Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গারাও মানুষ

| প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো: তোফাজ্জল বিন আমীন : মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এই কথাটি আজ মিথ্যেয় পরিণত হতে যাচ্ছে। কারণ এখন আর মানুষ মানুষের জন্যে নয়। মানুষ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার জন্য ব্যস্ত। মানুষের বড় পরিচয় যে মানুষ, সেটা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। ফলে মানুষের নির্মম নির্যাতন দেখেও না দেখার ভান করে দিনপাত করছে সবাই। প্রতিবাদ করার যখন কেউ থাকে না বা প্রতিবাদ করার সাহস যখন কেউ করে না, তখন অসহায় মানুষের উপর জুলুমবাজদের জুলুমের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এটা ইতিহাসে প্রমাণিত। তবে এটাও জালিমদের মনে রাখা দরকার, নমরুদ-ফেরাউনের শাস্তি যিনি নিশ্চিত করেছেন তিনি আজও আছেন।
প্রতিবেশী মিয়ানমারের নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সে দেশের সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধারা নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেলেও নীরব মানবতাবাদীরা। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মুসলিম স্কলারদের ভেবে দেখা দরকার। আমার কাছে মনে হয়, রোহিঙ্গা মুসলমানদের অপরাধ দুটি : প্রথমত, তারা মুসলমান আর দ্বিতীয়ত, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। শুধু ধর্ম ও ভাষার কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা জাতিগত উৎখাতের শিকার। যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাপ-দাদার ভিটে বাড়িতে বসবাস করে আসছে তারা আজ তাদের ঘরবাড়িতে থাকতে পারছে না। সভ্য বিশ্বে একি কল্পনা করা যায়? মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সরকারের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারে না। দুই সন্তানের বেশি তারা নিতে পারে না। এ রকম হাজারো বাধার পাহাড় দিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র।
রোহিঙ্গাদের এ সমস্যা নতুন কিছু নয়। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব দেশগুলোর সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে করে অসহায় মানুষগুলো তাদের বাঁচার অধিকারটুকু পায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, রোহিঙ্গারাও যে মানুষ এটা একশ্রেণির প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ভুলে গেছে। সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিষেদগার করেই যাচ্ছে। তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কোরাস গাইছে একশ্রেণির বামপন্থি, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। আমরা আশা করব, সরকার এ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতির হাত আরো প্রসারিত করবে। রোহিঙ্গা মুসলমান শূন্য করতে নানা অজুহাতে রাখাইনে ১৯ বার অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমারের বর্বর বাহিনী। ১৯৪২ সাল থেকে চলা এই দমনপীড়ন নির্যাতনের ধারা আজও বহমান। মুসলিম রোহিঙ্গাদের চোখের পানিতে শুধু মিয়ানমার নয় পৃথিবীর আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ আর ফুলের মতো শিশুদের মিয়ানমার সরকার হত্যা করে গহীন সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুদের। ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষকে। অনেকে প্রাণের ভয়ে ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। অথচ শান্তিতে যিনি নোবেল পেয়েছেন তিনি তা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মুসলিম রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। অথচ তাদের জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। মজলুম রোহিঙ্গাদের বীভৎস চেহারাগুলো মিডিয়ার সংবাদে বা পত্রিকায় পাতায় দেখে অশ্রু ধরে রাখা যায় না। যাদের হৃদয়ে ভালোবাসার কোন স্থান নেই, তাদের কথা আলাদা। মিয়ানমার সরকারের নিষ্ঠুর নির্যাতনের ধারা দেখেও যাদের মনে একটুও দাগ কাটে না তাদেরকে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আপনাদের সামনে আপনাদের ভাই-বোন, মা-বাবা, ছেলেমেয়েদের যদি জলন্ত আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে, গুলি করে তুলে মাথার মগজ বের করে ফেলে, চোখের সামনে প্রিয়জনের তাজা দেহ দ্বিখ-িত করে ফেলে তখন আপনাদের কেমন লাগবে?।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের অতীত ইতিহাস আজকের মত ছিল না। তাদের হাতে স্বাধীন রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন তাদের হাতে ছিল তখন তারা বৌদ্ধদের উপর এভাবে নির্যাতন করেনি, যেভাবে আজ বৌদ্ধরা মুসলমানের উপর করছে। মিয়ানমারের মুসলিম জনগণের ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস বড়ই করুণ ও বেদনাবিদূর। উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকা মুসলিম বসতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী ছিল। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল স¤্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর থেকে শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরকান দখল করার পর পরই গণহারে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে মিয়ানমার ইংরেজদের অধীনে চলে যায়। ১৯৩৭ সালে মিয়ানমার স্বায়ত্তশাসন লাভ করার পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ইতিহাস সাক্ষী, শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বাস করলেও তাদের সরকার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ তো দূরের কথা, নেই কোন সামাজিক ও সাংবিধানিক অধিকার। ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণেই রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সরকার সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী নেত্রী সুচি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অবশ্য এখন অনেকেই এই পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবি তুলেছেন। আমরা মনে করি না, পুরস্কার ছিনিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হবে। তার কাছে আমাদের অনুরোধ, নোবেল পুরস্কারের মর্যাদা রক্ষা করে তিনি নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্যাতন বন্ধের উদ্যোগ নেবেন। আমরা আশা করব, বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ হিসাবে মানবিক দিকটা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করে নিরীহ মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন