Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আর্থিক জরিমানা প্রত্যাহারে বাধ্য হলো যুক্তরাজ্যের এফসিএ

তিন বছরে দায়িত্বপালনকালে বড় অঙ্কের মুনাফা আনেন আতাউর রহমান প্রধান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০২২, ৬:১৯ পিএম

সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রধানকে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা অবশেষে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)। এর আগে দুই দফায় আতাউর রহমান প্রধানের করা মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের এ সংস্থাটি। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আতাউর রহমান প্রধানের কোন স্থাবর সম্পত্তি ও আয় নেই উল্লেখ করে গত ১৮ নভেম্বর এক বিবৃতি দিয়েছে এফসিএ। এফসিএ’র ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোভিড এবং যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ সীমিত তথা ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির কারণে আর্থিক জরিমানা প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই যুক্তরাজ্যের ব্রাকলেস ব্যাংকসহ নামিদামি ব্যাংক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৩ কোটি ৯ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেছে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির (এফসিএ)। তবে ব্যতিক্রম ঘটল সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রধানের ক্ষেত্রে।

জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একমাত্র বাংলাদেশী ব্যাংক যার ৫১ শতাংশ শেয়ার মূলধন বাংলাদেশ সরকারের এবং অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশ শেয়ার মূলধন ছিল সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের। এটি যুক্তরাজ্য সরকারের তৎকালীন প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (চজঅ) দ্বারা অনুমোদিত এবং বর্তমানে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি (ঋঝঅ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দেশ স্বাধীনের পর যুক্তরাজ্যের মাটিতে বাংলাদেশী কমিউনিটিদের মাঝে রেমিটেন্স সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে এটি এক্সচেঞ্জ হাউস হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং নীতি শাখার ২৭.০৬.২০০১ইং তারিখের বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের নিকট পাঠানো একপত্রের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক চালুর ব্যাপারে সরকারের সম্মতিপত্র পাঠানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যের মাটিতে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড একটি পরিপূর্ণ ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ আতাউর রহমান প্রধান ২০১২ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১২ সালের মার্চে তৎকালীন সিইও খন্দকার ইকবালের (পরবর্তীতে বেসিক ব্যাংকের এমডি) কাছ থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ২০১৫ সালের মে মাসে এম সরোয়ার হোসেনের হাতে দায়িত্বভার অর্পণ করেন।

বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায়িক সূচক যেমন- এলসি, আমদানি ও মুনাফার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এসেছে আতাউর রহমান প্রধানের সময়ে। তিনি দায়িত্বভার ছেড়ে আসার পরই ব্যবসায়িকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্যাংকটি। ব্যাংকটিতে ওই সময়ে কর্মরত সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, মূলত মোঃ আতাউর রহমান প্রধানের সময়ে রেমিটেন্স, এলসি এ্যাডভাইজিংয়ের সঙ্গে ট্রেড ফাইন্যান্স সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসা বহুগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে ওই সময়ে সোনালী ব্যাংক ইউকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এছাড়া লোকাল কমিউনিটিসহ সরকারের নিকট ব্যাংকটির ভাবমূর্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির লোকসান ছিল ৪ লাখ ২৪ হাজার পাউন্ড। ২০১০ সালে এই লোকসান কমে ২ লাখ ৫৫ হাজার পাউন্ডে নেমে আসে। ২০১১ সালে মুনাফা হতে শুরু করে। ওই বছর মুনাফা হয় ৫ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড। ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ২৭ হাজার পাউন্ড, যা তার পূর্বের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০১২ সালের এই সাফল্যে ২০১৩ সালের ১৩ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে লভ্যাংশ হস্তান্তর করা হয়। সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের ২০১৩ সালের সাফল্য ছিল আরও ঈর্ষণীয়। ওই বছর মুনাফা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪ মিলিয়ন পাউন্ড, যা পূর্বের বছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ। একইভাবে এই অভাবনীয় সাফল্য উদযাপন করা হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে লভ্যাংশ হস্তান্তর করার মাধ্যমে। সেদিন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আজ আমাদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত আনন্দের দিন। মনে হচ্ছে এটি একটি ঈদের দিন। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক প্রতিষ্ঠান যখন লোকসান গুণছে তখন সোনালী ব্যাংকে (ইউকে) আমাদের মুনাফা দিচ্ছে।

২০১২ সালে মুনাফা বেড়ে ১০ লাখ ২৭ হাজার পাউন্ড, ২০১৩ সালে মুনাফা আরও বেড়ে ৩৯ লাখ ৫৮ হাজার পাউন্ডে উঠে আসে। ২০১৪ সালে মুনাফা হয় ২৭ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। ২০১৪ সালে ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ২৭ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। ওই বছর ১০ লাখ ৩৭ হাজার পাউন্ড প্রভিশন সংরক্ষণ করায় আয় বেশি হলেও মুনাফা কিছুটা কমে আসে। ২০১৫ সালে আবার লোকসানে যায় সোনালী ব্যাংক ইউকে। ওই বছর ১৫ লাখ ৩৩ হাজার পাউন্ড লোকসান হয়। ২০১৬ সালে লোকসান হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার পাউন্ড, ২০১৭ সালে লোকসান হয় ১ লাখ ২৫ হাজার পাউন্ড। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ওই ব্যাংকটি ৫৫ হাজার পাউন্ড মুনাফা করে। ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে (ইউকে) শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। কিন্তু ২০১০ সালের ২০ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই সময়ে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে ২০১৬ সালে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকারও বেশি। ওইসময় বন্ধ করে দেয় নতুন হিসাব খোলা। এরপর ২০১৮ সালে শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজরি ঘাটতি ও অন্যান্য কারণ উল্লেখ করে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয় আতাউর রহমান প্রধানকে। এরপর যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন আতাউর রহমান প্রধান। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালে দুই দফায় মামলাটি প্রত্যাহারে সমঝোতা প্রস্তাব দেয় যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফসিএ। সবশেষ গত অক্টোবরে সেই আপিল তুলে নেয়ার পর আতাউর রহমান প্রধানের বিরুদ্ধে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)।

এ বিষয়ে গত ১৮ নভেম্বর এক বিবৃতিতে এফসিএ’র এনফোর্সমেন্ট এবং মার্কেট ওভারসাইটের নির্বাহী পরিচালক মার্ক স্টুয়ার্ড বলেন, যুক্তরাজ্যে আতাউর রহমান প্রধানের কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও আয় নেই। এফসিএ’র ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের কাছে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে ব্যাখ্যা করার জন্য যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করতে সক্ষম নন তিনি। দীর্ঘস্থায়ী মামলা-মোকদ্দমা ব্যবহার করাও ন্যায্য নয় বলে উল্লেখ করে বিবৃতিতে। সার্বিকভাবে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির কারণে আর্থিক জরিমানাকে পাবলিক সেন্সার বলে আখ্যা দেয় এফসিএ। অথচ যে অভিযোগে জরিমানা করা হয়েছিল ওই সময় অর্থাৎ ২০১৫ সালে আতাউর রহমান প্রধান যুক্তরাজ্যে ছিলেন। ওই সময় তাকে কোনরকম জিজ্ঞাসাবাদ করেনি এফসিএ। বাংলাদেশ চলে আসার তিন বছর পর জরিমানা আরোপ করে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এ সংস্থাটি।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘যেসব অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয় সেসব অভিযোগের বিরুদ্ধে আমি ট্রাইব্যুনালে আপিল করি। যেহেতু এফসিএ জরিমানা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সেহেতু এখন আর আমার বলার কিছু নেই।’ যদিও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই যুক্তরাজ্যের ব্রাকলেস ব্যাংকসহ নামিদামি ব্যাংক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৩ কোটি ৯ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেছে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির (এফসিএ)। তবে ব্যতিক্রম ঘটল সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রধানের ক্ষেত্রে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ