Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেড়েই চলছে ঢাকার বায়ুদূষণ

২২৬ স্কোর নিয়ে গতকাল বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতীরা ডব্লিউএইচও-এর মতে, বায়ুদূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ ম

স্টাফ রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

রাজধানী ঢাকার বাতাস এখন চরম অস্বাস্থ্যকর। প্রতিদিনই দূষণের মাত্রা বাড়ছে। গতকাল সকালে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এ (একিউআই) ২২৬ পিপিএম নিয়ে ১৮৬টি দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। দূষণের শীর্ষে ভারতের রাজধানী দিল্লি এবং তৃতীয় স্থানে আছে চীনের রাজধানী বেইজিং। বিকালে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমে ১৯৬ পিপিএমে দাঁড়ায়। এ মাত্রার দূষণও অস্বাস্থ্যকর। স্কোর-১০১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘খারাপ’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০ এর স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে। বর্ষাকালে বাতাসের মান কিছুটা উন্নতি হলেও শীতকালে বাতাসের গুণ-মান অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে। শীত আসার সাথে সাথে নির্মাণ কাজ, রাস্তাঘাট, ইটভাটা এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষক কণা ব্যাপকভাবে নিঃসরণের কারণে শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। এবার শীত আসতে না আসতেই ঢাকার বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে। তবে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নীরব।
করোনা মহামারিকালে ঢাকার বায়ুরমান ছিল স্বাভাবিক। এরপর ২০২১ সালে আবার ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ জানুয়ারিতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৬৯ নিয়ে ঢাকা আবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে আসে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা তখন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন।
বায়ুদূষণকে পরিবেশবাদীরা মানুষের নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বায়ুদূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী মৃত্যু এবং বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়ার ফলে মানুষের হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ যেমন- স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের ‘এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৯ সালে রাজধানীতে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পলিউশন অ্যান্ড হেলথ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়।
মূলত চার কারণে রাজধানীর বাতাস দূষিত হচ্ছে। এ গুলো হচ্ছে, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন কাজ, পুরনো যানবাহনের আধিক্য, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প কলকারখানার দূষণ এবং শহরের ভেতরে যে ময়লা-আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া। সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক ও কঠোর না হওয়ায় এই পরিস্থিতির কোনোও পরিবর্তন ঘটছে না। বরং বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি। পরিবেশবিদরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে। অথচ ঢাকার ভয়াবহ বায়ুদূষণ রোধে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। দূষণের সব থেকে বড় উৎস ঢাকার বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের কাজ। শহরের মধ্যে উন্নয়ন কাজের ফলে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণেও সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না দুই সিটি কর্পোরেশন। পরিবেশ অধিদফতর এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। এই বায়ুদূষণ রোধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করলেও তা মানা হচ্ছে না। বালু ও মাটি ভর্তি ট্রাক দিনের বেলা চলাচল করতে নিষেধ করা হলেও তা দিব্যি দিনেই চলাচল করছে। এসব ট্রাক চলাচলের সময় ছালা বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় বালু বা মাটি ভর্তি উন্মুক্ত ট্রাকই চলাচল করতে দেখা যায়। যে সব স্থানে রাস্তা মেরামতের কাজ হচ্ছে সেখানে প্রতিদিন সকাল-বিকাল রাস্তায় পানি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও সিটি কর্পোরেশন বা পরিবেশ অধিদফতর কেউ এ দায়িত্ব পালন করছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, ঢাকায় উন্নয়নমূলক কাজই বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। আমরা বায়ু মান পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি বাতাসে ডাস্ট পার্টিক্যাল সবচেয়ে বেশি। এটা শীতকালে বেশি হয়। বর্ষাকালে কমে কারণ তখন বৃষ্টি হয়। ঢাকা শহরে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ ছাড়াও সড়ক এবং অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে উন্মুক্ত অবস্থায়। যা ধুলিকণা ব্যাপকভাবে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আর গাছপালা কম। আমাদের এইসব স্থাপনার কাজ উন্নত বিশ্বের মতো ঢেকে করতে হবে। আর প্রচুর গাছপালা লাগালে ধুলিকণা উড়তে পাববেনা।
চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সর্দি, কাশি, জ্বর, ব্রঙ্কাইটিস হয়। এগুলো স্বল্পস্থায়ী রোগ। যাদের অ্যাজমা আছে, তাদের সমস্যা বাড়ে। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনিতে জটিলতা বাড়তে পারে। অন্তঃসত্ত্বা বায়ুদূষণের শিকার হলে গর্ভের সন্তানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এর ফলে বাচ্চা আকারে ছোট হতে পারে, ওজন কম হতে পারে, মানসিক ও স্নায়ুগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। অটিস্টিক বাচ্চা জন্ম হওয়ার একটি কারণ বায়ুদূষণ। আর শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সচয়েচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সভাপতি ড. আব্দুল মতিন ইনকিলাবকে বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণের শহরের মধ্যে ঢাকা প্রায়ই শীর্ষ স্থানে উঠে আসছে। ঢাকার বাতাস এখন অস্বাস্থ্যকর। এতে নগরবাসীর স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে। অথচ এই বায়ুদূষণ রোধে সরকার আন্তরিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর এ ব্যাপারে পুরোপুরি ব্যর্থ। উচ্চ আদালতের নির্দেশও উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বায়ুদূষণ হচ্ছে। সেসব দেশ বায়ুদূষণ রোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু আমরা সে তুলনায় কিছুই করছি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ