Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেড়েছে পানির, বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম

| প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ বেপারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী রানু বেগম বলেন, ‘গত তিন-চার বছর ধরে আমরা ভোর রাতে চুলায় গ্যাস পাই। সারাদিন গ্যাস থাকে না। এলপি গ্যাস অথবা স্টোভের চুলায় রান্না করে খেতে হচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের বিল মাসে মাসে পরিশোধ করছি। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি আমাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। অন্য এক গৃহিণী বলেন, ‘গ্যাস না পাওয়ায় রাইস কুকার ও কেরোসিনের স্টোভ ব্যবহার করে রান্না করতে হয়। এতে গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল ও তেল কিনতে হয়। তার উপর এখন গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি আমাদের বাঁচার আর উপায় নাই। আগে সবসময় গ্যাস পাওয়া নিশ্চিত করুন তারপর গ্যাসের দাম বাড়ান, আমরা মাইনা নিমু’। এভাবে সারা বছরই তীব্র গ্যাস সংকটের অভিযোগ রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায়। এসব সংকট দূর করার ব্যাপারে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি। তারা বলেছেন, সমাধানের চেষ্টা করছেন। ফলে সাধারণ গ্রাহকদের এই সংকটের মধ্যে বাড়তি শুভ(!) সংবাদ হতে চলেছে মূল্যবৃদ্ধি।
দাম বাড়ানোর প্রধান কারণ, গ্যাসের দামের ওপর থেকে সরকারের শুল্ক ও কর সংগ্রহের সিদ্ধান্ত এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্প্রতি বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এস এম শামসুল আলম বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য বাড়তি যে অর্থ সংস্থাগুলোর প্রয়োজন, তার সংস্থান তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়েই করা সম্ভব। গ্যাস খাতের প্রতিটি কোম্পানির হাতে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে, যা এ খাতের উন্নয়নের কোনো কাজে লাগছে না। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই’।
ক্ষুব্ধ এক বেসরকারি কর্মচারী বলেন, ‘সরকারি চাকুরীদের বেতন বৃদ্ধির টাকা আমাদের হালাল রুজি থেকে দিতে হবে; এদের বেতন বৃদ্ধি পাইছে কারণ এরা সোনার ছেলে, অনেক যোগ্য তাই সরকারি চাকরী করে। সরকারী চাকুরেদের মত আমাদেরও একটি পেট রয়েছে, পরিবার, ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা আছে। এর উপরে এদের ঘুষের টাকাটাও এখন বাড়তির দিকে, সেই বাড়তি ঘুষের টাকাটাও আমাদেরই দিতে হবে। কিন্তু, সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না! তারপরেও গ্যাস কোম্পানীর জমিদার সাহেবদের দুর্নীতি কি তাতে বন্ধ হবে’?
সচেতন মহলের অভিমত, জ্বালানি খাতে লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ না করে শুধু মূল্য বৃদ্ধি কাম্য নয়। গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে প্রিপেইড মিটার লাগালে অপচয় যেমন বন্ধ হতো তেমনি আয়ও বাড়তো বহুগুণ। তাই সবার আগে গ্যাস অপচয় বন্ধ ও গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চোরালাইনের চোরাকারবারী বন্ধ করতে হবে। বাইং হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বছর না ঘুরতেই বাড়ি ওয়ালাদের মত যাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল বাড়ানোর জন্য অস্থিরতা বেড়ে যায় এদের ১% ও নিজের পকেট থেকে বিল দেয় কিনা সন্দেহ আছে। যারা বেসরকারী চাকুরী করি তারা জানি বছর শেষে কতটাকা বেতন বাড়ে, তার উপর থাকে বাড়তি বাড়ি ভাড়ার বোঝা। যাদের বেতন ডাবল করা হয়েছে তাদের জন্য সাধারণ জনগণের উপর অতিরিক্ত বিলের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনভাবে কাম্য নয়। পারলে অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করুন এতে সরকার লাভবান হবে’।
ঢাকার, গোপিবাগের এক মুদি ব্যবসায়ী বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গ্রাহক, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মতামত নিতে গণশুনানির ব্যবস্থা যেমন আছে তেমনি গণশুনানি দরকার জনগণের আয়-ব্যায়ের উপর’।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুল হক বলেন, যেকোনো দিন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আগামী মাস থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে রেখেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। জুলাই মাসে একবার বাড়ানোর পর গত মাসেও বেড়েছে পানির দাম। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও চলছে। একসঙ্গে জীবনযাত্রার এত উপকরণের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনে চরম ভোগান্তি নেমে আসবে বলে মনে করছেন নাগরিকরা। বিশেষ করে রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে লাগামহীন। এর আগে গত বছরের (২০১৫ সাল) ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবাসিকসহ কয়েকটি শ্রেণির গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তখন ২ চুলার বিল ৪৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ এবং ১ চুলার বিল ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছিল।
বিইআরসির সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল, গ্যাসের দাম গড়ে ৯০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর। কিন্তু গণশুনানির সময় তা কমিয়ে ৬৫ শতাংশ বাড়ানোর সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবের ওপর শুনানিতে অনেক বিষয় উঠে আসে, যাতে ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোরও যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়নি। কাজেই ওই প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ছে না। তখন আবাসিকে ২ চুলার জন্য মাসিক বিল ১ হাজার ২০০ টাকা, ১ চুলার জন্য ১ হাজার ১০০ টাকা, আবাসিকে মিটারযুক্ত গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারের বর্তমান দাম ৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৫৩ পয়সা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ৩২ শতাংশ, সারে প্রায় ৩৬ শতাংশ, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, শিল্পে প্রায় ৫৬ শতাংশ, বাণিজ্যে ৬৭ শতাংশ, চা-বাগানে ৬৮ শতাংশ ও সিএনজিতে ৪৮ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়।
শুধু আবাসিক এবং সিএনজি খাতেই নয়, সব শ্রেণির গ্রাহকের গ্যাসের দামই বাড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিইআরসি। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক, চা বাগানসহ ক্যাপটিভ খাতে ব্যবহৃত গ্যাস। বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুল হক গণমাধ্যমকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিইআরসির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির আয়োজন করা হবে। এ বছরের শুরুর দিকেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ (পিডিবি) এ খাতের সব সংস্থা বিইআরসির কাছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
ইতোপূর্বে তেলের দাম কমলেও ভাড়া কমায়নি পরিবহন মালিকরা। সিএনজি পাম্পে গ্যাসের দাম বাড়ালে তার প্রভাব পরিবহন খাতেও পরবে। যাত্রী এবং মালামাল পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। এরপর সরকার বলবে যেহেতু বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস এ চলে। তাই বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হোক।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এস এম শামসুল আলম বলেন, ১৯৯৮ সালে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্যাস বিক্রির অর্থ থেকে ৫৫ শতাংশ রাজস্ব (৪০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ মূসক) না নিয়ে গ্যাস খাত পরিচালনায় তা ব্যয় করার বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে এসআরও (২২৭ নম্বর) জারি করেছিল, এখন তার অন্যথা করা জনস্বার্থের অনুকূল নয়। তিনি আরো বলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। জনগণের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা না থাকলেই সরকার যা খুশি তা করতে পারে। শামসুল আলম বলেন, গণশুনানিকালে প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো দরকার নেই। তারপরও বাড়ানো হচ্ছে। সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, আমরা দীর্ঘদিন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছি গ্যাসের দাম না বাড়াতে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে নৈরাজ্য তৈরি হবে।
রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট, শহরের প্রান্ত এলাকায় পানি সরবরাহে সমস্যার মধ্যে ঢাকা ওয়াসা এই অবস্থায় পাঁচ মাসের ব্যবধানে দুবার বাড়িয়েছে পানির দাম। ওয়াসা নাগরিকদের পানির সংকট পুরোপুরি মিটাতে পারছে না। সাধারণত ওয়াসার পানির দাম বছরে একবার ৫ শতাংশ হারে বাড়ে। কিন্তু এবার দুই দফায় আবাসিক ও শিল্প-বাণিজ্যিক খাতে পর্যায়ক্রমে ১৭ ও ১৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। দুই দফায় বাড়ানোর কারণে মোট দাম বাড়ল আবাসিকে ২২ শতাংশ এবং শিল্প ও বাণিজ্যিকে ১৮ শতাংশ। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির ব্যবস্থা থাকলেও ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা না থাকার কারণে ওয়াসা ইচ্ছামতো পানির দাম বাড়িয়ে থাকে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন