Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভেজাল ওষুধ থেকে সাবধান

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : চারদিকের চালচিত্র দেখলে মনে হয়, লোকজন যেন অন্যায়, ও দুর্নীতিকে দেখেও না দেখার ভান করে চলাকেই শ্রেয় মনে করছে। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা , দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেন দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি করার ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছি। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী ভালো করেই জানে, কে কোথায়, কখন অন্যায়-অবিচারকে লালনপালন করে নিজের লাভ-লোকসান ঘরে তুলছে। তারপরও কেউ অন্যায়-অবিচারের কোন প্রতিবাদ করছে না। বরং নিজেরাই অন্যায়-অনাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সকল প্রকার অন্যায়কে একটা শক্ত ভিতের মধ্যে দাঁড় করাচ্ছে।
প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, দেশের ওষুধ ব্যবসা অর্থাৎ দেশের ফার্মেসি ব্যবসা এখন সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বলা হয়, ওষুধের দোকানগুলো নিয়মের বাইরে কাজ করছে অর্থাৎ তাদের বেচাকেনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যে শর্ত মোতাবেক ফার্মেসি ব্যবসার লাইসেন্স পেয়ে থাকে, সেই শর্ত অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়তই লঙ্ঘন করে চলছে। অনেক অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ী তাদের ওষুধের দোকানে বিক্রি করছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এমনকি নিষিদ্ধ বেআইনি ওষুধ বিক্রি করছে শুধুমাত্র অধিক মুনাফা লাভের আশায়। এমন অনেক ওষুধ আছে, যা একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করতে হয়, তা না হলে অনেক সময় ওষুধগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যায়। তারমধ্যে আবার এমন ফার্মেসিও আছে, যাদের কোন লাইসেন্স নেই। তারা আইনকানুনকে বা লাইসেন্সের শর্তসমূহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ, বেআইনি ওষুধ বিক্রি করে থাকে। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ বেআইনি নিষিদ্ধ ওষুধ যেসব বেআইনি প্রতিষ্ঠান কিংবা লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বিক্রি করছে, তাদের দেখার যেন কেউ নেই। ওষুধ প্রশাসন থেকে বলা হয়, তাদের জনবল এতই কম যে, সে জনবল দিয়ে সারা দেশে ওষুধ বিক্রির দোকানগুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। সংবাদে উল্লেখ করা হয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে লাইসেন্স প্রাপ্ত ১,২৩,৭৭৩টি ফার্মেসি রয়েছে। অভিযোগ আছে, যে সব বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি রয়েছে, সেই সব ফার্মেসিতেও মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল দেশের অনেক নামিদামি হাসপাতালগুলোতেও অনুমোদনহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমরা জানি, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়। কোন কিছু যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিরা কোন ধরনের আইন বিরুদ্ধ কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। জানা গেছে,আমাদের দেশে যতগুলো বৈধ ওষুদের দোকান রয়েছে, তারমধ্যে অর্ধেক পরিমাণই থাকে পরিদর্শনের বাইরে। প্রশ্ন হলো: বৈধ ওষুদের দোকানের অর্ধেক পরিমাণ যদি পরিদর্শনের বাইরে থাকে তবে সেখানে কি না হতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা দিনকে রাত করতে পারে, রাতকে দিন বানাতে পারে। কথাটা কে, কীভাবে নেবেন জানি না। আমার কেন জানি মনে হয়, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতিবাজ মানুষেরা এমনই হয়ে থাকে। প্রশাসন তাদের লোকবলের অভাবের কথা প্রকাশ্যে বলে থাকেন। বলে লোকবলের অভাবে সবকিছু ভালো করে দেখতে পারে না কিংবা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে না। এ কথা একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীও জানে। তারাও জানে লোকবলের অভাবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা তাদের ওষুধের দোকানের ভালো-মন্দের কিংবা বৈধ- অবৈধের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। তাই তারা সাহস পায় ভেজাল, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করতে। আবার এমনও অভিযোগ করা হয়ে থাকে, কর্তাব্যক্তিদের মাঝেও এমন ব্যক্তিও আছেন, যারা মনে করেন অবৈধ ওষুধের দোকান থাকলে ক্ষতি কি। তাতে তারাও অবৈধ লাভের অংক গুণতে পারেন। তবে কর্তাব্যক্তিরা সবাই যে মন্দ তা বলা যাবে না। তাদের মধ্যে হৃদয়বান ব্যক্তিরাও আছেন। যারা দুর্নীতিবাজদের সাগর চুরি দেখে নিজেরাও কষ্ট পান।
তারপরও কথা থাকে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা লোকবলের অভাব দেখিয়ে তাদের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ এদেশের সাধারণ জনগণের পকেটের পয়সায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বেতন ভাতা হয়ে থাকে। আর দেশের সাধারণ মানুষই হাটবাজারের ওষুধের দোকান থেকে অনেক সময় ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, অনুমোদনহীন ওষুধ ক্রয় করতে বাধ্য হয়। শহর অঞ্চলের শিক্ষিত সচেতন মানুষ না হয় দেখেশুনে ওষুধ ক্রয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষ গ্রামের হাটবাজার থেকেই ওষুধ কিনে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের মধ্যে এমনও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল রয়েছে, যেখানে হাটবাজারে মুলা, আলুসহ অন্যান্য সামগ্রী যেভাবে সাজিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বসে, ঠিক তেমনি ভাবে ওষুধ নিয়েও নাকি একশ্রেণির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বসে থাকে।
নিয়ম অনুযায়ী কোন ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ওষুধের দোকান কোন ওষুধ বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে যে কেউ যে কোন ওষুধের দোকান থেকে  ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে পারে। তাতে কেউ বাধা দেয় না। এমনকি প্রশাসনও বাধা দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ জানেও না ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা যায় না। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। কেন না প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষকে কখনও ওষুধ ক্রয় করার ব্যাপারে সচেতন করে তোলার জন্য কখনও পরামর্শ দেওয়া হয় না। তবে এ ব্যাপারে শুধু ওষুধ বিক্রেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ বিষয়ে দেশের জনগণের এমন কি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই শরীরে কোন ব্যথা দেখা দিলে কিংবা শরীরের তাপমাত্রা দেখা দিলে কিংবা পেটের সমস্যা দেখা দিলে তাড়াতাড়ি আরোগ্য লাভের আশায় নিজেরাই ডাক্তার হয়ে যায় কিংবা ওষুধের দোকানের বিক্রেতার পরামর্শে ওষুধ ক্রয় করে থাকে। তাতে অনেক সময় বিপদ যে দেখা দেয় না, তা নয়। অনেক সময় অনেক বিপদ দেখা দেয়।
ওষুধ আমাদের জীবন রক্ষা করে। তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, যারা মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল এবং অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি করে দেশের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের ধরে এনে আইনের কাঠগড়ায় তোলা। এই প্রকার দুর্বৃত্তদের প্রতি কোন ধরনের দুর্বলতা দেখালে দেশের জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়তে বাধ্য হবে। আমরা তো জানি, ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে আমাদের দেশের শিশুরা কিভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। যারা কেবলমাত্র মুনাফা লাভের আশায় এদেশের মানুষকে জিম্মি করে অনুমোদনহীন, ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তাদের অবশ্যই প্রচলিত আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে।
 লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন