Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীতে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া থানার পাশেই প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছিনতাই

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম


শুধু অজ্ঞান ও মলম পার্টি নয়, ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র, মোটরসাইকেল, কার ও মাইক্রোবাস
স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে আবারো বেপরোয়া হয়ে পড়ছে ছিনতাইকারী চক্র। চক্রগুলো সম্প্রতি ছিনতাই কাজে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও শুরু করেছে। শুধু অজ্ঞান বা মলম পার্টি নয়, এখন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মোটরসাইকেল, কার ও মাইক্রোবাসেও ছিনতাইকারী চক্র ব্যাপক তৎপর রয়েছে।  তিন ধরনের ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রগুলো। টার্গেট করে ব্যাগ ও মোটরসাইকেল ছিনতাই এবং ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তির পিছু নিয়ে নগদ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। সম্প্রতি খোদ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও উঠেছে ছিনতাইয়ের অভিযোগ। ভূক্তভোগীরা বলছেন, সব চেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলোÑ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থানা সংলগ্ন এলাকার নির্জন ও অন্ধকার স্থানগুলো ছিনতাই পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোটরসাইকেলযোগে সুযোগ মতো রিকশাযাত্রীদের ব্যাগ টান দেয়া এবং গুলি চালিয়ে বা অস্ত্রের মুখে ছিনতাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নূর মোহাম্মদ ইয়া আমিন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অফিসের কাজ শেষে রাত ১১টার দিকে মিরপুর থেকে বনানীর দিকে যাওয়ার জন্য রিকমা ঠিক করছিলেন। কিন্তু রিকশা ঠিক হলেও রিকশায় উঠার আগ মুহূর্তেই বিধি বাম। একটি মোটরসাইকেলে দুইজন লোক এসে নূর মোহাম্মদের ব্যগটি নিয়ে যায়। এরপর মামলা করার জন্য থানায় গেলে সেখানেও অসহযোগিতা করা হয়। মামলা করতে চাইলেও নেয়া হয় জিডি।
নূর মোহাম্মদ বলেন, মামলা করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ তাকে জিডি করতে বলেছে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে ছিনতাইয়ের কোনো পরিসংখ্যা নেই। তবে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে গড়ে প্রতি মাসে কমপক্ষে ২৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হাসপাতালে ২৬২ জন ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ দিনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৮৭টি জিডি হয়েছে রাজধানীর ৪৯টি থানায়, যার বেশির ভাগই থানার আশপাশের রাস্তায় মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিনতাইয়ের অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ছিনতাইকারীদের ধরতে পারছে না পুলিশ। থানায় অভিযোগ করেও খোয়া যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়া যায় না।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা, বাড্ডা, বনানী, খিলক্ষেত, ভাষানটেক, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, দারুস সালাম, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, গুলিস্তান, রামপুরা, হাজারিবাগসহ মহানগরীর থানা এলাকায় ৭৫টি পয়েন্টে ছিনতাই হচ্ছে। মোটরসাইকেলে, মাইক্রোবাসে ও অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ছিনতাই করছে।
হঠাৎ করেই রাজধানীতে বেড়ে গেছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো স্থানে ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই বাড়ছে ছিনতাই।
তবে অভিযোগ মানতে নারাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বলছেন, ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তাই তাদের দৌরত্ম কমেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনে শতাধিক ছিনতাইয়ের স্পট আর এসব জায়গায় সক্রিয় রয়েছে ১৭টি ছিনতাইকারী চক্র। এদের মধ্যে মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে খলিফা, আরমান, আকতার, মনির ও বাবু গ্রুপ।
মেরুল বাড্ডা, রামপুরা সোহেল ও ফরমান গ্রুপ, মহাখালী, গুলশান নাসির, বাচ্চু, সেন্টু, মনির, ইমু, আরিফ ও সাগর গ্রুপ। পান্থপথ, ফার্মগেট পর্যন্ত শহিদুল, রজব গ্রুপ, মতিঝিল ও ওয়ারী এলাকায় মকবুল গ্রুপ। মৌচাক, হাতিরঝিল, শান্তিনগর, কাকরাইল নিয়ন্ত্রণ সুলতান গ্রুপ। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ঠা-ু গ্রুপ। রাজারবাগ, কমলাপুর নিয়ন্ত্রণ করে জাকির গ্রুপ। ধানমন্ডি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে আকতার গ্রুপ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান, ছিনতাইকারীদের ধরলেও খুব সহজেই জামিন পেয়ে বের হয়ে আসে তারা। এ কারণেই সহজে ঠেকানে যাচ্ছে না ছিনতাই তৎপরতা।
উপ-কমিশনার, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, এদের ধরলেও জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজ শুরু করে। ছিনতাই জিডি হওয়ার কথা না। এ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তারা। তবে ছিনতাই প্রতিরোধে বাড়ানো হয়েছে পুলিশের তৎপরতা বলেও জানান পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারীচক্র। হঠাৎ করে বেড়েছে ছিনতাই। চলতি মাসে ২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবর্ষণ ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লুটে নিচ্ছে নগদ টাকা।  বড় দিন ও থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে রাজধানীর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হলেও ছিনতাইকারী চক্রকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে ছিনতাইকারীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার এবং ছিনতাইকৃত টাকা উদ্ধার করতে পারছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুই মাস আগে ছিনতাই প্রতিরোধে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশকে বিশেষ অভিযান চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ ৮-১০টি চিহ্নিত ছিনতাই চক্রের ৩৫ থেকে ৪০ সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন থানা পুলিশও বেশ কিছু ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এ কারণে গত দুই মাস ধরে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেকাংশে কমে যায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে ২০টি দস্যুতা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। জানুয়ারিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে ১৯টি, মার্চ মাসে ২২টি, এপ্রিল মাসে ২১টি, মে মাসে ৩৭টি, জুন মাসে ২৬টি, জুলাই মাসে ৩২টি, আগস্ট মাসে ৩৫টি, সেপ্টেম্বর মাসে ২৭টি, অক্টোবর মাসে ৩০টি, নভেম্বর মাসে ৩৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী। তবে বাস্তবে এ সংখ্যার আরো কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু চলতি মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে পুলিশ স্বীকার করে বলেন, এই দুই মাসে অনেক ছিনতাইকারী জামিনে ছাড়া পেয়েছে বলে জানা গেছে। এখন তাদের ধরতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর আইডিবি ভবনের সামনের রাস্তায় প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেলে করে ব্যাগ টান দেয়ার ঘটনা ঘটে। রোকেয়া স্মরণি, কাফরুল থানা থেকে সেনানিবাসের দিকের রাস্তা, মিরপুর থানার উল্টোদিকের রাস্তা, মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তা, মোহম্মদপুর থানার পেছনের রাস্তা, পল্টন থানার উল্টোদিকের রাস্তা, ফার্মগেট, তেজগাঁও থানার উল্টোপাশের রাস্তা, কাওরানবাজার থেকে ফার্মগেটের দিকে যেতে দ্বিতীয় ওভারব্রিজ থেকে তৃতীয় ওভারব্রিজ, আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে তালতলার রাস্তায় নিয়মিত ছিনতাই  হচ্ছে।
থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কের ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে নিখোঁজ হন দৃক পিকচার লাইব্রেরির প্রশাসনিক ও হিসাব কর্মকর্তা ইরফানুল ইসলাম। পরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের জালকুঁড়ি এলাকা থেকে ইরফানুলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশরাফ উদ্দিন জানান, আমাদের ধারণা,  ব্যাংকের সামনে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারী চক্রের কোনো দল ইরফানকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
চলতি বছরের ৪ মে যাত্রাবাড়ীর মিরহাজীরবাগ এলাকায় দু’টি মোটরসাইকেলযোগে চার থেকে পাঁচজন ছিনতাইকারী জামাল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো: জামালের (৪৫) পায়ে গুলি করে চার লাখ ২০ হাজার টাকা ছিনতাই করে। তিনি স্থানীয় ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাচ্ছিলেন। অপর দিকে গত ৯ মে দুপুরে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ওমর ফারুক সড়কে আবুল হোসেনের (৩৫) ডান পায়ে গুলি করে ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। তিনি স্থানীয় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী।
এই বিষয়ে জাকিরুল ইসলাম নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ছিনতাইয়ের পর থানায় গিয়েও সহায়তা মেলে না। হারিয়ে গেছে, খোয়া গেছেÑ সাধারণ জিডি করে চলে আসতে হয়। ওই জিডির আর কখনো আপডেট মেলে না। অফিসিয়াল কাগজ, টাকা বা ল্যাপটপ খোয়া গেলে জিডি করে ফেরত পাওয়ার খবর কখনো পাইনি।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ডিএমপির গত মাসের অপরাধবিষয়ক মাসিক সভায় ছিনতাইকারীদের ধরতে জোর নির্দেশনা দিয়েছেন কমিশনার। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ