Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খুলনায় জনতা ব্যাংকের সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি

এসবিএসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ব্যাংকের অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কা

ডিএম রেজা, খুলনা থেকে | প্রকাশের সময় : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

খুলনায় জনতা ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বিপুল অঙ্কের এ ঋণ নেয়া হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা আদায় করতে না পেরে গত ৩০ নভেম্বর মামলার আশ্রয় নিয়েছে। ঋণের বিপরীতে যে জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়েছে, তার পরিমাণ মাত্র কয়েক কোটি টাকা। ব্যাংকের অভ্যন্তরে একটি চক্র এ ঋণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলে জানা গেছে। গত বছর দুদক ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে এসএম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করার পরপর তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান।

এসএম আমজাদ হোসেন লকপুর গ্রুপের মালিক। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের তিন মেয়াদে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকের থেকে হাতিয়ে নেয়। করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল থেকেও শ্রমিকদের বেতনের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত করেন। তবে, এস এম আমজাদ হোসেন রাজধানীর কোনো শাখায় এসব অনিয়ম না করে বেছে নেন এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা ও বাগেরহাটের কাটাখালী শাখাকে। এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ২০১৮ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি ৯ ব্যক্তির নামে ২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৫ কোটি টাকা আমানত দেখানো হয়। এসএম আমজাদ হোসেনের নিজের ছয় প্রতিষ্ঠান ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত রফতানির বিপরীতে ৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর এক রিপোর্ট বলছে, তিনি পণ্যের রফতানি মূল্য বেশি দেখিয়ে প্রণোদনা নিয়েছেন। এ জন্য অডিট অধিদফতর ২৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ফেরত দিতে বলেছে। তার মালিকানাধীন আলফা অ্যাকসেসরিজের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ এখন ১৬৮ কোটি টাকা।

লকপুর গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মোংলা ইপিজেড এ অবস্থিত ইষ্টার্ণ পলিমার লিমিটেড খুলনার জনতা ব্যাংকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস হতে হিসাব খুলে বিদেশ হতে পন্য আমদানি করত। এই আমদানির জন্য এলসি মার্জিন ঋণ সহ বিভিন্ন প্রকার ঋণ মিলে ৩১ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত পাওনা মোট ১৫১ কোটি ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৬১৬ টাকা। এই টাকার বিপরীতে খুলনার রূপসার জাবুসা মৌজায় মোট নয় একর জলাভূমি বন্ধক দেখানো আছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৯ লাখ টাকা। মুনস্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড ২০১৭ সাল জনতা ব্যাংক দিলকুশা শাখা হতে প্রথম ঋণ গ্রহণ করে। যা পরবর্তীতে খুলনা কর্পোরেট শাখায় স্থানান্তর করা হয়। মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩১ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত মোট পাওনা ৯০ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মাত্র কয়েক কোটি টাকার জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি খুলনার জনতা ব্যাংকের সাথে ২০১৪ সাল হতে হিসাব পরিচালনা করে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটি বাগেরহাট জেলা ফকিরহাট থানার নওয়াপাড়া শ্যামবাগান এলাকায় অবস্থিত। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ৯৫ কোটি ৪৭ লক্ষ ২৯ হাজার ৭৫৩ টাকা। জনতা ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখা এ তিনটি ঋণের ঘটনায় খেলাপি ও আত্মাসাতের অভিযোগ এনে গত ৩০ নভেম্বর এসএম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ এর বিরুদ্ধে ৩৩৮ কোটি টাকা দাবি করে মামলা করেছে। খুলনা কর্পোরেট শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এই তিনটি মামলার বাদি। অর্থঋণ আদালত, খুলনায় দাখিল করা পৃথক এই তিনটি মামলা আদালত নথিভুক্ত করেছে। জনতা ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখা সূত্র জানিয়েছে, ৩৩৮ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খুলনা রূপসায় ৮ দশমিক ১৪ একর, বটিয়াঘাটা থানা এলাকার জিরোপয়েন্টে ৯ দশমিক ২৮ একর জলাভূমি এবং বাগেরহাটের ফকিরহাটে ৩ দশমিক ৩৩ একর জমি বন্ধক দেয়া হয়েছে। স্থানীয় ভূমি অফিস এবং সাব রেজিস্টার অফিস সরকারী দর অনুযায়ী এই সব জমির মূল্য সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার অধিক হবে না। অর্থাৎ ৩৫/৪০ কোটি টাকার সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন তিনি।
প্রধান কার্যালয় হতে দেয়া ঋণ মঞ্জুরীর অতিরিক্ত টাকা এই প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় বলে ইতিপূর্বে প্রধান কার্যালয়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটি ২০২১ সালের ২৩ আগষ্ট জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখাকে ১০ টি বিষয় অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারী করেন। জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম সহ তিনজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মঞ্জুরীর অতিরিক্ত প্রায় ৫২ কোটি টাকা জামানত ছাড়াই অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা দেবার জন্য কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থ্ ানেয়া হবে না, তা জানতে শো-কজ এবং বিভাগীয় মামলা দায়ের করেছে। ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ডিসিপ্লিনারী ডিপার্টমেন্ট এই একই ভাবে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস ছালাম আজাদের পক্ষে উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম ফজলুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম অরুন প্রকাশ বিশ্বাস, এজিএম কাজী জাফর হায়দার এবং সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুল হাইকে জবাব দানের জন্য দশ দিনের সময় বেধে দেয়া হয়। মোট দশটি অভিযোগের প্রথমেই বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ব্যতিরেকে মুনস্টার পলিমারকে অতিরিক্ত ২৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। একই ভাবে এই ঋণ প্রদানকালে প্রথম বছরে কমিশন অগ্রিম আদায়ের শর্ত পালন করা হয়নি। আরেক অভিযোগে বলা হয়েছে, ইষ্টার্ণ পলিমার লিঃ কে মঞ্জুরীকৃত ৬০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ২১ কোটি ৫২ লাখ ওভারডিউ সুবিধা প্রদান করেছেন। একইভাবে ঋণ প্রদানের নানাবিধ শর্ত মানা হয়নি। অন্য অভিযোগে বলা হয়েছে, ইষ্টার্ণ পলিমার লিঃ ঋণসীমার বিপরীতে প্রতিমাসে এক কোটি টাকার এফডিআর গঠন করে লিয়েন রাখার শর্ত পালন করা হয়নি এবং বিবিধ অনিয়ম করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জনতা ব্যাংক খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার অরুন প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, এই জমি ছাড়াও ফ্যাক্টরী যন্ত্রাংশ, উৎপাদিত পণ্যের প্লেজ ঋণ, এলসি মার্জিন ঋণসহ নানাবিধ ঋণ রয়েছে। যা সুদে আসলে এত টাকা হয়েছে। তিনি জানান, জমির মূল্য আগামীতে বৃদ্ধি পেতে পারে। তিনি জানান, এই ঋণ তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। একই ভাবে এলসি মার্জিনের টাকা ১৮০ দিনের মধ্যে দেবার কথা থাকলেও তারা কোন টাকা দেয়নি। তিনি জানান, ব্যাংক ঋণের বিধি অনুযায়ী তারা এই মামলা দায়ের করেছেন। তিনি নিজে জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখার ডিজিএম থাকাকালে তার বিরুদ্ধেও শোকজ করা হয়েছিল। কিন্তু তার জবাব ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে।

এদিকে, এসএম আমজাদ হোসেন আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট দুদককে কারণ দর্শাতে বলেছিল। এ বছর ১৭ জানুয়ারী দুদক এসএম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে এসএম আমজাদ হোসেনের নামে বেনামে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউদার্ন ফুডস ইনক ও কলকাতার রূপসা ফিশ লিমিটেডের মালিকানায় তিনি রয়েছেন। তাই বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি বিদেশে পাচার করে থাকতে পারেন যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এ পর্যন্ত তার সমস্ত অনিয়ম চাপা পড়েছিল কারণ তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ