পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ইংরেজিতে ‘কোড অব ইথিক্স’ বাংলায় ‘নৈতিকতার মানদ-’ বলে একটা কথা আছে। আমরা কী রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবার এবং যাপিত জীবন থেকে তা ক্রমান্বয়ে মুঁছে ফেলছি? দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে ৩ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়’। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক নিয়োগের ‘এই হাল’ হলে সরকারি চাকরি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে নিয়োগে ‘ঘুষ বাণিজ্য’ কী পরিমাণ হয় তা সহজেই অনুমেয়। ঘুষ আগেও ছিল। তবে তা হতো আড়ালে-আবডালে। লোকলজ্জায় রাখঢাক করে, গোপনে এবং টেবিলের নিচ দিয়ে লেনদেন হতো। এখন ঘুষ বাণিজ্য ওপেন সিক্রেট। এখন বিয়ের বাজারে বরের যোগ্যতা নির্ভর করে চাকরির ‘উপরি’র ওপর। ’৯০ এর দশকেও ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা যেত ‘পিস্তলের নল ঠেকিয়ে টাকা আদায় এবং ফাইল ঠেকিয়ে টাকা আদায় একই অপরাধ’। সেই ‘চিকা’ এখন আর চোখে পড়ে না। এখন স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষের জন্য নিলামের মতোই ‘প্রকাশ্যে ডাক’ তোলা হয়। মেধা যোগ্যতার বদলে যে বেশি টাকা দেয় তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। গ্রাম-শহর একই চিত্র। পরিস্থিতি এমন যে স্কুলের পিয়ন-রাতের পাহারাদার-বাগানের মালি নিয়োগেও ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়। আগে পর্দার আড়ালে হাত ঘুরিয়ে নেয়া হতো এখন কর্তা ব্যক্তিত্বরাই সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করেন। ছেলে-মেয়ে স্ত্রীরাও পরিবারের কর্তার ঘুষের খবর জানেন। কেউ কেউ আবার ঘুষের নাম দিয়েছেন ‘স্পিরিট মানি’। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে শিশুরাও শিক্ষা জীবনের প্রথম দিনই ঘুষের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত ঘুষ নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ঘুষ বাণিজ্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করায় নৈতিকতা-মানবিকতা-মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ‘ঘুষ বাণিজ্য’কে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। ঘুষের ভয়াবহতা এমন যে নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ উঠে গেছে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম রংপুরে। তার নামে রংপুরে প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। দু’মাস আগে রংপুর গেলাম। ব্যাটারী চালিত ইজি বাইকে উঠেছি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রী সহযাত্রী। তাদের দেখে সহযাত্রী এক মহিলা আত্মতুষ্টির সুরে বললেন, শেষ পর্যন্ত রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। সহযাত্রী দুই ছাত্রী বিনয়ের সুরে বলে উঠলেন, ‘আপা গর্বের কিছু নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষক তাদের শতকরা ১০ জনও ক্লাসে পড়াতে পারেন না। যাদের কলেজে পড়ানোর যোগ্যতা নেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দুই ছাত্রীর দেয়া তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ‘ঘুষের এলাহিকা-’ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. অধ্যাপক আবদুল জলিল প্রধান প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী-মালি-পিয়ন-দারোয়ান পদে প্রায় সাড়ে তিনশ’ পদে নিয়োগে তিনশ’ পদেই পীরগঞ্জ উপজেলার লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। এ নিয়োগে হয়েছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। যা বর্তমানে দুদকের তদন্তধীন। এই যদি হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তাহলে স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্যের হালচাল কেমন?
নীতি নৈতিকতা উঠে গেলে সমাজ আর সমাজ থাকে না। নীতিশাস্ত্র এমন এক বিদ্যা যা মানুষের জীবন গঠনে, আচরণের মঙ্গল-অমঙ্গল, ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত সবকিছুতেই নির্ভর করে। নীতি-নৈতিকতা হলো মানুষের আচরণের ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের বিচার করা। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের আচরণের নৈতিকতার দিকটির যথাযথ মূল্যায়ন করা নীতিশাস্ত্রের প্রধান লক্ষ্য। নৈতিক মানদ-ের আলোকে মানুষের আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ধারণ হয়। মানুষ সামাজিক জীব। নাগরিক তথা ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে; তেমনি সমাজেরও চাহিদা আছে। সমাজ মানুষ থেকে সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশিত আচরণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একান্তই কাম্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। সেই আদিযুগ থেকেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠছে আধুনিক। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে দেশের সমগ্র সমাজব্যবস্থা। দেশে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম দুর্ভিক্ষ চলছে। মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে যুব সমাজ। স্বপ্নের জীবন হয়ে উঠছে যন্ত্রণাময়। মূলত মানুষের বয়স ও জীবন থেমে থাকে না। সময়ের সঙ্গে বয়স ও চাহিদা বাড়ে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রহর গুণছে। প্রত্যাশিত কর্মক্ষেত্র না পাওয়ায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে তরুণ-তরুণীরা। সৎপথে আয়-রোজগারের মাধ্যমে চলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিপদে পা বাড়াচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্র অপ্রতুল। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে না। উল্টো মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে বেকারত্বের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে সেটাও পেতে তরুণ-তরুণীদের মুখোমুখি হতে হয় ঘুষ বাণিজ্যে। ঘুষের অর্থের জোগান দিতে যারা পারেন তারা চাকরি নামের সোনার হরিণের সন্ধান পান; যাদের সংগতি নেই তারা বেকারত্বের যন্ত্রণায় কাঁতরান। বাংলাদেশ নামক জগৎ সংসারে আমাদের রাজনীতিকরা বেখেয়াল। মানুষের ভালমন্দ প্রত্যাশা-প্রান্তির চেয়ে নেতা-নেত্রীরা নিজেদের ও দলের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে বেশি উদগ্রীব। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এই ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা এতো উদগ্রীব যে সমাজের নীতি নৈতিকতার দিতে তাকানোর ফুসরত নেই। বরং নিজ দলের লোকজন, কর্মী সমর্থকদের সর্বময় খুশি রাখতে এবং তাদের পকেট ভরাতে অনৈতিক ‘ঘুষ বাণিজ্য’কে নৈতিকতার (!) কাতারে নিয়ে এসেছে। অথচ নেতানেত্রীরাই রাষ্ট্র ও সমাজে সুখ-সমৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক। ৪৫ বছর আগে যারা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে সেই শান্তিপ্রিয় মানুষের ভোটের অধিকারের পাশাপাশি কাম্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংহতি। বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে তখন নেতানেত্রীদের জন্যই আমাদের পরিবার-সমাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চিন্তা-চেতনায় চরম অস্থিরতা। ‘চেতনার’ স্বপক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কে সমাজের পরতে পরতে বিভাজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে ঘুষ বাণিজ্য এবং অনৈতিকতায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস উঠে গেছে শূন্যের কোঠায়। ’৭১ সালে যেটা ছিল দেশপ্রেম এখন সেটা হয়ে গেছে পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব। চেতনা মানেই যেন লুটেপুটে খাই। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু জনসম্পৃক্ততা নেই। নির্বাচন আছে ভোাটারের সংশ্রব নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে ‘জনতা’ নেই। রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিরতা এমন পর্যায়ে গেছে যে মানুষের মধ্যে প্রাণ আছে কিন্তু মন নেই। আবেগ অনুভূতি নিরুদ্দেশ। হাসতে ভুলে গেছে মানুষ।
সমাজ বিজ্ঞানী জনাথন হ্যাইটের মতে ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানবআচরণ থেকে নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে। মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারকারী আদর্শ। সামাজিকভাবে বাস করতে গিয়ে মানুষ কতগুলো আদর্শ সাধারণভাবে গ্রহণ করে নেয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিত, যা কিছু মঙ্গলজনক মনে করে তার আদর্শ রূপই হচ্ছে মূল্যবোধ। দেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সামাজিক উন্নয়ন প্রয়োজন। আর সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন সামাজিক স্থিতিশীলতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ সাধন। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপাদান হলো সততা, কর্তব্য, ধৈর্য, শিষ্টাচার, উদারতা, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ, জবাবদিহিতা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি মানবীয় গুণের চর্চা। সেগুলো উঠে গিয়ে অনৈতিকার দুর্নীতি-ঘুষ যেন সমাজে মহাপ্রত্যাপে যায়গা করে নিচ্ছে। আমরা সবাই মিলে সামাজিক মূল্যবোধ-নৈতিকতার যেন মৃত্যুদ- দিয়েছি। বিশ্বদরবারে গৌরবের জাতির কেন এমন হলো? আমাদের বুদ্ধিজীবী, সুশীল, সমাজবিজ্ঞানী কী এনিয়ে গবেষণা করবেন? যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি অথচ অনৈতিকতার মহাসড়কে যেভাবে দৌড়াচ্ছি তা থামানো না গেলে জাতি হিসেবে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।