল অনন্যপ্রাপ্তি। মধুবৃক্ষ হিসেবে চিহ্নিত খেজুর গাছের রস ও গুড় দিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার চিনি উৎপাদন করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে বাংলায়। যেটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল বাণিজ্য। যা এখন শুধুই ইতিহাস। ভিন্ন স্বাদ ও স্মৃতিগন্ধবাহী অতীতকে নিয়ে বয়োবৃদ্ধরা আফসোস করেন। নতুন প্রজন্মের কাছে খেজুরের রস ও গুড় থেকে ব্রাউন সুগার উৎপাদনের কথা গল্পকাহিনী হয়ে গেছে। খেজুরের রস থেকে গুড় ও পাটালি তৈরীও চলছে নামকাওয়াস্তে। শিল্পটি মৃত্যুমুখে। সমস্যা ও সংকটের উৎস খুঁজে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া হলে এখনো খেজুরের গুড় শিল্পকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। একই সাথে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরবের ব্রাউন সুগার পুনরুদ্ধারও সম্ভব। কৃষি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রাউন সুগার উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগানোর বিষয়টি রয়েছে বরাবরই অনুপস্থিত। যদি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে সৃষ্টি হবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ হবে খেজুরের গুড় শিল্প। উন্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতির এক নতুন দ্বার।
কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রদীপ হামজা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, খেজুরের রস সংগ্রহে নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। গাছি সংকটে আগের মতো রস সংগ্রহ হয় না। এমন গাছি খুঁজে পাওয়া যাবে না যার কোমর ও হাঁটুর ব্যথা নেই। যার কারণে পেশাটিতে নতুন করে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কারো আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া কোমরে দড়ি বেঁধে লম্বা গাছে বাদুড়ের মতো ঝুলে রস সংগ্রহ করা পুরানো গাছিদের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্র জানায়, গবেষণা চলছে ছোট জাতের চারা উদ্ভাবনের। সূত্রমতে, আল্লাহপাকের নিয়ামক খেজুরগাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস সংগ্রহ পুরো শীত মৌসুমে খেজুরের রসে ভিজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে গ্রাম জনপদে। রস জ্বালিয়ে তৈরী হয় দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়। যার স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। গুড় ও পাটালি উৎপাদন অনেক কমে গেলেও গ্রামবাংলায় এখনো চালু আছে। একটু পৃষ্ঠপোষকতা দিলেই অনায়াসে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যাবে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া কৃষির এই খাতটিতে খরচ নেই বললেই চলে। অযতœ ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের জন্য বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না। কোন খরচ নেই অথচ পুরোটাই লাভ। ডালপালায় জ্বালানীর চাহিদা মিটানো, ভূমি ক্ষয়, আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধে অত্যন্ত ভূমিকা রাখে খেজুর গাছ। দেশের সড়ক পথ, রেল পথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ীর আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানোর সুযোগকে কোন সরকার পদক্ষেপ নেয়নি। যশোর গেজেটিয়ারের এক তথ্যে জানা যায়, ১৮৭৪ সালে চৌগাছা-কোটচাঁদপুরের কারখানাগুলো থেকেই ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪শ’ ৭৫ মণ বাদামী চিনি পাওয়া যেত। ১৯০১ সালের দিকে বাংলাদেশে মোট ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫শ’ ৫০ মণ চিনি উৎপাদিত হত। এরমধ্যে শুধু যশোরেই উৎপাদিত হত ১৭ লাখ ৯ হাজার ৬০ মণ বাদামী চিনি। সেজন্যই যশোরে বাদামী চিনি উৎপাদনে বিরাট সফলতা আসে তখন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের কপোতাক্ষ নদপাড়ে প্রথম খেজুরের গুড় থেকে বাদামী চিনি তৈরী করা হয়। পদ্ধতিটা এরকম যে, খেজুরের গুড় রাখা হতো মাটির ভাড় বা হাঁড়িতে। এরপর কপোতাক্ষ নদীতে জন্মানো এক ধরনের শৈবাল বা স্থানীয় ভাষায় ‘পাটা শেওলা’ দিয়ে মাটির ভাড় ঢেকে দেয়া হত। সপ্তাহ দুই পরে মাটির ভাড়ের ওই খেজুরের গুড় পরিণত হত বাদামী চিনিতে। প্রায় একই নিয়মে খেজুরের গুড় থেকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাদামী চিনি উৎপাদন করা হতো। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানো ছাড়াও বাদামী চিনি রফতানি হত বিদেশেও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ব্রাউন সুগার প্রচুর আমদানি করতো। তখন দেশে-বিদেশে ব্রাউন সুগারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে গড়ে ওঠে ব্রাউন সুগার উৎপাদনের বড় একটি কারখানা।
জানা যায়, ১৮৬১ সালে যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মিঃ নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন করে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হন। তাহেরপুর স্থানটি মিঃ নিউ হাউসের পছন্দ হবার কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধার জন্য। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সংযোগস্থল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণে সহজে যাতায়াত করা যেত। তখন কপোতাক্ষ নদ ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদ। তাহেরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর সেখানে বড় বাজারও গড়ে ওঠে। স্থাপিত হয় চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে এসে ভিড় করত দেশী-বিদেশী জাহাজ। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসাবে গড়ে ওঠে তাহেরপুর। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মিঃ নিউ হাউসের ব্রাউন সুগার কারখানাটি চলে। পরে তিনি কারখানাটি বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি ক্রয় করে ইংল্যান্ডের ‘এমেট এ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারাও নানা কারণে ১৮৮৪ সালে বিক্রি করে দেন বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহের কাছে। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্রসহ কয়েকজন মিলে কারখানাটি ক্রয় করে নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনি কারখানা’। নতুন ব্যবস্থাপনায় বৃটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় কারখানাটিতে। কিন্তু ১৯১৫ সালের দিকে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আর কোনদিন কারখানাটি উৎপাদনের মুখ দেখেনি। সেই থেকে কারখানার ধ্বংসাবশেষ ছিল। বছর পাঁচেক হলো যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে এক বিদেশী মহিলা ‘পানিগ্রাম রিসোর্ট’ করার উদ্যোগ নেন। তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। ৪৫ বিঘা জমির উপর নির্মিতব্য রিসোর্টটি আদৌ হবে কিনা যাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, যশোরের খালিশপুর, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, বোদখানা, ঝিকরগাছা, খাজুরা, রাজারহাট, রূপদিয়া, তালা, বসুন্দিয়া, ফুলতলা, কালীগঞ্জ, নোয়াপাড়া, নাভারণ, ইছাখাদা, কেশবপুর ও ত্রিমোহিনীসহ বিভিন্নস্থানে একরকম ঘরে ঘরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিনি কারখানা গড়ে ওঠে প্রাচীন পদ্ধতিতে। যশোর হয় ব্রাউন সুগারের মডেল। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্নস্থানে ব্রাউন সুগার তৈরীর উদ্দেশ্যে খেজুর গাছ লাগানোর ধুম পড়ে। কিন্তু তাহেরপুর কারখানা বন্ধ হওয়ার পর থেমে যায় কর্মকা-। সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খেজুর গাছ জন্মাত যশোরে। ব্রাউন সুগার উৎপাদনের কারাখানা তাহেরপুর যশোরের চৌগাছা উপজেলার একটি গ্রাম। চৌগাছা থেকে সোজা উত্তরে ১৬ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর শহর। এরই মাঝামাঝি হাকিমপুর (জাংগালিয়া) বাজার থেকে পশ্চিমে ২ কিলোমিটার গেলেই তাহেরপুর। বয়োবৃদ্ধদের কথা, ‘খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার বা বাদামী চিনি উৎপাদনের ব্যবস্থা করা গেলে আমাদের গৌরব আর ঐতিহ্য ফিরে পেতাম’। তবে গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র কারখানা যেখানে স্থানীয় পদ্ধতিতে রস জ্বালিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরী বহুকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সেটিও চলছে ধিকিধিকি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।