Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গভবনে আলোচনা : আগামীদিনের রাজনীতি

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবু সাবিত সাদিক : রাজধানী ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনকে ঘিরে প্রচার-প্রচারণা বেশ জমে উঠেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণে এ নির্বাচনী হাওয়া নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে সারা দেশে উত্তাপ ছড়িয়েছে। আগামী ২২ ডিসেম্বর ভোটের দিনটিকে ঘিরে নৌকা-ধানের শীষের পক্ষে মাঠে নামছেন জাতীয় নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মীর্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে দলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে বলেছেন, এ নির্বাচনের উপর দেশের আগামীদিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভির পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে বলছেন, এ নির্বাচন হবে সরকারের জনপ্রিয়তা যাছাইয়ের নির্বাচন। বলাবাহুল্য, নাসিক নির্বাচনকে ঘিরেই দেশের আগামীদিনের রাজনীতি আবর্তিত হবে। এ নির্বাচনকে বলা যায় ভবিষ্যৎ রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট।
বর্তমান ইসি কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের জন্য এটি শেষ নির্বাচন। যদিও একই সময়ে দেশে আরও একটি নির্বাচন হচ্ছে। জেলা পরিষদের ওই নির্বাচন আগেই এক দলীয় বা একতরফা নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত এরশাদের জাতীয় পার্টিও তাতে কোন প্রার্থী দেয়ার গরজবোধ করেনি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৩ জন বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বাকি জেলাগুলোতে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। ফলে জেলা পরিষদের ওই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ নেই।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আগাগোড়া বিতর্কিত ভূমিকা- বিশেষ করে বিগত ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের নামে ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও বিএনপি নাসিক নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। আর এই কারণেই ওই নির্বাচনকে ঘিরে দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
এটি এই কমিশনের শেষ নির্বাচন। তারা কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেটাও দেখতে চাইছে বিএনপি। আবার সরকারের ভূমিকা এখানে কেমন হয় তাও দেখবে তারা। এরমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এই লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় করার উদ্যোগ নিয়েছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর বিএনপিকে বঙ্গভবনে ডাকা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আগেই এ বিষয়ে তার তের দফা প্রস্তাবনা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি কমিশন গঠন করতে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রস্তাবনাও পেশ করেছেন।
বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে এবং সংসদের একটি অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার। সংবিধান তাকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের পর পর বিএনপির তরফে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনকে ঘিরে দেশে একটি সংলাপের আবহ তৈরি হয়েছে।
বিগত জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পরের বছর টানা আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে বিএনপি সরকারের কাছে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য একটি কার্যকর সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছে। আর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী নেতারা তাদের সে প্রস্তাব বিনা পত্রপাঠে প্রত্যাখান করে আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের অভিভাবক মহামান্য প্রেসিডেন্টের এই সংলাপ আয়োজনে রাজনীতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
তবে এর আগেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম জিল্লুর রহমান সকল রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিও অংশ নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি সার্স কমিটির মাধ্যমে বর্তমান কমিশন গঠন করা হয়। সার্স কমিটির মাধ্যমে গঠিত কমিশনের ভূমিকা জাতির সামনে পরিষ্কার।
তাদের অধীনে বিগত ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভোট ছাড়াই সরকার গঠন করার মতো ১৫৩ জন বিজয়ী হয়েছে। অনেক প্রার্থীকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, আবার অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও তার মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রামের তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। ইউনিয়ন ও পৌরসভা নির্বাচনে একের পর এক লাশ পড়েছে। সর্বশেষ দফায় দফায় অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে অসংখ্য মানুষ লাশ হওয়ার পরও ইসি বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এ কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা এখন শূন্যের কোটায়। বিভিন্ন সময় সরকারি দলের মন্ত্রী নেতারাও কমিশনের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারাবাহিকতা শুরু হয়। এ ধারাবাহিকতা ২০০৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। নির্দলীয় সরকারের বিধান বাতিল হওয়ার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসনে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যত ’৯০ পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যায়। বর্তমান কমিশনের ভূমিকায় ভোটের প্রতি আগ্রহ হারায় ভোটাররা।
এমন অভিজ্ঞতার পরও বিএনপি প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে সংলাপের জন্য বার বার আহ্বান জানিয়ে আসছে। প্রেসিডেন্ট সে সংলাপের আয়োজনও করেছেন।
কয়েকদিন পর নাসিক নির্বাচনে ভোট গ্রহণ। ফলে আগামী কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ সব পক্ষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত নাসিক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের কোন অভিযোগ বিএনপি করেনি। নির্বাচন কমিশন জাবেদ আলীর উপস্থিতিতে মেয়র প্রার্থীর মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন কমিশনারও তাদের সর্তক করেছেন। তবে সে মতবিনিময় সভায় জাবেদ আলী ভোটের ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, এ নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করতে যা যা করা দরকার কমিশন তা সবটাই করবে। তিনি বলেন, এটি হবে ঐতিহাসিক নির্বাচন।
অন্যদিকে, ইসি রকিবউদ্দীন ভোটের সময় সেনা মোতায়েন প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সোনাবাহিনীকে নামানোর দাবি জানিয়ে আসা হচ্ছিল শুরু থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের পর ইসি তার এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে মিডিয়ায় খবর এসেছে ভোটের দিন সেনা মোতায়েন না হলেও ভোট কেন্দ্র দখলের মতো কোন ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।  
প্রেসিডেন্টের সাথে বিএনপির সংলাপের পরে নাসিকের ভোট গ্রহণ হতে যাচ্ছে। ফলে ওইদিন পর্যন্ত কমিশনের ভূমিকার একটি চিত্র বিএনপি প্রেসিডেন্টের নজরে আনার চেষ্টা করবে।
অতীতে সংলাপ হয়েছে সে সংলাপ ব্যর্থও হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য সংলাপের কোন বিকল্প নেই। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ সংলাপ হলেও তা এগিয়ে নিতে হবে। আসন্ন সংলাপে প্রেসিডেন্ট বিরোধী দলগুলোর প্রস্তাব কতটুকু গ্রহণ করেন, কিংবা সংলাপের পরে কি হয়, কারা আসেন নির্বাচন কমিশনে তা দেখার জন্য সচেতন সব শ্রেণিপেশার মানুষ ফিঙ্গার ক্রস করে অপেক্ষা করছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন