Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হুঙ্কার পাল্টা হুঙ্কার গণতন্ত্রে অশনি সঙ্কেত

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আন্দোলন পাহারা দেয়ার নামে পাল্টা রাজপথ দখল রাজনৈতিক অপকৌশল : পঙ্কজ ভট্টাচার্য
সংলাপের বদলে হুমকি-ধমকি পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে : অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যপারী
রাজনীতিতে চলছে এখন হুঙ্কার আর পাল্টা হুঙ্কার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নেতারা এখন হুঙ্কার ও পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে রাজনীতি গরম করছেন। বিভিন্ন সমাবেশ ও ঘরোয়া আলোচনায় দু’দলের নেতাদের এ বাকযুদ্ধ পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কামান ছুড়লে, প্রতিপক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়েন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা দুদলের নেতাদের এ বাকযুদ্ধ যেকোনো সময় সংঘাতের পথে যেতে পারে। আর এ অবস্থা স্বাভাবিক রাজনীতির জন্য শুভ নয় বরং এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত।

বিএনপি এরই মধ্যে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। সারাদেশে বিভাগীয় সমাবেশের পর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে উত্তাপের মধ্যে আওয়ামী লীগ রাজধানীর মোড়ে মোড়ে প্রহরা বসিয়েছে। বিএনপি কর্মসূচি দিলেই পাল্টা আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিচ্ছে। দু’ পক্ষই রাজপথ দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। এই রাজপথ দখল ও শোডাউন প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষও বেশ আগ্রহের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে। বিএনপির পক্ষে নেতা-কর্মীরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিনই একে অন্যের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছেন। ১১ জানুয়ারি বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো যুগপৎ কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় বিএনপির মহাসচিব বলেছেন আওয়ামী লীগ দেউলিয়া হয়ে গেছে। অন্যান্য নেতারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুঙ্কার দেন। এর আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এখন এক দফা, এক দাবি, এই সরকারের পদত্যাগ। এই সরকারের পতন ছাড়া আমরা ঘরে ফিরে যাবো না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি অশ্বডিম্ব পেরেছে। আন্দোলন মোকাবিলা করা হবে। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে উৎখাতের মতো কোনো শক্তি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে চলেছে। দুই দলের দায়িত্বশীল নেতাদের এমন হুঙ্কার পাল্টা হুঙ্কার নিয়ে রাজনীতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়তে পারে সংশয় প্রকাশ করছে।

জানতে চাইলে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, দুই দলের হুমকি-ধমকি এবং পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। বিরোধী দল আন্দোলন করবে এটা পুরনো ঐতিহ্য। কিন্তু সরকারি দল পাহারা দেয়ার নামে রাজপথে আন্দোলন করবে কেন? এটা রাজনীতির খেলা। এ খেলার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার কিছু কর্মী দিয়ে বিরোধী দলকে ঠেকাতে এসব করছে। জনহীন রাজনীতির এই খেলা জনগণ দেখছে। সরকারি দলের এই আন্দোলন পাহারা দেয়ার নামে পাল্টা রাজপথ দখল কিন্তু রাজনৈতিক অপকৌশল। বিরোধী দল আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক কর্মকাÐ ও জ্বালাও-পোড়াও করলে সেটা পুলিশ দেখবে। কিন্তু সরকারি দল ও পুলিশ বাহিনীকে একাকার করা হচ্ছে। রাজনীতি যেন হয়ে গেল দখলের যায়গা। বিরোধী দলের আন্দোলন পাহারা দেয়ার নামে রাজনীতিকে কোন যায়গায় নেয়া হচ্ছে! এটা অশুভ পরিণতির দিকে নেয়া হচ্ছে। বিএনপি যা করেছে সেটাও সুখকর নয়। তারা এখন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। মূল সমস্যা ভিন্ন। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। সংবিধানে বলা হয়েছে জনগণ ক্ষমতার মালিক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো সেটা হয়নি। নির্বাচনের নামে বিএনপি প্রহসন করেছে। সামরিক শাসকরাও সেটা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যন্ত্রের পরিণত করার চেষ্টা করছে। এতে দেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। যেভাবে ধারাবাহিকভাবে পাতানো নির্বাচনের চেষ্টা হচ্ছে তাতে করে এক সময় দেশের গণতন্ত্র ‘শহীদ’ হয়ে যাবে। এখন থেকে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে জাতীয় সমঝোতা দরকার। রাষ্ট্রীয় সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান যেন স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে। ভিন্ন মত থাকতে পারে কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে যেভাবে দেশের রাজনীতি চলছে, জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে কৌশলে বঞ্ছিত করা হচ্ছে; এভাবে চলতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরাজিত হবে। ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া, নেপাল, ভুটানের মতো দেশে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক হয় না। অথচ আমরা ৫০ বছরেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারলাম না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যপারী বলেন, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হুমকি-ধমকি শুরু হয়। বিএনপি জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা হুমকি দিচ্ছে। তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগকে লাঠি নিয়ে মাঠে প্রহরায় নামিয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত। রক্তপাত এড়াতে চাইলে এবং সংবিধান বহির্ভূত শাসন এড়াতে চাইলে আলোচনার মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। অতীতের ইতিহাস বলে আন্দোলন কখনো উপরে ওঠে কখনো নীচে নামে। এখন বিএনপির আন্দোলনে ব্যাপক জনসমাগম হওয়ায় দলটির পিছু হটার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিএনপি আন্দোলন বেগবান করতে ছোট ছোট ডান-বাম-মধ্যপন্থী দলগুলোকে যুগপৎ কর্মসুচিতে এনেছে। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভীত হয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশে অতীতের সবগুলো আন্দোলন গতি পেয়েছে পশ্চিমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। ৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বা ২০১৬ সালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সেটা দেখা গেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর দেশটি বৈশ্বিক রাজনীতির কৌশল পরিবর্তন করেছে। নিজের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরও উচ্চবাচ্য করেনি। পরবর্তীতে তারা দেখল বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম হয়েছে। এ জন্যই বাইডেন প্রশাসন আয়োজিত ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ এ বাংলাদেশকে আমন্ত্রন জানায়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই চায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক। কর্তৃত্ববাদী সরকারকে বার্তা দিতেই তারা ২০২১ সালে র‌্যাবের কয়েকজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে দেখা গেল এক বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ হয়নি। বরং সরকার নানাভাবে দেন-দরবার করছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকম্পা পেতে। ভারতকে কাজে লাগিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। বিষয়টি বিএনপি বুঝতে পেরে আন্দোলন বেগবান করছে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পথে হাটা। সরকার সে পথে না গিয়ে উল্টো হুমকি-ধমকি দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। এটা ঠিক বিএনপি বুঝে গেছে আন্দোলনে থাকলে সফলতা অনিবার্য। বিদেশের অনেক রাষ্ট্রদূত নির্বাচন নিয়ে যে সব বক্তব্য দিয়েছে তাতে পরিষ্কার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো তৎপর। সরকার ইচ্ছা করলেও তাদের অগ্রহ্য করতে পারবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা নির্ভরশীল। আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি নির্ধারকদের বোঝা উচিত যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘বৈশ্বিক মৌলবাদ’ থিওরি বদলে ফেলেছে। এবং দিল্লির চোখে বাংলাদেশকে দেখছে না। ফলে সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নির্বাচনের পথে হাটা। হুমকি-ধমকি সমস্যার সমাধান দেবে না বরং সমস্যাকে গভীর খাদে ফেলে দেবে।

 

 

 



 

Show all comments
  • Nazrul Islam ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২০ এএম says : 0
    ফ্যাসিবাদের পায়ের নীচে মাটি নেই। ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগে সন্ত্রাসের শেষ ছোবল এটা। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে জাতি ঐক্যবদ্ধ আজ। এটা মেনে নিতেই হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Pavel Pannu ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২১ এএম says : 0
    এ রক্ত বৃথা যাবে না, ইনশাআল্লাহ্ জনগণের বিজয় খুব সন্নিকটে। আশা করি, গণতন্ত্রমনা সরকার বিরোধী সকল দলকে নিয়ে মাঠে নামুন। কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ১৪ বছর অনেক হয়েছে আর সময় ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। বর্তমান অবৈধ, স্বৈরাচারী সরকারের কাছে দেশ, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত্ব, জনগণের ন্যায্য অধিকার, ইসলাম, মুসলমান, আইনের শাসন, জননিরাপত্তা, দেশের অর্থ-সম্পদ কোন কিছুই নিরাপদ নয়। এদের দেশ ও জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই। সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকুন। মানবিক দিক বিবেচনায় এ সরকার ক্ষমতা ছাড়বে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Muzahid Khan ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২১ এএম says : 0
    জালিম শাসকদের পতন হবে ইনশাআল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • Chowdhury Abad ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২২ এএম says : 0
    রক্ত কখনও ঘুমায় না, প্রতিশোধের নেশায় জেগে থাকে, প্রতিটি আঘাতের প্রতিঘাত হবে ক্ষমাহীন, চরম নির্মম দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেওয়া হবে; ইনশাআল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • শওকত আকবর ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:৪১ এএম says : 0
    এরশাদ হটাও আন্দলন তুংগে।মাত্র ১৩জন মিছিল নিয়ে খুলনা প্রেস ক্লাবে দিকে যাচ্ছি।মিছিলকারির চেয়ে পুলিশ বেশি।সেদিন আর এ দিন ???গনতন্ত্র???স্বৈরতন্ত্র??? ইতিহাস !!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ