Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সোনাই নদী ভরাট : হুমকির মুখে রাবার ড্যাম প্রকল্প

| প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ এফ এম ফারুক-চান মিয়া: সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা এক সময়ের খরস্রোতা সোনাই নদীতে খুব জোরেশোরেই প্রতিনিয়ত চলছে টিলার পাথর উত্তোলনের পর অপসারিত মাটি ফেলে নদী ভরাটের মহোৎসব। মাটি ভরাটের ফলে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে কৃষি জমির সেচ সুবিধার জন্য নির্মিত বিএডিসির রাবার ড্যাম প্রকল্প’ প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়েছে।’ ভোক্তভোগীদের অভিযোগ শাহ আরেফিন টিলাকাঁটার পাথর খেকো চক্র’র টাকার বান্ডিল পরিবেশ ও আইন রক্ষার দায়িত্বে যারা রয়েছেন সেইসব কর্তাব্যাক্তিদের টেবিলে টেবিলে পৌঁছে যাচ্ছে যে কারণে দায়িত্বশীলরা নদী ভরাট ও টিলা কাটা বন্ধে কোন ধরনের আইন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।’
সরজমিনে গিয়ে সম্প্রতি স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ’সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের কযেক শত একরের শাহ আরেফিন টিলা অবৈধভাবে স্থানীয় কয়েকটি প্রভাবশালী পাথর খেকো চক্র প্রশাসনের নাকের ডগায় জবর দখল করে গত ১০ বছর ধরে প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড় কোটি টাকার পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করছে।’
টিলা কেটে পাথর উত্তোলনের পর টিলার অপসারিত লালমাটি গত তিন বছর ধরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত সোনাই নদীর পূর্ব তীরে ও নদীর মাঝ খানে দিবারাত্রী প্রায় তিন শতাধিক মাহেন্দ্র ট্রলি ও ট্রাকে করে নদীতে ফেলে নদী তীর ও তলদেশ ভরাট করা হচ্ছে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে এলাকার বোরো আমন ধান উৎপাদন ও শীতকালীন সবজি উৎপাদন ব্যাহত করা হলেও সিলেট ও সুনামগঞ্জ এ দু’জেলার প্রশাসন এমনকি সিলেটের পরিবেশ অধিদপ্তরেরও ঘুম ভাঙ্গেনি গত প্রায় তিন বছর ধরে।’
সুনামগঞ্জের ছাতকের ইসলামপুরের নোয়াকোট রতনপুরসহ সাত গ্রামের লোকজন শনিবার এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে নদী ভরাটের কারণে তাদের কৃষি ও আর্থসামাজিক নদীর নব্যতা সংকটসহ নানা ভোগান্তির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে বাইরং নদীর জিরো পয়েন্ট থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমানার ১২৪৫-১২৪৬ সীমানা পিলারের মাঝখান দিয়ে প্রায় ১৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে সোনাই নদী ছাতকের সুরমা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে।’ পাকিস্তান আমলে ওপারের বাইরং ও শিলং এমনকি মেঘালয় স্টেইটকে ঘিরে ভারত থেকে সোনাই নদীর নৌপথ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বোল্টার, কয়লা-চুনাপাথর, কমলা, তেজপাতা আমদানি হত। দেশ স্বাধীনের পরও বেশ কয়েক বছর সচল ছিল ছাতকের এ নৌপথ কেন্দ্রীক শুল্ক স্টেশন।’  সময়ের ব্যবধানে নদী ভরাট ও নাব্যতা সংকটের মুখে গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়ে যায় সোনাই নদী পথে আমদানিকার্যক্রম। টিলার অপসারিত লাল মাটি ফেলে নদীর তীর ও তলদেশ ভরাটের কারণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার তিন দফা সোনাই নদী ড্রেজিং করেও নাব্যতা ফেরাতে পারেনি সোনাই নদীর। সুনামগঞ্জ বিএডিসি সেচ সুবিধা দিতে গিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রাবার ড্যাম তৈরী করলেও লালমাটির আগ্রাসনে নদী ভরাটের কারণে বোরো-আমন ও শীতকালীন সবজী মৌসুমের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে ছাতকের ইসলামপুরের সোনাই নদীর পশ্চিম তীরের বাগানবাড়ি, রতনপুর, নীজগাঁও, গাঙপাড়, নোয়াকোট, বাহাদুরপুর, বৈশাকান্দি গ্রামের প্রায় দু’হাজার প্রান্তিক ও নিম্নআয়ের কৃষক পরিবার।’ নদী ভরাটের তা-বের কারণে সামান্য বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সাত গ্রামের লোকজনের কৃষি জমি বোরো ফসল গোলায় তোলার আগেই আগাম বন্যায় রতনপুর, বাগানবাড়ি, নোয়াকোট, নীজগাঁও নতুন বস্তি, বনগাঁও, গাঙপাড় নোয়াকোট বন্দ (হাওর) সহ সাত হাওরের প্রায় কয়েক হাজার একর বোরো, ফসলী ধান তলিয়ে যাবার পাশাপাশী প্রায় ১ হাজার ঘরবাড়িতে টানা সপ্তাহ থেকে পনেরো দিন পর্যন্ত পানিবদ্ধতা লেগে থাকে।
ছাতকের রতন পুরের প্রবীণ মুরুব্বী আবদুল মন্নান (৭৫) শামসুল হক (৫৫) আবদুল জলিল (৬২), বাগানবাড়ির আশিক আলী (৫৮), গাঙপাড় নোয়াকোট নুরুল ইসলাম (৫৯), মখলিছুর রহমান ৩৮), শফিকুর রহমান (৫০) অভিযোগ করে বলেন, এ নদীর পশ্চিম তীরের সাত গ্রামের পক্ষ থেকে নদী পূর্ব তীরের দামবাড়ি রাখাল তলা, ছনবাড়ি, নতুন জালিয়ার পাড়, বাহাদুর পুর, বৈশাকান্দি ও সূর্যখাল পর্যন্ত শাহ আরেফিন টিলার অপসারিত লালমাটি ট্রাকে করে নদীর তীর ও তলদেশ ভরাটের ফলে বোরো আবাদের মাঘ-পৌষেই পানি যেমন থাকে না তেমনী ধান কাটার মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যায় গত তিন বছর ধরে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন ধান তলিয়ে যায়। শুধু এখানেই শেষ নয় পাহাড়ি ঢলে নদীর কোল উপছে ঘরবাড়িতে ঢলের পানির সাথে বালি ও লালমাটি হাওরে প্রবেশ করে জমির উর্বরতা বিনষ্ট করছে, মরে যাচ্ছে গ্রামের গাছপালা, ভাঙছে নদীর পশ্চিম তীরবর্তী ঘরবাড়ি। গত তিন বছরে নদীর পশ্চিম তীরের সাত গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক বসতবাড়ি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বালির স্তূপের কারণে বারবার বসতবাড়ির ভিটে উঁচু করতে হচ্ছে সেই সাথে সরাতে হচ্ছে বসতবাড়ি।’
গাঙপাড় নোয়াকোটের রহিম উল্লাহ জানান, এক সময় সোনাই নদীতে দেশীয় প্রজাতির রুই, কই, গনিয়া, কালিবাউশ, সরপুটি, বোয়াল কাতলা, বাইমসহ ছোট ছোট একাধিক জাতের মাছ পাওয়া যেত, সাত গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকরা সারা বছর প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার। কিন্তু এই খরস্রোতা সোনাই নদী ভরাটের ফলে মাছ তো দূরের কথা পানি লালচে হয়ে যাওয়ায় গ্রামের লোকজন গোসল, কাপড় চোপড় পরিষ্কার করতে পারে না তাহলে মাছ থাকবে কেমন করে?
অভিযোগ রয়েছে সিলেটের কোম্পনীগঞ্জের ইসলামপুরের শাহ আরেফিন টিলার পাথর খেকো দানবদের সাথে আঁতাত করে ছনবাড়ির মৃত জহুর আলীর ছেলে আবদুর নুরের নেতৃত্বে রাস্তায় চেয়ার টেবিল বসিয়ে আইয়ুব আলীর ছেলে ইসমাইল তার সহোদর আবদুল লতিফ ওরফে বিরাই, আবদুল গফুরের ছেলে লালু মিয়া, মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আবদুল হান্নান গং আরো সংঘবদ্ধ হয়ে নদীর তীর ও নদীর তলদেশে লালমাটি ফেলে ভরাটের জন্য প্রতি ট্রাক থেকে ১শ’ টাকা করে গড়ে প্রতিদিন ৩শ’ ট্রাক থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে।
তাদের নির্দেশে ট্রাক চালকরা ওপারের ভারতীয় বিএসএফ এবং এপারের বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড বিজিবির বাঁধাও মানতে নারাজ। প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে লালমাটি বাহি ট্রাক নিয়ে সীমান্তের ১২৪৬ পিলারের জিরো লাইনে নদীর তীর ঘেঁষে মাটি ফেলছে। গ্রামবাসীর এমন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। একদল শ্রমিক মাহেন্দ্র ট্রাক নিয়ে ১২৪৬-এর জিরো লাইনে লালমাটি নদীর তীরে ফেলার সময় খবর পেয়ে ওপারের কুড়িখাল বিএসএফ ক্যাম্পের টহল দল এসে মাটি ফেলতে নিষেধ করে। পরবর্তীতে সিলেট-৫ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়ন বিজিবির ছাতকের নোয়াকোট বিওপির বিজিবির সদস্যরা জিরো লাইনে গিয়ে বিএসএফ ও অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে মাহেন্দ্র ট্রাক্টরটি আটক করেন।’
ছনবাড়ির মৃত জহুর আলীর ছেলে আবদুর নুর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গ্রামের স্কুলে ছেলে-মেয়েরা যাতায়াতকালে ট্রাকে করে মাটি ফেলার কারণে ধুলাবালিতে তাদের জামা-কাপড় নষ্ট হয়ে যায়, যে কারণে ট্রাক প্রতি ৫০ টাকা করে নিয়ে রোজ রাস্তায় পানি ফেলা হয়।’
সিলেট সেক্টরের-৫ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের বিজিবির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর লুৎফুল করীম মুঠোফোনে আলাপকালে বলেন, অবৈধভাবে জিরো লাইনে অনুপ্রেবেশ করে মাহেন্দ্র ট্রাক্টর দ্বারা সোনাই নদীর তীরে মাটি ফেলা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’  
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা কৃষি অফিসার কেএম বদরুল হক জানান, সোনাই নদীতে লালমাটি ফেলার কারণে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় রাবার ড্যামেও এখন প্রায় পানি শুন্য, বোরো-আমন ও শীত মৌসুমে ওই এলাকায় নাব্যতা সংকটে ধানের আবাদ এবং সবজী উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে এভাবে নদী ভরাটের কারণে ফি বছর প্রায় আমন মৌসুমে এ উপজেলার সোনাই নদীর সেচ সুবিধা ভোগী কৃষকদের প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিকটন ধান উৎপাদন ব্যবহৃত হচ্ছে, বোরো মৌসুমে আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকবে ছোট বড় ১০ হাওরের ৫ হাজার মেট্রিক টন ধান।’    
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুরের ইউপি চেয়ারম্যানের শাহজামালের নিকট নদী ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি পরিবেশের পক্ষে আছি, আমার ইউনিয়নের কিছু লোক ট্রাক প্রতি ১শ’  টাকা করে চাঁদা নিয়ে নদীর তীরে ও নদীর তলদেশে টিলার লাল মাটি ফেলে ভরাটের সুযোগ করে দিয়েছে, আমি বারবার বাঁধাও দিয়েছি, ইউএনও স্যারকেও বিষয়টি অবহিত করেছি।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়টি কেউ আমাকে অবহিত করেনি, নদী ভরাট করার অধিকার কারো নেই, নদীর কোন ব্যক্তি মালিকানাও নেই, আমি বিষয়টি সিলেটের জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেব এমনকি যেহেতু সুনামগঞ্জের ছাতকের কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নদী ভরাটের কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও ছাতকের ইউএনওকেও বলব আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে নদী ভরাট বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে।’   সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল আবেদীনকে বিস্তারিত অবহিত করে উনার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদকে বলেন, টিলা কাঁটা সম্পূর্ণ বে-আইনি, পরিবেশ ধ্বংস করে যারা সোনাই নদীর তীর ও তলদেশ ভরাট করছে সে বিষয়ে আমি কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও’র সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ