Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ন্যূনতম উদ্যোগ নেই বরিশাল সিটি করপোরেশন ও পাউবোর

কীর্তনখোলায় নাব্যতা উন্নয়নের নামে নদী ভরাট

বরিশাল ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নাব্যতা উন্নয়নের নামে কির্তনখোলায় খননকৃত পলি নদীতেই অপসারণে ফলে তলদেশ ভরাটে বরিশাল মহানগরীর ভঙ্গুর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় মাঝারি বর্ষণেই গোটা মহানগরী পানির তলায় চলে যাচ্ছে। মারাত্মক জলাবদ্ধতায় এ মহানগরীতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে বার বার। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ’র বিবেকহীন এ কর্মকাণ্ড নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ নেই।
এমনকি প্রতি বছরই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দরের নাব্যতা উন্নয়নের নামে কির্তনখোলা থেকে কম-বেশি ১ লাখ ঘন মিটার পলি অপসারণ করে তা নদীতেই ফেলায় বন্দরের ভাটি এলাকায় তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বন্দরের ভাটিতে খালগুলো মোহনায় দেড় থেকে ২ মিটার পর্যন্ত পলি জমে নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে রুদ্ধ করছে। গত দেড় দশক ধরে বরিশাল বন্দরের পলি অপসারণ করে কির্তনখোলা নদীতেই ফেলা হলেও বিষয়টি নিয়ে নির্বাক নগর ভবন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। ইতোমধ্যে এ বন্দরে নাব্যতা উন্নয়নে ১ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণে ড্রেজিং শুরু করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং পরিদফতরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জানান, বরিশাল বন্দরের নাব্যতা উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু কিনারায় পলি অপসারণের কোনো জায়গা নেই বিধায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথেই ভাটার সময় নদীতে ফেলতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বনের কথাও জানান তিনি।

বরিশাল মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে মানুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে পরিত্রান জরুরি হলেও নগরীর ৭টি খাল খননে সরকারি বরাদ্দের ১০ কোটি টাকাও ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন¦য়ের অভাবে নগরীর ৭টি খাল খনন প্রকল্পই বাতিল হবার পথে। প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় ৩০টি খালের উপর নির্ভরশীল হলেও পাকা ড্রেন নির্মাণের লক্ষে তার বেশকিছু সংকুচিত হয়েছে। অনেক খালের অস্তিত্বও প্রায় বিলীন। অবশিষ্টগুলোও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মৃত প্রায়। বর্তমান ও সাবেক নগর পরিষদ নগরীর খাল সমূহ সংস্কারসহ উন্নয়নে কয়েক দফায় প্রকল্প-সাড়পত্র জমা দিলেও পরিকল্পনা কমিশন থেকে এখনো সবুজ সংকেত মেলেনি।

এ অবস্থয়ই পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে নগরীর ১০টি খাল সংস্কারসহ তার উন্নয়নে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের পরে বোর্ডের বরিশাল ও অ্যান্ড এম ডিভিশন থেকে দর প্রস্তাব গ্রহণ ও ঠিকাদার বাছাইসহ ব্যাংক গ্যারান্টিও গ্রহণ করা হয়েছে আরো প্রায় ৭ মাস আগে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এসব খাল খনন ও উন্নয়নে অনেক আগেই পরিকল্পনা কমিশনে ডিপিপি দাখিল করার কথা জানিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নগর ভবনের আপত্তির কথা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করেছে।

ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিষয়টি সদর দফতরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এমনকি ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদও দু’দফায় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো কার্যাদেশ দেয়া হয়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে ‘নগর ভবন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অঘোষিত এ দন্ধের মধ্যে না জড়ানোর কথা’ বলেছেন। ফলে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল মহানগরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭টি খাল খননের ভবিষ্যত এখন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বর শেষ হতে চললেও কাজ শুরুরই সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে বরিশাল মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে ১০ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার কোনো বিকল্প দেখছেন না তারা।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল জোনের প্রধান প্রকৌশলী জানান, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি ৭টি খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, নগরীর ২৪টি খাল খননে নগর ভবন থেকে একটি প্রকল্প-প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের ইতিবাচক বিবেচনায় রয়েছে। সেখানে অন্য কোনো সংস্থা তা করতে গেলে সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এ ভর করে মাত্র ১২ ঘণ্টায় প্রায় ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে বরিশাল মহানগরীর ৯০ ভাগ এলাকাই সয়লাব হবার মধ্যে দিয়ে ভঙ্গুর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরো একবার প্রত্যক্ষ করেছে নগরবাসী। এমনকি ঐ বৃষ্টির পানির কারণে অনেকটা মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়তে হয়েছে এ নগরবাসীকে। বস্তিবাসীদের দুর্ভোগ ছিল সব বর্ণনার বাইরে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ হোটেলসহ কিছুটা নিরাপদ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পর্যন্ত আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

নগরীর প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ড্রেনের ভঙ্গুর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে অনেক আগে থেকেই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাঝারি বৃষ্টিতেই নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানির তলায় চলে যাচ্ছে। সেখানে সিত্রাং-এ ভর করে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত গোটা নগরীকে আরেক দফা ডুবিয়ে দিলেও তা থেকে পরিত্রানের পথ এখন রুদ্ধ। এমনকি সিত্রাং-এর দুর্যোগের পরে নগরীর অনেক বাড়িতে ২-৩ দিন চুলা জ্বলেনি। পাঁচ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত অনেক ঘরের শৌচাগারগুলো পর্যন্ত ব্যবহার অনুপযোগী ছিল।

নগর ভবন থেকে অবশ্য পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে অনেক চেষ্টা করা হলেও দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সরিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়ন সহজসাধ্য ছিল না। ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে এ নগরী সম্পূর্ণ প্লাবন মুক্ত করতে ৫ দিন চলে যায়।
এ নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে গত কয়েক বছরে নগর ভবন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারলেও ২৪টি খাল খননে প্রায় ২২শ’ কোটি টাকার উচ্চ বিলাসী একটি প্রকল্পÑপ্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়েছে। তবে এ নগরীর অন্যসব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মতো তাতেও সরকারের সবুজ সংকেত মেলেনি।

অন্যদিকে নগর ভবনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের জনবলের কিছুটা ঘাটতির পাশাপাশি কর্মরতদের কাজের প্রতি আন্তরিকতার অভাবেরও অভিযোগ রয়েছে। অনেক পরিচ্ছন্নকর্মী নগর ভবনের দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন বিবেচনায় চাকরি পাওয়া এসব পরিচ্ছন্নকর্মীর অনেকই ওয়ার্ডের সুপারভাইজারদের নির্দেশনা পালনেও অনীহা প্রকাশ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নগরীর সরকারি হাতেম আলী কলেজের লেকটির পয়োনিষ্কাশন নবগ্রাম রোড ও রাজকুমার ঘোষ রোডের সংযোগ স্থলে মাত্র ৬৫ ফুট দৈর্ঘ ড্রেনটি নিয়মিত পরিষ্কার না করায় একটু ভারি বর্ষণেও লেকটির পানি উপচে আশেপাশের এলাকা সয়লাব করে দিচ্ছে। এমকি নগর ভবনের কতিপয় কর্মীর উদাশীনতা, অবহেলা আর নগরবাসীর প্রতি প্রজাসুলভ আচরণে অন্য অনেক কিছুর মতো এ নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও জনকল্যাণে আসছে না বলেও অভিযোগ সাধারণ মানুষের।

এ নগরীর সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিক সমাজসহ নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা সংগঠন নেতৃবন্দ নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা বললেও হতাশা আর ক্ষোভ প্রকাশ্যে বলতেও চাচ্ছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তেই এসব নেতৃবৃন্দ মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নাগরিক সুবিধা সমূহ নিশ্চিত করতে যা কিছু প্রয়োজন সেদিকে মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ