বাংলাদেশের রাষ্ট্রয়াত্ব কোম্পানি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)-এর কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে ঢাকাব্যাপি ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা সকল অফিসসমূহকে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে একটি অত্যাধুনিক টেলিকম টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। টেলিকম টাওয়ারের ডিজাইনসহ নির্মাণ কাজের তত্ববধায়নের জন্য একটি পরামর্শক নিয়োগ করতে আন্তর্জাতিক 'আগ্রহ পত্র' আহ্বান করা হয়। কিন্তু আগ্রহ পত্র জমা পড়ার পর নীতিমালা ভঙ্গকরে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে কোম্পানিগুলো অভিজ্ঞতা ও প্রোফাইল সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে তড়িঘড়িভাবে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, আগ্রহ পত্র জমা দেওয়া এক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলেন, গত সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে পত্রিকায় আগ্রহ পত্র আহ্বানের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। গত নভেম্বরের ১২ তারিখ জামদানের শেষ তারিখ ছিলো। এতে দেশ-বিদেশের ১৪টি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। পৃথিবীর অনেক দেশের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উক্ত কাজের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। বিটিসিএল, পিপিআর রুলস অনুযায়ী আগ্রহ পত্র মূল্যায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি যাচাই বাছাইয়ের পর সংক্ষিপ্ত তালিকা করেন। সংক্ষিপ্ত তালিকায় এমনসব কোম্পানিকে রাখা হয়েছে যাদের অভিজ্ঞতা ও প্রোফাইল সঠিকভাবে মূল্যায়ন করলে তালিকায় আসারই কথা নয়। পক্ষান্তরে এমন সব কোম্পানিকে বাদ দেওয়া হয়েছে যারা রুলস-এর সকল ধারায় উত্তীর্ণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও যোগ্য।
পিপিআর রুলস-এ ১১৫ ধারা অনুযায়ী যেসব বিষয় থাকতে হবে তা হলো- সংস্থার সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষতার ক্ষেত্রসমূহ নির্দেশপূর্বক দাখিলকৃত ব্রোশিয়ার, একই ধরনের সম্পাদিত কাজের বিবরণ, একই ধরনের কর্ম পরিবেশ ও পরিস্থিতে পরিচালিত কাজের অভিজ্ঞতা, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের জনবলের মধ্যে যথাযথ অভিজ্ঞতা পেশাগত যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল ও কার্য্ সম্পাদনের পর্যাপ্ত সম্পদের প্রাপ্যতা এবং আর্থিক সঙ্গতি এবং ব্যবস্থাপনাগত সামর্থ্য। ৩ উপবিধি (২) ধারা এর অধীনে মূল্যায়ন সম্পাদন করত; প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি আগ্রহ ব্যক্তকরণের অনুরোধ বর্ণিত শর্তাদি পূরণ করিয়াছে এবং প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনায় আলোচ্য কার্য্দি সম্পাদনের যোগ্যতা পূরণে যথাযথ ও পর্যাপ্ত সামর্থ্য প্রদর্শন করিয়াছে এইরূপ কমপক্ষে চারটি এবং সাতটির অধিক নহে এমন সংখ্যক আবেদনকারি সমন্বয়ে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করিবে এবং সুপারিশ সহকারে উহার প্রতিবেদন ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের নিকট অনুমোদনের জন্য পেশ করিবে। ১১৫ এর ৪ ধারা মতে দরপত্র আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে জারী হলে একক দেশ হতে অনধিক দুইটি এবং উন্নয়নশীল দেশ হতে ১টি সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হইতে হবে।
স্বভাবতই, উক্ত শর্তাবলী বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা ব্যাপক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত গতিতে কাজ করলেও অন্তত তিন মাস সময় লাগার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে গত ১৪/১২/২২ তারিখে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এক মাসের ২২ কর্ম দিবসে ১৫টি কোম্পানির কয়েক হাজার পৃষ্ঠার তথ্যাদি সঠিকভাবে যাচাই-বছাই করা অসম্ভব। সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট যে, তাদের পছন্দের নির্দিষ্ট কোম্পানীকে কাজ দিতে এইসব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সঠিকতা এবং যোগ্যতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
তাড়াহুড়ো করে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশের ফলে এইসব কাজের দক্ষ অনেক কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি। বিপরীতে অনেক কম দক্ষ কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান দেওয়া হয়, যা পিপিআর এর নীতি পরিপস্থি।
জানা যায়, প্রকল্প পরিচালক , ব্যবস্থাপনা পরিচালক যৌথ যোগসাজশে মূল্যায়নের কাজটি সহজ করার জন্য নামকাওয়াস্তে একটি মূল্যায়ন কমিটি করে দ্রুততম সময়ে এই তালিকা প্রনয়ন করেন। দ্রুততম সময়ে তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে কম দক্ষতাসম্পন্নগুলোকে এই তালিকায় স্থান দিয়েছেন। যারা এইসব কাজের জন্য পৃথিবীব্যাপি সুনাম কুড়িয়েছেন তাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক পুরষ্কৃত একটি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করলেও ,তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান দেননি।
কাউন্সিল অন টল বিল্ডিং এন্ড আরবান হেবিটেট-আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা। পৃথিবীর বড় ব্ড় কোম্পানি তাদের সম্পাদিত কার্য বিবরণী এই সংস্থায় লিপিবদ্ধ করেন । সংস্থাটি এইসব যাচাই বাছাই করে ক্যাটাগরি নির্ধারণ করেন। পৃথিবীব্যাপী কোম্পানীগুলোর সম্পাদিত কার্য সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এই সংস্থার সাহায্য নেয়া হয়। এই সংস্থার প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানীকেও বাদ দেওয়া হয়েছে।যারা এই সংস্থায় স্থান করে নিতে পারেনি এমন কোম্পানিকেও সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পিপিআর বিশেষজ্ঞ বলেন, বুদ্ধিভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতা হল আসল। মুল্যায়নের ক্ষেত্রে কারিগরী দক্ষতার মার্ক ৮০ আর আর্থিক মূল্যের মার্ক হল ২০। যে সকল কোম্পানী কারিগরী দক্ষতায় এগিয়ে স্বভাবত তাদেরকেই সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়।এই ক্ষেত্রে এই ধারার লংঘন হয়েছে কিনা যাচাই করা দরকার।
ফলে বিশেষ কোন একটি কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য এমন তাড়াহুড়ো করা হয়েছে বলে মনে করছেন এবং এতে দেশের প্রথম আইকনিক টাওয়ারের কাজের মান কেমন হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা । দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে আরো বেশি দক্ষতা সম্পন্ন কোম্পানি নিয়োগ জরুরি বলেও তারা মনে করেন। সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং গুণগত দিক থেকে উন্নত মানের টাওয়ার নির্মণের স্বার্থে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন কোম্পানিকে অন্তভূক্ত করা বিশেষ প্রয়োজন বলেও তারা মনে করেন।। এই ক্ষেত্রে ১১৫ (৭) ধারা মতে, কাজটি আরও দক্ষভাবে সংগঠিত করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দরপত্রটি পূনঃভাবে প্রকাশ করা জরুরী।