Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

আমদানি হ্রাসে কমছে রাজস্ব

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ডলার সঙ্কটের প্রভাব কল-কারখানায় উৎপাদনে ধস বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ৩:৩৫ এএম

পণ্য আমদানি ক্রমাগত কমছে। তাতে রাজস্ব আহরণেও ভাটা পড়েছে। দেশে অব্যাহত ডলার সঙ্কটে আমদানিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাবে রফতানিও কমে গেছে। রফতানি আদেশ না থাকায় পোশাক কারখানাসহ রফতানিমুখী কল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মালিকেরা। ইতোমধ্যে কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। কোথায় আবার মাসের পর মাস বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত ডলার সঙ্কটের অবসান না হলে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এ অবস্থায় এলসি খুলতে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সহায়তার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে সার্বিক শিল্পোৎপাদন সেই সাথে রফতানি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকোচিত হয়ে পড়ছে। তবে সঙ্কটকালে অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন পণ্যের আমদানি কমে যাওয়া ইতিবাচক হিসাবে দেখা হচ্ছে। কারণ অব্যাহত ডলার সঙ্কট মেটাতে সরকারি পর্যায়ে আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ দ্রুত কমছে।

চলতি বছরের এপ্রিল থেকে দেশে ডলারের সঙ্কট শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা প্রকট হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার সঙ্কট প্রকট হওয়ায় আমদানি নিয়ন্ত্রণে ৩০ লাখ ডলারের বেশি এলসি বা ঋণপত্র খোলার বিষয়ে তদারকিও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার হার কমে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক আমদানিতে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে গত নভেম্বর মাসে পণ্য আমদানি ৮ শতাংশ কম হয়েছে। এ মাসে এক কোটি ১৭ লাখ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এতে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৭১০ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয় এক কোটি ২৭ লাখ টন পণ্য। তখন আমদানি ব্যয় হয়েছিলো ৭৬৪ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে পণ্য আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেনি। তবে আমদানিতে প্রবৃদ্ধির হার কমে আসছে। গত পাঁচ মাসে পাঁচ কোটি ৬৫ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় পাঁচ কোটি ৩১ লাখ টন।

সার্বিকভাবে আমদানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার। আগের অর্থ বছরে এ ব্যয় ছিল তিন হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। আগের তুলনায় গত পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। সিমেন্ট ও রড শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও কমেছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো জাহাজ আমদানি। বস্ত্র খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানিও বেড়েছে। বিলাসপণ্যের মধ্যে গাড়ি ও ফলের আমদানি কমেছে। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে গম, চিনি ও ডালের আমদানি কমেছে। তবে সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি বেড়েছে। আমদানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, ভোজ্যতেলসহ খাদ্যপণের দাম কমছে। কিছু কিছু পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এর ফলে আগামীতে দেশে সার্বিক আমাদানিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

অপরদিকে আমদানি কমার সাথে দেশে সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আহরণেও ভাটা পড়েছে। রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত কমছে। এতে টার্গেটের তুলনায় ঘাটতির আকারও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের গতকাল পর্যন্ত ২৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। টার্গেটের তুলনায় ঘাটতির আকার দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

তবে গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় তিন হাজার ১৯১ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ১৩.২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে এই হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। আমদানি কমে যাওয়ায় দ্রুতই কমছে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে ৭৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। রাজস্ব আদায় কমে গেলে সরকারের ব্যয় নির্বাহে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের হার বাড়ে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেলে বিয়োগ কমে আসে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সার্বিক উন্নয়ন ও বিনিয়োগে। ডলারের অভাবে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় এবং জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগে এমনিতেই স্থবিরতা বিরাজ করছে।

বৈশ্বিক মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তৈরী পোশাক খাত। রফতানি আদেশ কমে গেছে। আবার উৎপাদিত পণ্যের রফতানি অর্ডার স্থগিত করছে অনেক ক্রেতা। তাতে কারখানায় উৎপাদনের চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারখানা মালিকেরা বলছেন, আগের তুলনায় উৎপাদন কার্যক্রম অর্ধেকের নীচে নেমে এসেছে। কাজ না থাকায় ওভার টাইম বন্ধ, শুক্রবার শনিবারও কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেক কারখানায় ছাঁটাই চলছে। এরমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সঙ্কট কেটে যাবে- এমন আশায় অনেক কারখানা মালিক দায় দেনা করে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক কারখানায় বেতন বকেয়া পড়েছে। তাতে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ